মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুরকে স্বাগত জানাচ্ছেন বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ। মঙ্গলবার বর্ধমানের সভায় ছবিটি তুলেছেন সুমন বল্লভ।
প্রকাশ্য জনসভা থেকে ডাক দিলেন তৃণমূলকে গঙ্গাসাগরে ছুড়ে ফেলার। আর রুদ্ধদ্বার কর্মিসভায় বুঝিয়ে দিলেন, শুধু মঞ্চ থেকে ডাক দিয়ে বা বক্তৃতা করে সবটা হবে না। সংগঠন বাড়াতে হবে। আর সেই লক্ষ্যে যেতে হবে সাধারণ মানুষের দরজায় দরজায়।
এক নজরে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের বর্ধমান সফরের এটাই নির্যাস। যেখানে সংগঠন তৈরির গুরুত্ব ছিল অন্য বারের তুলনায় অনেক বেশি। আর তাই জেলাগুলির নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠকে এ দিন সময় দিয়েছেন তিনি। সেই কাজের জন্য এ দিনই দিল্লি না ফিরে রাতে কলকাতায় থাকেন তিনি। দিল্লি ফিরবেন বুধবার সকালে।
যে বর্ধমান শহরে এ দিন অমিতের সভা ছিল, তার থেকে খাগড়াগড়ের দূরত্ব বেশি নয়। স্বাভাবিক ভাবেই সেই সূত্র ধরে অমিত-সহ প্রায় সব বক্তার কথায় উঠে এসেছে রাজ্যে সাম্প্রতিক সন্ত্রাস-চিত্রের প্রসঙ্গ। অমিত এর সঙ্গে যোগ করেছেন সারদা-দুর্নীতিতে শাসকদলের হাবুডুবু খাওয়া এবং উন্নয়নে রাজ্যের পিছিয়ে পড়ার কথাও। রাজ্যে বিভিন্ন স্তরের ভোট-পর্ব যত এগিয়ে আসবে, ততই এই ত্রিফলা আক্রমণে তৃণমূলকে বারবার আরও তীব্র ভাবে বেঁধার ইঙ্গিতও দিয়ে রাখলেন এখানে। গত নভেম্বরে কলকাতায় এসে তৃণমূলকে শিকড়সমেত উৎখাতের ডাক দিয়েছিলেন বিজেপি সভাপতি। দল ও সমর্থকদের প্রতি বলেছিলেন, কলকাতায় আসন্ন পুরভোট থেকেই এ রাজ্যে ক্ষমতা দখলের পথে যাত্রা শুরু করতে হবে। এ বারে যখন বর্ধমানে এলেন, কলকাতা-সহ ৯১টি পুরসভার ভোটের বিশেষ দেরি নেই। তাই আক্রমণ উঠেছে আরও উচ্চগ্রামে।
কিন্তু অমিত শাহ জানেন, শাসকদলের বিরুদ্ধে শুধু মঞ্চ থেকে প্রচারেই সব হবে না। এই লক্ষ্যে পৌঁছতে প্রয়োজন সংগঠনকে আরও জোরদার করাও। এর আগে পশ্চিমবঙ্গের জন্য ১ কোটি সদস্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছিলেন অমিত। তার থেকে এ রাজ্যে দল অনেকটাই পিছিয়ে। কিন্তু সে জন্য তিনি রাজ্য নেতৃত্বকে একতরফা তিরস্কার করেননি বলেই দলের এক রাজ্য নেতা জানিয়েছেন। বরং সদস্য সংখ্যা সওয়া লক্ষ থেকে বাড়িয়ে দ্রুত ১৪ লক্ষে পৌঁছনোর মতো কঠিন কাজ যে রাজ্যের সংগঠকরা করেছেন, সেটা মাথায় রেখেছেন। বলেছেন, ৩১ মার্চের মধ্যে সেই সদস্য সংখ্যা ৭০-৭৫ লাখে তুলে আনা হোক। দলীয় সভাপতির বক্তব্য, তৃণমূলের ভয়ে ময়দান ছেড়ে পালিয়ে আসা চলবে না। আর সে জন্য সংগঠনকে মজবুত করতে হবে।
সংগঠনের দুর্বলতা সত্ত্বেও অবশ্য এর মধ্যেই রাজ্যের প্রধান বিরোধী হওয়ার দাবিদার হয়ে উঠেছে বিজেপি। লোকসভা ভোটের সময় থেকেই তারা ভাঁজ ফেলেছে তৃণমূল নেতৃত্বের কপালে। তার পর উপনির্বাচনে জিতে নিয়েছে বসিরহাট দক্ষিণ বিধানসভা কেন্দ্রটি। আর গেরুয়া বাহিনীর প্রভাব যত বাড়ছে, ততই হিংসার পথে যাওয়ার অভিযোগ উঠছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। রাজ্য জুড়ে কলেজে কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে প্রতিদিন তার ছায়া দেখা যাচ্ছে। মাত্র দু’দিন আগে বীরভূমের পাড়ুইয়ে বিজেপি সমর্থক এক পরিবারের বধূর বিরুদ্ধে বর্বরোচিত অত্যাচারের অভিযোগ উঠেছে তৃণমূল এবং পুলিশের বিরুদ্ধে। এই ঘটনাপ্রবাহ মাথায় রেখেই অমিত এ বার বুঝিয়ে দিয়েছেন, তৃণমূলের হামলার বিরুদ্ধে বিজেপি রুখে দাঁড়াবে। যে প্রতিরোধ ইতিমধ্যেই জেলায় জেলায় শুরু করেছেন বিজেপি কর্মী-সমর্থকেরা, ধারাবাহিক ভাবে সেই পথই মেনে চলা হবে। সেই সূত্রেই অমিত এ দিন বলেছেন, “মমতাদি’কে বলছি, যদি আপনি সংঘর্ষের জবাবে সংঘর্ষই চান, বিজেপি তার জন্য তৈরি আছে! তবে আমরা চাই, জনগণের কাছে যেতে। জনরোষের বন্যা এই তৃণমূলকে নিয়ে ফেলবে গঙ্গাসাগরে! যেখান থেকে তাদের আর খুঁজে পাওয়া যাবে না!”
বহু বছর আগে বরকত গনিখান চৌধুরী ডাক দিয়েছিলেন, বামফ্রন্টকে বঙ্গোপসাগরে ছুড়ে ফেলুন! এ বার তৃণমূলকে গঙ্গাসাগরে বিসর্জনের ডাক দিলেন বিজেপি-র সবর্ভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ!
বর্ধমানের বড়নীলপুর চৌরঙ্গি ময়দানে এ দিনের সমাবেশে ভিড় হয়েছিল ভালই। বিশেষত, বীরভূম, বর্ধমান, হুগলি থেকে আসা গৈরিক বাহিনী অমিত থেকে শুরু করে সিদ্ধার্থনাথ সিংহ, রাহুল সিংহ, চন্দন মিত্রদের স্বস্তি দিয়েছে। বিসর্জনের ডাকে তারা গর্জে উঠেছে স্বতস্ফূর্ত ভাবে। কলকাতার বাইরে বেরিয়ে জেলায় জেলায় কর্মসূচি শুরু করতে গিয়ে অমিতের জন্য বর্ধমানকে বেছে নেওয়া হয়েছিল সচেতন ভাবেই। যাতে গত অক্টোবরে খাগড়াগড় বিস্ফোরণের জের টেনে তৃণমূলের সঙ্গে জামাতের যোগের অভিযোগ এনে তোপ দাগতে পারেন বিজেপি-র সভাপতি। এবং অমিত সেই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহারও করছেন। বলেছেন, খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণ-স্থল যে বাড়ি, তার মালিক তৃণমূলের এক স্থানীয় নেতা। ওই ঘটনার বছরখানেক আগে কলকাতায় ঘটে যাওয়া বিস্ফোরণের তদন্ত রাজ্য প্রশাসন ঠিকমতো করলে খাগড়াগড়-কাণ্ড ঠেকানো যেত বলেছেন সে কথাও। একই সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তার প্রসঙ্গ তুলে জানিয়েছেন, এই নিয়ে যারা ছেলেখেলা করে, প্রতি পদে এনআইএ-র তদন্তে বাধা দেয়, তাদের আর এক মুহূর্তও ক্ষমতায় থাকতে দেওয়া উচিত নয়!
সন্ত্রাস যদি আক্রমণের এক দিক হয়, তবে অন্য দিক সারদা কেলেঙ্কারি। যার সঙ্গে সূক্ষ্ম ভাবে অমিত জুড়ে দিয়েছেন রাজ্যে শিল্পের বেহাল দশার প্রসঙ্গও। বলেছেন, “হিন্দ মোটর থেকে শুরু করে একের পর এক কারখানা বাংলায় বন্ধ। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর সে দিকে নজর নেই। তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন চিট ফান্ডের দুর্নীতিতে অভিযুক্তদের বাঁচাতে!” বিজেপি সভাপতির অভিযোগ, সুপ্রিম কোর্ট সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেওয়ার আগে রাজ্য সরকার সারদা কেলেঙ্কারির সত্য উদঘাটনে কিছুই করেনি। সিবিআই তদন্তে নামার পরে শাসকদলের সাংসদ-মন্ত্রী গ্রেফতার হয়েছেন, নানা তথ্যপ্রমাণ সামনে আসছে। অমিতের মন্তব্য, “এর পরেও মুখ্যমন্ত্রী বলছেন সব চক্রান্ত হচ্ছে!”
তবে ভূরি ভূরি অভিযোগের তির তৃণমূলের দিকে নিক্ষেপ করার পরেও বিজেপি নেতৃত্ব জানেন, মাত্র চার বছর আগে রাজ্যে ‘পরিবর্তন’ নিয়ে আসা বাংলার মানুষ জানতে চায়, ফের পরিবর্তন হলে বাংলার কী লাভ হবে? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্যই উন্নয়নের মন্ত্র শুনিয়েছেন অমিত। তাঁর কথায়, “উন্নয়নই আমাদের আসল কর্মসূচি।” সেই কর্মসূচির চেহারা কেমন? একেবারে মৌলিক প্রশ্ন তুলে সেটা বুঝিয়েছেন অমিত “বাংলার সব গ্রামে স্কুল আছে? সব গ্রামে ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে? ফোন করলেই ১১ মিনিটের মধ্যে অ্যাম্বুল্যান্স পৌঁছে যায়? যে সব রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায়, সেখানে এ সবই আছে!”
অমিতের সামনেই বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ এ দিন দাবি করেন, খাগড়াগড় এবং সারদার ধাক্কায় মমতার সরকার যে কোনও দিন পড়ে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে ২০১৫-তেই মহাকরণ এবং নবান্নে পদ্মফুল ফুটবে। তবে পাড়ুইয়ে এক মহিলার উপর দু’দিন আগেই নৃশংস অত্যাচারের প্রতিবাদে রাহুলবাবু যে ভাবে তৃণমূলকে ‘হিজড়ের দল’ বলে কটাক্ষ করেছেন, তাকে ভাল চোখে নেননি শাসকদলের নেতৃত্ব। প্রতিক্রিয়ায় কড়া নিন্দা-সমেত পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, “যাঁদের নিয়ে রাহুলবাবু ওই মন্তব্য করেছেন, তাঁরাও মানুষ। তাঁদের অপমান করা হয়েছে।”
যে মাঠে অমিত এ দিন সভা করে গেলেন, সেখানেই আজ, বুধবার ‘যুবরাজ’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে এনে পাল্টা সভা করবে তৃণমূল। সে প্রসঙ্গে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তরফে রাজ্যের পর্যবেক্ষক সিদ্ধার্থনাথ তৃণমূলকে পরামর্শ দিয়েছেন, মোদীর দলের নেতাদের অহেতুক গালমন্দ না করে রাজনৈতিক লড়াইয়ে আসুক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল। আবার পার্থবাবু অমিতের এ দিনের সভাকে ‘ফ্লপ’ বলে দাবি করেছেন! তাঁর কথায়, “বিজেপি নেতারা ২০১৬-তে রাজ্যে ক্ষমতায় আসবেন বলে দিবাস্বপ্ন দেখছিলেন। কিন্তু এত ঢাক-ঢোল পিটিয়েও সভা ফ্লপ করেছে বলেই অমিতবাবুর গুস্সা হয়েছে! তাই সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা করেছেন!”
তৃণমূল নেত্রীর ‘গুসসা’ বাড়িয়ে দেওয়ার কাজ অবশ্য করে গিয়েছেন সিদ্ধার্থনাথ! তিনি মন্তব্য করেছেন, “তৃণমূল নেতারা বলছেন, আমি নাকি জ্যোতিষী, যা বলছি তা-ই হচ্ছে! কিন্তু কুণাল চোর, টুম্পাই চোর, মদন চোর এ সব কি আমি প্রথম বলেছিলাম? আমার চেয়ে বড় জ্যোতিষী দিদিই!” সেই সঙ্গেই লালবাহাদুর শাস্ত্রীর নাতির ঘোষণা, “আবার বলে যাচ্ছি, ২০১৬-য় ‘ভাগ মমতা ভাগ’ হবে!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy