চাকরিপ্রার্থী তাঁর সম্ভাব্য কর্মস্থলের আগাম সুলুক-সন্ধান চাইবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এখানে উল্টো। চাকরিদাতাই প্রার্থীদের খুঁজে বেড়াচ্ছেন! এবং চূড়ান্ত বাছাই পর্বের আগেই!
পশ্চিমবঙ্গ পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)-এ এমন আজব উলটপুরাণের জেরে তোলপাড় পড়েছে প্রশাসনে। ঘনিয়েছে সন্দেহ ও বিতর্কের মেঘ। ডব্লিউবিসিএসের লিখিত পরীক্ষা শেষ হয়েছে গত ২৭ ডিসেম্বর। তার ফলাফলের ভিত্তিতে চূড়ান্ত পর্বের সাক্ষাৎকার (ইন্টারভিউ) হওয়ার কথা আগামী এপ্রিল-মে মাসে। কমিশন-সূত্রের খবর: পিএসসি-চেয়ারম্যানের কাছে কমিশনের দুই সদস্য দাবি করেছিলেন, লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নাম-ঠিকানা ইত্যাদি বিস্তারিত তথ্য যেন ইন্টারভিউয়ের যথেষ্ট আগে তাঁদের সরবরাহ করা হয়। তাঁদের জোরাজুরিতে কার্যত বাধ্য হয়েই চেয়ারম্যান সংশ্লিষ্ট বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছেন, লিখিত পরীক্ষায় সফল প্রার্থীদের ঠিকুজি-কুলুজি কমিশনের সব সদস্যের হাতে তুলে দিতে হবে ইন্টারভিউ শুরুর অন্তত সাত দিন আগে।
নিয়ম-নীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী এই ঘটনা জানাজানি হতেই শোরগোল শুরু হয়ে গিয়েছে। কমিশন ও রাজ্য প্রশাসনের একাংশ এর মধ্যে গুরুতর দুর্নীতির আঁচ পাচ্ছে। পরিস্থিতি এতটাই ঘোরালো যে, রাজ্যের মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রের কাছে পদত্যাগের ইচ্ছে পর্যন্ত প্রকাশ করে রেখেছেন পিএসসি-র চেয়ারম্যান নুরুল হক। প্রকাশ্যে অবশ্য কেউ এ প্রসঙ্গে মুখ খুলতে চাননি। তবে একান্ত আলাপচারিতায় সরকারি আধিকারিকদের বিভিন্ন মহল বলছে, প্রাথমিক-মাধ্যমিক শিক্ষক থেকে শুরু করে সিভিক ভলান্টিয়ার, ভিলেজ পুলিশ বা হোমগার্ড নিয়োগে গত দু’তিন বছরে রাজ্যে যে ভুরি ভুরি দুর্নীতির অভিযোগ, তারই ছোঁয়াচ লেগে গিয়েছে পিএসসি-তেও!
পিএসসি-র চেয়ারম্যানকে লেখা সচিবের সেই নোট। (ক্লিক করুন...)
পিএসসি-র এক কর্তা জানান, রাজ্য প্রশাসনের সমস্ত জায়গায় ডব্লিউবিসিএস অফিসারেরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বলতে গেলে, তাঁরাই প্রশাসনের মেরুদণ্ড। সরকারি নীতির রূপায়ণ ও উন্নয়ন কর্মযজ্ঞের মুখ্য হোতাও তাঁরা। ফলে তাঁদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় পুরোমাত্রায় স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখা জরুরি। যে কারণে পিএসসি বাড়তি সতকর্তা নিয়ে থাকে। চাকরিপ্রার্থীদের ইন্টারভিউয়ের সময়েও তা মানা হয়। ইন্টারভিউ বোর্ডে সাধারণত থাকেন কমিশনের এক বা একাধিক সদস্য, বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞ, সরকারি কর্তারা। নিয়ম অনুযায়ী, ইন্টারভিউয়ের আগের সন্ধ্যায় প্রার্থীদের বিস্তারিত তথ্য ও তাঁদের আবেদনের কপি-সহ একটি ফাইল (প্রেসি শিট) ইন্টারভিউ বোর্ডে থাকা সংশ্লিষ্ট কমিশন-সদস্যের পিএ-কে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পর দিন তিনি যখন ইন্টারভিউ নিতে ঢোকেন, পিএ ফাইলটি তাঁর হাতে তুলে দেন। ইন্টারভিউ বোর্ডে থাকা অন্য বিশেষজ্ঞ বা সরকারি আধিকারিকদেরও একই সময়ে প্রেসি শিট দেওয়া হয়।
কমিশনের এক প্রাক্তন চেয়ারম্যান বলেন, “প্রার্থী সম্পর্কে চূড়ান্ত গোপনীয়তা ও নিয়োগে স্বচ্ছতা বজায় রাখতেই এই বন্দোবস্ত। যে কমিশন-সদস্য ইন্টারভিউ নেবেন, প্রার্থীর ঠিকুজি-কুলুজি আগাম জানাটা তাঁর কাছে জরুরি নয়। প্রার্থী কেমন ইন্টারভিউ দিলেন, তিনি তা দেখবেন। বোর্ডের অন্যদের সামনে প্রার্থীকে যাচাই করে নম্বর দেবেন।” ওই প্রাক্তন চেয়ারম্যান জানাচ্ছেন, কেন্দ্রের ইউপিএসসি পরীক্ষাতেও একই পদ্ধতি চালু রয়েছে। “এর থেকে বিচ্যুতির অর্থ, স্বচ্ছতার পূর্ণ সুরক্ষিত ব্যবস্থা থেকে সরে আসা” মন্তব্য তাঁর।
নতুন পরিস্থিতিতে তা-ই হতে চলেছে বলে অভিযোগ। আশঙ্কা করা হচ্ছে, সাক্ষাৎ-প্রার্থীদের নাম-ধাম যথেষ্ট আগে জানা থাকলে তাঁদের সঙ্গে আগাম যোগাযোগ করে চাকরির প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে আর্থিক লেনদেনের পথও খোলা থাকবে। পাশাপাশি থাকবে প্রার্থীর দলীয় আনুগত্য যাচাই করে নেওয়ার সুযোগ, যা চূড়ান্ত বাছাইপর্বে প্রভাব ফেলতে পারে। গোপনীয়তার লক্ষ্মণরেখা লঙ্ঘনের এ হেন উদ্যোগের সূত্রপাত কী ভাবে?
কমিশন-সূত্রের খবর: পিএসসি-র পরিচালন বোর্ডে এখন চেয়ারম্যানকে নিয়ে পাঁচ সদস্য। বাকি চার জনের মধ্যে রয়েছেন পূর্ত দফতরের অবসরপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ারিং-ইন-চিফ ননীগোপাল মুখোপাধ্যায়, অবসরপ্রাপ্ত ডব্লিউবিসিএস অফিসার এস এস সরকার এবং দুই বিশিষ্ট ব্যক্তি দেবপ্রিয় মল্লিক ও দীপঙ্কর দাশগুপ্ত। চিকিৎসক তথা সমাজকর্মী দেবপ্রিয়বাবু সম্পর্কে রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের দাদা। আর দীপঙ্করবাবু এক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় উঁচু পদে কাজ করতেন, যার সূত্রে শিক্ষামন্ত্রী তথা তৃণমূল মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা। জানা গিয়েছে, ডব্লিউবিসিএসের এই দফার লিখিত পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগেই দুই সদস্য চেয়ারম্যানের কাছে দাবি করে বসেন, ইন্টারভিউয়ে সুযোগ পাওয়া প্রার্থীদের নাম, বাবার নাম ও বিস্তারিত ঠিকানা তাঁরা হাতে চান ইন্টারভিউ শুরুর যথেষ্ট আগে। কমিশনের তরফে ওঁদের বলা হয়, এটা নিয়মবিরুদ্ধ। কারণ, প্রার্থীদের সম্পর্কে গোপনীয়তা বজায় রাখাই পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের অন্যতম কাজ।
যুক্তি দেখিয়ে অবশ্য দু’জনকে টলানো যায়নি। তাঁরা জোরাজুরি চালিয়েই যেতে থাকেন। শেষমেশ গত ১ ডিসেম্বর চেয়ারম্যানের সম্মতিক্রমে কমিশন-সচিব একটি আদেশনামা জারি করেন। তার মোদ্দা বক্তব্য যে কোনও ইন্টারভিউয়ের সাত দিন আগে প্রার্থীদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সদস্যদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।
নির্দেশটি যে রীতিমতো চাপের মুখে পড়ে দিতে হচ্ছে, চেয়ারম্যানকে পাঠানো নোটে তা-ও উল্লেখ করেছেন সচিব। তিনি লিখেছেন, ‘গত ২৪ নভেম্বর অন্যান্য সদস্যের উপস্থিতিতে চেয়ারম্যানের ঘরে একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। সেখানে ঠিক হয়, এখন থেকে কোনও ইন্টারভিউয়ের অন্তত সাত দিন আগে কমিশন-সদস্যদের পিএ-কে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীদের নাম, বাবার নাম, বিস্তারিত ঠিকানা ইত্যাদি জানিয়ে দিতে হবে।’ এর পরেই চেয়ারম্যানের উদ্দেশে সচিব লিখেছেন, ‘মাননীয় সদস্যেরা এখনই ওই সব প্রেসি শিট হাতে পাওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন। আপনার নির্দেশের অপেক্ষায় রইলাম।’
উল্লিখিত বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যাতে কাজ হয়, পর দিনই (২ ডিসেম্বর) সচিবের নোটের উপরে চেয়ারম্যান সেই মর্মে অনুমোদন দিয়েছেন। ঘোর অনিয়ম হচ্ছে জেনেও কেন দিলেন?
পিএসসি-চেয়ারম্যান নুরুল হকের জবাব “কমিশনের ভিতরের বিষয় নিয়ে আমি কোনও মন্তব্য করব না।” যদিও তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলের খবর, সদস্যদের এমন আচরণ দেখে চেয়ারম্যান খুবই তিতিবিরক্ত, বীতশ্রদ্ধ। মুখ্যসচিবের কাছে তিনি পদত্যাগ করতে চেয়েছেন। এমনকী, পদত্যাগপত্র লিখেও রেখেছেন। কমিশনের এক প্রাক্তন চেয়ারম্যান জানাচ্ছেন, পঞ্জাবে পাবলিক সার্ভিস কমিশনে নিয়োগ-কেলেঙ্কারির জেরে চেয়ারম্যানের জেল হয়েছিল। শিক্ষক নিয়োগ কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে হরিয়ানার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমপ্রকাশ চৌটালা আপাতত জেলে রয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গে পিএসসি’র ইতিহাসে আগে এত গুরুতর দুর্নীতির ঘটনা ঘটেনি। তবে এ রাজ্যে ২০১২-র ডব্লিউবিসিএসের ফলাফল বেরোতে দু’বছর লেগেছিল। পিএসসি-সূত্রের খবর, এক মন্ত্রী সে বার নিজের পছন্দসই প্রার্থীদের তালিকা পাঠিয়েছিলেন, চেয়ারম্যান যা মানতে রাজি হননি। সেই টানাপড়েনেই ফল প্রকাশ পিছিয়ে যায়।
পিএসসি-সূত্রে এ-ও ইঙ্গিত মিলেছে, কমিশনের সদস্য যে দুই প্রাক্তন সরকারি অফিসার, সাক্ষাৎ-প্রার্থীদের সম্পর্কে আগাম তথ্য সংগ্রহে তাঁরা আগ্রহ দেখাননি। এসএস সরকার ও ননীগোপাল মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে শুক্রবার যোগাযোগ করা হলে দু’জনেই এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন। তবে কমিশনের কর্মীমহলের খবর, ‘সরকার সাহেব’ ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন, ইন্টারভিউয়ের সাত দিন আগে তাঁকে প্রেসি শিট দেওয়ার কোনও দরকার নেই। ননীগোপালবাবুও ‘নিয়ম বহির্ভূত’ কোনও কাজকর্মে জড়িত থাকতে চান না। অন্য সদস্যদের এক জন দেবপ্রিয় মল্লিককে এ দিন বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তাঁর সাফ জবাব, “আমি কমিশন নিয়ে কোনও কথা বলব না। যা জানার, চেয়ারম্যানের কাছে জানুন।” এ প্রসঙ্গে এসএমএসেরও উত্তর দেননি তিনি। প্রার্থীদের তথ্য আগাম চাওয়ার ব্যাপারে দীপঙ্কর দাশগুপ্তের বক্তব্য শুনতে চাইলে তিনি এ দিন জানান, ইন্টারভিউ বোর্ডে ব্যস্ত আছেন। “কিছু জানতে হলে চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলুন।” ফোনে জানিয়ে দেন দীপঙ্করবাবুও।
পরিবর্তনের জমানাতেও নিয়োগ ঘিরে অস্বচ্ছতার অভিযোগ পশ্চিমবঙ্গে নতুন কিছু নয়। লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি বিলি হয়েছিল বলে সরকারের বিভিন্ন স্তরে অভিযোগ জমা পড়েছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার স্কুল বোর্ডের চেয়ারম্যান স্বয়ং ফাঁস করেছিলেন টেট কেলেঙ্কারি। এসএসসি মারফত মাধ্যমিক শিক্ষক নিয়োগে অজস্র অনিয়মের খবর এক ডব্লিউবিসিএস অফিসার সাংবাদিক সম্মেলন করে জানিয়েছেন। সিভিক ভলান্টিয়ার, ভিলেজ পুলিশের চাকরির নেপথ্যে টাকার খেলার অভিযোগ জোরালো। আর হোমগার্ড নিয়োগে দুর্নীতির প্রেক্ষাপটে মুর্শিদাবাদের এসপি এক ডিজি’র বিরুদ্ধেই সরকারকে লিখিত নালিশ করেন, আপাতত যার তদন্ত চলছে।
গোপনীয়তার নিয়ম ভেঙে পিএসসি-ও এ বার দুর্নীতি-দলতন্ত্রের স্রোতে গা ভাসাতে চলেছে বলে মনে করছে বিরোধীরা। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা, সিপিএমের সূর্যকান্ত মিশ্রের প্রতিক্রিয়া, “এমন তো করা যায় না! এ বার ডব্লিউবিসিএসেও নিজেদের লোক ঢোকানো আর পয়সা তোলার ব্যবস্থা হল! চাকরিপ্রার্থীদের অবস্থা ভেবে কষ্ট হচ্ছে।” বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের আক্ষেপ, “দলবাজি তো হবেই, উপরন্তু এজেন্টরা গিয়ে এখন প্রার্থীদের থেকে সরাসরি টাকা চাইবে। ডব্লিউবিসিএস পরীক্ষারও জাত রাখল না এরা!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy