বিভিন্ন মামলায় আদালতের পর্যবেক্ষণকে কেন্দ্র করে সংবাদমাধ্যমে ‘পেড নিউজ’ (অর্থের বিনিময়ে খবর) হচ্ছে বলে লোকসভা ভোটের আগে অভিযোগ করলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়।
মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ভি এস সম্পতের নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের ফুল বেঞ্চের সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে রবিবার মুকুলবাবু বলেন, “মুখের একটা শব্দ নিয়ে কিছু কিছু সংবাদমাধ্যম যে ধরনের ভূমিকা নিচ্ছে, আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, এটা পেড নিউজ। এবং কিছু রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে এর জন্য অর্থ দিচ্ছে।” বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বুঝিয়েছেন, আদালত বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে সব পর্যবেক্ষণের কথা বলে, অনেক সময় চূড়ান্ত রায় তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয় না। চূড়ান্ত রায়ে পর্যবেক্ষণের উল্লেখও থাকে না অনেক ক্ষেত্রে। অথচ আদালতের পর্যবেক্ষণ থেকে কিছু সংবাদমাধ্যম খবর করছে। রাজ্য সরকারকে হেয় করা হচ্ছে। কিছু সংবাদগোষ্ঠী এবং বিরোধীরা মিলে এগুলো করছে এবং এমন ভাবে দেখানো হচ্ছে, যাকে ‘পেড নিউজ’ই বলতে হবে।
পাড়ুই-কাণ্ড বা আমতা গণধর্ষণের ঘটনায় সম্প্রতি হাইকোর্টের বিচারপতিরা রাজ্য সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। সারদা মামলার শুনানিতে রাজ্য সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সুপ্রিম কোর্টও। আদালতের সেই সব পর্যবেক্ষণ প্রকাশিত হয়েছে সংবাদমাধ্যমে। আজ, সোমবার কলকাতা হাইকোর্টে পাড়ুই মামলার শুনানি রয়েছে। বুধবার সুপ্রিম কোর্টে সারদা মামলার শুনানি রয়েছে। ওই দুই মামলার শুনানির আগে মুকুলবাবু এই ধরনের মন্তব্য করে সংবাদমাধ্যমকে চাপে রাখতে চেয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন আইনজ্ঞদের কেউ কেউ। আইনজ্ঞদের অনেকে আবার মনে করছেন, মুকুলবাবুর এ দিনের মন্তব্য আদালত অবমাননার সামিল।
রাজ্যের অন্য কোনও রাজনৈতিক দলই মুকুলবাবুর বক্তব্যকে সমর্থন করেনি। উল্টে ওই বক্তব্যকে হাতিয়ার করে রাজ্যের শাসকদলেকে বেঁধার সুযোগ পেয়ে গিয়েছে তারা। অন্য দলগুলির অভিযোগ, শাসকদল সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রবীন দেবের মতে, “নিজেদের অস্বস্তির কথা বেরিয়ে আসছে বলেই এমন অভিযোগ করছেন। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে।” প্রসঙ্গত, এ বার ভোটের মরসুমেই কমিশনের কাছে ‘পেড নিউজে’র অভিযোগ করেছে সিপিএম-ও। তবে তা আদালত সংক্রান্ত ঘটনায় নয়। বিরোধীদের কালিমালিপ্ত করার জন্য শাসকদল বা কোনও গোষ্ঠীর মদতে কিছু প্রচার চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ এনেছে তারা।
মুকুলবাবুর বক্তব্য খণ্ডন করে প্রদেশ কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেছেন, “আদালতের পর্যবেক্ষণ থেকে খবর করা যাবে না কেন? বহু যুগ ধরে এটা হয়ে আসছে। সে সরকারের যে-ই থাকুক না কেন! এর সঙ্গে নির্বাচনেরও কোনও সম্পর্ক নেই।” পাশাপাশিই প্রদীপবাবুর মন্তব্য, “চার দিক থেকে এখন বিষ ফোঁড়া বেরোচ্ছে বলে শাসকদল সংবাদমাধ্যমের ঘাড়ে দোষ চাপাতে চাইছে!”
তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের অভিযোগের কোনও যুক্তি খুঁজে পাননি আইনজ্ঞদের অনেকেই। তাঁদের মনে হয়েছে, মুকুলবাবু বিষয়টি আদালতেই বলতে পারতেন। তাঁর এ দিনের ওই অভিযোগে সংবাদমাধ্যম এবং সাংবাদিকদের পেশাকে অপমান করা হয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন আইনজ্ঞদের কেউ কেউ। তাঁরা বলছেন নির্বাচন কমিশনে না গিয়ে মুকুলবাবু আদালতকেই বিষয়টি জানাতে পারতেন। কলকাতা হাইকোর্টের এক আইনজীবীর মন্তব্য, “আগামী সপ্তাহেই দু’টি গুরুত্বপূর্ণ মামলার শুনানি রয়েছে। একটি সুপ্রিম কোর্টে। অন্যটি কলকাতা হাইকোর্টে। তার আগে সংবাদমাধ্যমকে চাপে রাখতেই এমন মন্তব্য করেছেন মুকুল।”
আইনজীবী সমরাদিত্য পাল বলেন, “যদি মনে হয় আদালতের খবর ঠিকঠাক লেখা হচ্ছে না, তা হলে আদালতের শরণাপন্ন হতে হবে। উনি সেটা করেননি। যা করেছেন, সেটা পশ্চিমবঙ্গের সংবাদপত্রের যে ঐতিহ্য রয়েছে, তাকে অপমান করেছেন। সাংবাদিকদের পেশাকে অপমান করেছেন।” কলকাতা হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি প্রতাপ রায়ের মন্তব্য আরও কড়া। তিনি বলেন, হাইকোর্ট প্রকাশ্য জায়গা। ‘গোপন শুনানি’ ছাড়া বিচারপতির যে কোনও মন্তব্য সংবাদপত্রে ছাপা হতে পারে। এটা সংবিধানে লেখা আছে। কারণ, বিচারপতিরা যা বলছেন, তা কোনও গুপ্ত বিষয় নয়। তাঁরা নিজেদের এক্তিয়ার বুঝেই মন্তব্য করেন। কোনও রাজনৈতিক দলের এ নিয়ে মন্তব্য করার অধিকার নেই।”
বিচারপতি রায়ের বক্তব্য, সংবাদপত্রের প্রতিবেদন হাইকোর্ট আপত্তিকর মনে করলে ব্যবস্থা নিত। রাজনৈতিক নেতাদের একান্তই কিছু মনে হলে, তাদের জন্য তো হাইকোর্টের দরজা খোলা আছে। সেখানে যেতে পারতেন। কিন্তু এ ভাবে মন্তব্য করে এ রাজ্যের সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকদের ঐতিহ্যকে কালিমালিপ্ত করা হল। আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য মনে করেন, মুকুল রায়ের বক্তব্য আদালত অবমাননার সামিল হতে পারে। তাঁর কথায়, “আদালতের মন্তব্য করার স্বাধীনতা আছে। সংবাদপত্রেরও সেই মন্তব্য প্রকাশ করার স্বাধীনতা রয়েছে। ওঁর মন্তব্যের অর্থ, আদালত টাকার বিনিময়ে মন্তব্য করছে, যা সংবাদপত্র ছাপাচ্ছে। তাই ওঁর বক্তব্য আদালত অবমাননার সামিল হতে পারে। আমার মনে হয়েছে, এটা অজ্ঞানতাপ্রসূত, অর্বাচীন মন্তব্য।”
মুম্বই হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায় বলেন, “উনি (মুকুল রায়) কী বলতে চেয়েছেন, তা জানি না। তবে অনেক সময়েই বিচারকেরা মামলার সময়ে নানা মন্তব্য করেন। সেগুলি কিন্তু ওঁদের রায় নয়। অনেক সময়ে ওই সব মন্তব্য ছাপলে বিভ্রান্তি ছড়ায়।
তবে এই সব মন্তব্য ছাপায় তাদের অবমাননা হয়েছে কি না, তা আদালতই বিচার করবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy