অভিযোগ, এ ভাবেই বুথে ঢুকে অন্যের ভোট দিয়ে দেন ঝর্ণা সিংহ। বৃহস্পতিবার আরামবাগের মইগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।—ফাইল চিত্র।
রাজ্যে তৃতীয় দফার ভোটে অন্যের হয়ে ভোট দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল আরামবাগের তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্য ঝর্ণা সিংহের বিরুদ্ধে। টিভি ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল বুথের ভিতরকার সেই ছবি। এ দিন ভোরে ঝর্ণাদেবীকে গ্রেফতার করা হলেও জামিন পেয়ে গিয়েছেন তিনি।
কেন পুলিশ তাঁর জামিনের বিরোধিতা করল না, সেই প্রশ্ন তুলে ফের এক বার প্রশাসনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতী আচরণের অভিযোগ আনলেন বিরোধীরা। পুলিশের অবশ্য বক্তব্য, নির্দিষ্ট ধারা মেনেই ঝর্ণাদেবীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। সেই ধারা জামিনযোগ্য বলেই জামিন পেয়েছেন তিনি।
এ বারের লোকসভা ভোটে এখনও পর্যন্ত যে সব এলাকায় শাসক দলের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি গা জোয়ারির অভিযোগ এসেছে, আরামবাগ তার অন্যতম। বাম আমলে অনিল বসুর দুর্গ বলে পরিচিত এই এলাকায় তৃণমূল ব্যাপক রিগিং করেছে বলে অভিযোগ। ৩০ এপ্রিল এখানেই তিরোল পঞ্চায়েতের অন্তর্গত মইগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৭ নম্বর বুথে পঞ্চায়েত সদস্য ঝর্ণা সিংহ দাঁড়িয়ে থেকে ভোট করাচ্ছিলেন বলে বিরোধীদের দাবি। সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরাতেও সে ছবি ধরা পড়েছে। ঝর্ণাদেবীর নিজের বক্তব্য, “আমি ভোট দেওয়ার জন্য বুথে দাঁড়িয়েছিলাম। জখম এক প্রৌঢ়া ভোট দেওয়ার জন্য সাহায্য চান। তাঁকে এগিয়ে দিয়ে সাহায্য করার জন্য আমি প্রিসাইডিং অফিসারের অনুমতিও নিয়েছিলাম। তিনি নিজের পছন্দের প্রার্থীকেই ভোট দিয়েছেন। আমি তাঁকে কিছু বলিনি।”
৩০ এপ্রিলই প্রিসাইডিং অফিসার থানায় ঝর্ণাদেবীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলেও তাঁকে ধরতে পুলিশ এত দিন সময় নিল কেন? হুগলি জেলা পুলিশের এক কর্তা বলেন, বিষয়টি জানাজানি হয়ে যেতেই ওই পঞ্চায়েত সদস্য গা ঢাকা দেন। রবিবার ভোরে গৌরহাটি মোড় থেকে তাঁকে ধরা হয়। পরে আরামবাগ আদালতে জামিন পান ঝর্ণা। পুলিশ তাঁর জামিনের বিরোধিতা করল না কেন? জেলা পুলিশ সূত্রের খবর, জামিনযোগ্য ধারাতেই মামলা করা হয়েছিল ঝর্ণার বিরুদ্ধে। সেই মোতাবেকই জামিন পেয়েছেন তিনি। বিরোধী দলগুলি কিন্তু দাবি করেছে, মামলাকে লঘু করে দেখানোর জন্যই জামিনযোগ্য ধারা আনা হয়েছে ওই পঞ্চায়েত সদস্যার বিরুদ্ধে। শেষ পর্যন্ত তাঁর শাস্তি হবে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বিরোধীদের অনেকেই।
সিপিএম জেলা সম্পাদক সুদর্শন রায়চৌধুরী বলেন, “তিরোল এমন একটা জায়গা যেখানে আমাদের প্রার্থী শক্তিমোহন মালিক ও সমর্থকদের মারধর করা হয়েছিল। সেই জায়গায় তো এই ঘটনা ঘটবেই। যে ধারায় ওই পঞ্চায়েত সদস্যার বিরুদ্ধে মামলা রুজু করা হয়েছে তা লোক দেখানো।” বিজেপির হুগলি জেলার সহ-সভাপতি স্বপন পাল বলেন, “তৃণমূলকে জেতাতে পুলিশ-প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন একযোগে কাজ করেছে। ঝর্ণাদেবী যে জামিন পেয়ে গিয়েছেন, এটা তারই ফল।” প্রদেশ কংগ্রেসের অন্যতম সম্পাদক তথা হুগলি লোকসভা কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থী প্রীতম ঘোষ বলেন, “ঝর্ণাদেবী শাসক দলের নির্বাচিত সদস্যা। ওঁর আইন জানা উচিত ছিল। পুলিশের উপর আমাদের আস্থা নেই। এরা সব সময়ে পক্ষপাতিত্ব করছে।”
হুগলির পুলিশ সুপার সুনীল চৌধুরী অবশ্য এদিন বলেন, “আমরা ধৃতের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট ধারাতেই মামলা রুজু করেছি।” হুগলি জেলা পুলিশের এক কর্তা জানাচ্ছেন, ভোট কেন্দ্রে ঢুকে অন্যের হয়ে ভোট দেওয়াটা অপরাধ। এই রকম ক্ষেত্রে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৭১ সি ধারায় অভিযোগ আনা যায়। দোষী সাব্যস্ত হলে অভিযুক্তের তিন মাস পর্যন্ত জেল হতে পারে। তবে এই ধারাটি জামিনযোগ্য। ফলে ঝর্ণাদেবীর বিরুদ্ধে আলাদা করে পক্ষপাত দেখানো হয়নি বলেই পুলিশের দাবি।
১৭১ সি ধারাই কি এ ক্ষেত্রে আইনের একমাত্র প্রযোজ্য ধারা? নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে যুক্ত এক প্রাক্তন আমলা কিন্তু জানাচ্ছেন, তৃণমূলের ওই মহিলা পঞ্চায়েত সদস্য যা করেছেন তা বুথ দখলেরই সামিল। ওই অভিযোগে ঝর্ণাদেবীর বিরুদ্ধে জনপ্রতিনিধিত্ব (আরপি) আইনের ১৩৫এ ধারাতেও মামলা করা যেত। ওই ধারাটি জামিন অযোগ্য। অপরাধ প্রমাণিত হলে ওই ধারায় তিন বছর পর্যন্ত কারাবাসের শাস্তি হতে পারে। তা ছাড়া ঝর্ণাদেবীর বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪১৯ ধারাতেও (অন্যের নাম ভাঁড়িয়ে প্রতারণা) মামলা করা যেত বলে ওই আমলা জানাচ্ছেন। ৪১৯ ধারাটি অবশ্য জামিনযোগ্য।
নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য কী? এক পঞ্চায়েত সদস্য এই ভাবে অন্যকে ভোট দেওয়াতে গিয়ে ধরা পড়লেন, কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে এবং ওই প্রিসাইডিং অফিসারের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিল না কেন নির্বাচন কমিশন? রাজ্যের বিশেষ পর্যবেক্ষক সুধীরকুমার রাকেশ বলেন, “সংবাদমাধ্যমে কী ছবি দেখা গেল, তার উপরে কাউকে অভিযুক্ত করা হয় না। কোন ধারা প্রয়োগ করা হবে তা-ও ঠিক করা হয় না। প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে পুলিশ যা মনে করে সেই অনুযায়ী ধারা প্রয়োগ করা হয়। তদন্তের পরবর্তী পর্যায়ে যদি দেখা যায় অভিযুক্তদের অভিযোগ আরও গুরুতর, তখন অন্য আইনে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার সুযোগ রয়েছে।” আরামবাগের ঘটনায় ওই বুথের প্রিসাইডিং অফিসার অরুণকুমার নন্দীকে সঙ্গে সঙ্গে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলেও রাকেশ জানান।
৩০ এপ্রিল রাজ্যে ভোট অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে বলে মন্তব্য করে এর আগে বিরোধীদের সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন রাকেশ। বিরোধীরা দিল্লিতে নির্বাচন কমিশনের সদর দফতরে গিয়ে তাঁদের বক্তব্য জানিয়ে এসেছেন। শনিবারই তার উত্তরে রাজ্যের ৫০টি বুথ সম্পর্কে রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছে কমিশন। এই কড়াকড়ির আবহেই রবিবার ঝর্ণাদেবী গ্রেফতার হন। তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ এবং পুলিশের ভূমিকা, দু’টি প্রশ্নেই বিরোধীদের নালিশ উড়িয়ে দিয়েছে তৃণমূল।
আরামবাগের তৃণমূল বিধায়ক কৃষ্ণচন্দ্র সাঁতরার অভিযোগ, “মিথ্যা অভিযোগে আমাদের ওই পঞ্চায়েত সদস্যাকে ফাঁসানো হয়েছে।” সেই সঙ্গে জেলা তৃণমূলের নেতা তপন দাশগুপ্তর ব্যাখ্যা প্রিসাইডিং অফিসারের অভিযোগের ভিত্তিতে এক জন পঞ্চায়েত সদস্যা গ্রেফতার হয়েছেন, এটাই প্রমাণ করে প্রশাসন পক্ষপাতী নয়। তাঁর পাল্টা কটাক্ষ, “আরামবাগ সেই জায়গা, সেখানে সুদর্শনবাবুর দলবল ছ’লক্ষ ভোটে জিতেছিল। ওঁরা একটা উদাহরণ দেখান যে, ওঁদের বিরুদ্ধে যখন বুথ দখলের অভিযোগ উঠত, তখন কোনও ব্যবস্থা নিয়েছিলেন বা কাউকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। দেখাতে পারলে রাজনীতি ছেড়ে দেব।”
ঘটনাপ্রবাহ শুধু আরামবাগে অবশ্য আটকে নেই। ৩০ এপ্রিল বর্ধমানের একটি ভোট গ্রহণ কেন্দ্রের বাইরে এক ভোটারকে নিগ্রহের ঘটনাতেও ধৃতদের দু’জনে জামিন পেয়ে গিয়েছেন। পুলিশ শনিবার রাতে দুই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করলেও রবিবার ধৃতদের জামিনের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে আদালতে হাজির ছিলেন বর্ধমান পুরসভার ১০ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর পরেশ সরকার। আক্রান্ত দম্পতি পুলিশের কাছে অভিযোগ না করায় পুলিশই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে মামলা দায়ের করেছিল বলে প্রশাসনের দাবি। পরেশবাবু বলেন, “যাঁরা গ্রেফতার হয়েছেন, তাঁরা আমার ওয়ার্ডের যুবক। ধৃত বিপ্লব ভট্টাচার্য ও সুজিত হালদার আমাদের সমর্থক বলেই জানতে পেরেছি। তাই আমি আমাদের লোকের জামিনের ব্যাপারটা দেখতে এসেছি।”
অভিযুক্তদের আইনজীবী সদন তা জানান, ধৃতদের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযোগ, একটি বুথে লাইনে দাঁড়ানোকে কেন্দ্র করে ওই দু’জনের সঙ্গে এক দম্পতির প্রথমে বচসা হয়। ওই দম্পতিকে মারধর করে ওই দু’জন। তারা পুলিশের সামনে আসতে চাননি। লিখিত অভিযোগও করতে চাননি। আইনজীবীর কথায়, “পুলিশ ভিডিও ফুটেজ দেখে ওই দু’জনকে চিহ্নিত করে। ঘটনাটি গুরুতর নয় বলেই জামিনযোগ্য ধারায় মামলা হয়েছে।”
তবে কি ঝর্ণাদেবীর ঘটনাটিও গুরুতর নয় বলে মনে করেই জামিনযোগ্য ধারায় মামলা হল?
প্রশ্ন থাকছেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy