আবার এক প্রস্ত এজলাস বদলের পরে ফের শুরু হল পাড়ুই মামলা। কিন্তু রাজ্য সরকারের পক্ষে এ বারও স্বস্তির খবর নেই। বরং প্রথম দিনের শুনানিতেই বিচারপতি হরিশ টন্ডন বুঝিয়ে দিলেন, বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত যেখানে শেষ করেছেন, সেখান থেকেই তিনি পাড়ুই মামলার পরবর্তী শুনানি শুরু করতে চান।
অর্থাৎ? ঠিক বিচারপতি দত্তের মতোই বিচারপতি টন্ডনও মামলাটি হাতে নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন, বীরভূমের তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল এবং বীরভূম জেলা পরিষদ সভাপতি বিকাশ রায়চৌধুরীকে এত দিন গ্রেফতার করা হয়নি কেন। কেবল তাই নয়। বিচারপতি টন্ডনও বিচারপতি দত্তের মতোই মনে করেছেন, এই মামলায় ডিজি-কে আদালতে ডাকা জরুরি।
পাড়ুই মামলায় কেন বীরভূমের তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলকে গ্রেফতার করা হয়নি, এত দিন সেই প্রশ্ন বারবার তুলেছেন বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত। গত ১০ এপ্রিল ‘মুখ্যমন্ত্রীর আশীর্বাদধন্য’ বলেই অনুব্রতকে ধরা যাচ্ছে না বলেও মন্তব্য করেছিলেন তিনি। হাইকোর্টে তলব করেছিলেন পাড়ুই তদন্তের ভারপ্রাপ্ত সিট-এর প্রধান, রাজ্য পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেল জিএমপি রেড্ডিকে। ১১ এপ্রিল সেই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করেই সরকার পক্ষ প্রধান বিচারপতি অরুণকুমার মিশ্র এবং বিচারপতি জয়মাল্য বাগচির ডিভিশন বেঞ্চে যায়। পাড়ুই মামলার হাতবদল সেই শুরু।
ডিভিশন বেঞ্চ প্রথমেই ডিজি-র হাজিরার নির্দেশের উপরে তিন সপ্তাহের স্থগিতাদেশ জারি করে। সেই সঙ্গে মামলাটি বিচারপতি দত্তের এজলাস থেকে সরিয়ে নিয়ে নিজেরা শুনবে বলে স্থির করে। এর বিরুদ্ধে আবার সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন পাড়ুই হত্যা মামলায় অভিযোগকারী হৃদয় ঘোষ। সুপ্রিম কোর্ট অবশ্য মামলাটি ডিভিশন বেঞ্চের কাছেই ফিরিয়ে দেয়।
এর পরে পাড়ুই মামলা ২ মে ডিভিশন বেঞ্চে উঠেছিল। কিন্তু সে দিন কোনও শুনানি হয়নি। ৬ মে যখন ফের মামলা ওঠে, প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ তখন বৃত্তটি সম্পূর্ণ করে মামলাটি ফের বিচারপতি দত্তের এজলাসে পাঠায়। এর মধ্যে বিচারপতি দত্তের এজলাস থেকে পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ সংক্রান্ত আরও কিছু মামলা সরে গিয়েছিল এবং ক’দিনের ব্যবধানে ফিরে এসেছিল। পাড়ুই মামলার ভবিতব্যও সেটাই দাঁড়ায়। কিন্তু ১৩ জুন ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে মামলা থেকে অব্যাহতি নেন বিচারপতি দত্ত। ওই মামলা এখন এসেছে বিচারপতি হরিশ টন্ডনের এজলাসে।
প্রথম থেকেই পাড়ুই মামলা ঘিরে আদালতে অস্বস্তিতে পড়েছে রাজ্য সরকার। গত বছর ২১ জুলাই বীরভূমের পাড়ুইয়ে খুন হন সাগর ঘোষ। সাগরবাবুর ছেলে হৃদয় ঘোষ পঞ্চায়েত নির্বাচনে নির্দল প্রার্থী ছিলেন। ওই ঘটনায় শাসক দলের মূল অভিযুক্তদের আড়াল করার অভিযোগ রয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে। ওই অভিযুক্ত তালিকাতেই নাম রয়েছে দাপুটে নেতা অনুব্রত মণ্ডলের। সাগরবাবু খুন হওয়ার ক’দিন আগেই ‘নির্দল প্রার্থীদের বাড়ি জ্বালিয়ে দিন’, ‘পুলিশকে বোমা মারুন’ বলে বক্তৃতা করেছিলেন অনুব্রত।
পাড়ুই তদন্তে সিট গঠনের পরেও অবশ্য অনুব্রত অধরাই থেকে যান। ধরা পড়েননি জেলা পরিষদের সভাপতি বিকাশ রায়চৌধুরীও। বিচারপতি দত্ত বারংবার পুলিশের ভূমিকা নিয়ে, সিট-এর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। অনুব্রত কেন অধরা জানতে চেয়েছেন। ১০ এপ্রিল বিচারপতি সরাসরি বলেছিলেন, “ওই ভদ্রলোক (অনুব্রত) মুখ্যমন্ত্রীর আশীর্বাদধন্য। এর পরে সিট কী করে তাঁকে গ্রেফতার করে?” ওই দিনই তিনি ডিজি-র ভূমিকা নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে সরকারি কৌঁসুলিকে রীতিমতো ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “ডিজি-র শাসনে কি আমরা নিরাপদ? ডিজি কি আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিতে চাইছেন?” বিচারপতির কাছে তিরস্কৃত হয়ে এবং আদালতে ডিজি-র হাজিরা আটকাতে মরিয়া হয়েই এর পর ডিভিশন বেঞ্চে যায় রাজ্য। এজলাস বদল এবং সুপ্রিম কোর্টের রায় সরকার পক্ষকে খানিকটা স্বস্তি দিয়েছিল। কিন্তু ডিভিশন বেঞ্চ যখন আবার মামলাটি দত্ত-এজলাসে পাঠায়, তখন রাজ্যের তরফে যথেষ্ট আপত্তি করা হয়।
এ দিন বিচারপতি টন্ডনও বুঝিয়ে দিলেন, সরকারের অস্বস্তির পালা মোটেই ফুরোয়নি। অনুব্রতর বিতর্কিত বক্তৃতার ভিডিও ক্লিপিং আগেই আদালতে জমা পড়েছে। বিচারপতি টন্ডনের প্রশ্ন, ওই ধরনের বক্তৃতার পরেও কেন পুলিশ অনুব্রতবাবুকে গ্রেফতার করেনি। রাজ্য সরকারই বা কেন কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। তিনি বলেন, “অনুব্রত মণ্ডল এবং বিকাশ রায়চৌধুরীকে পুলিশের গ্রেফতার করা উচিত ছিল। তাঁদের গ্রেফতার না করে পুলিশ ঠিক কাজ করেনি।”
এর উত্তরে এ দিন জিপি অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “কেউ যদি আক্রমণ করে, তা হলে তার ঘর জ্বালানো হবে বলে মন্তব্য করেছিলেন অনুব্রত মণ্ডল। গণমাধ্যম তা বাড়িয়ে প্রচার করেছে।” বিচারপতি জবাবে বলেন, “এগুলি সব আমার দেখা ও পড়া। কে কী বলেছেন, তা জানি।”
উপরন্তু বিচারপতি টন্ডন-ও জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি এই মামলায় আদালতে ডিজি-র হাজিরা চান। তিনি বলেন, “ডিজিকে এজলাসে ডাকা ভুল ছিল না। এই মামলায় ডিজি-কে ডেকে পাঠানো অত্যন্ত জরুরি ছিল।
জিপি এই সময়ে মন্তব্য করেন, “বিচারপতি দীপঙ্কর দত্তের রায় ছিল একপেশে।” তাঁর ওই মন্তব্যে ক্ষোভ প্রকাশ করে বিচারপতি টন্ডন বলেন, “আমি আশা করি, কখনও এক জন বিচারপতি সম্পর্কে এই ধরনের মন্তব্য করবেন না। এটা করা যায় না। সুপ্রিম কোর্টের এমনই নির্দেশ রয়েছে।”
জিপি জানান, প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ ডিজি-র হাজিরা খারিজ করে দিয়েছিল। বিচারপতি টন্ডন বলেন, “সেটা তো মাত্র তিন সপ্তাহের জন্য ছিল। ডিজি-কে ডাকা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।”
পাড়ুই মামলা নিয়ে এখনও পর্যন্ত হাইকোর্ট যে সব নির্দেশ দিয়েছে, তা পুরোপুরি মানা হয়েছে কি না, বিচারপতি টন্ডন সে সম্পর্কে জানতে চান। মানা না হয়ে থাকলে, কেন হয়নি, তা-ও জানতে চান তিনি। জিপি জানান, মামলার যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। বেশ কয়েক জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তদন্ত চলছে।
বিচারপতি জানান, তিনি আন্দামান যাচ্ছেন। ২ জুলাইয়ের মধ্যে রাজ্য সরকারকে হলফনামা দিয়ে জানাতে হবে, এফআইআরে যাঁদের নাম রয়েছে, তাঁদের সবাইকে ধরা করা গেল না কেন। ৭ জুলাই আবেদনকারী হলফনামার জবাব দেবেন। ৮ জুলাই মামলাটি ফের শুনানির জন্য উঠবে।
বিচারপতি দত্ত যে দিন অনুব্রত সম্পর্কে কড়া মন্তব্য করেছিলেন, সে দিন অনুব্রত বলেছিলেন, ‘‘আমি কি চুরি করেছি? ডাকাতি করেছি? সংবাদমাধ্যম সব বাড়িয়ে দেখাচ্ছে।” আশা প্রকাশ করেছিলেন, আইন আইনের পথেই চলবে। বিচারপতি টন্ডনও যে এ দিন ফের তাঁকে গ্রেফতার না করার কারণ জানতে চাইলেন, সে ব্যাপারে অনুব্রতবাবু অবশ্য কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
মামলাটি বিচারপতি দত্তের এজলাস থেকে সরে যাওয়ার সময় নিহত সাগরবাবুর ছেলে হৃদয় ঘোষ আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, অভিযুক্তেরা এতে আরও সাহস পেয়ে যাবে। এ দিন তিনি বলেন, “বিচারব্যবস্থার প্রতি আমার বরাবর আস্থা আছে। এ দিন বিচারপতির নির্দেশে আমরা আরও আশ্বস্ত হয়েছি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy