সারদা-কাণ্ডে প্রভাবশালীদের কাউকে ধরা না হলে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে আত্মহননের পথ বেছে নেবেন বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন কুণাল ঘোষ। তাঁর এক সময়ের ঘনিষ্ঠ সাংবাদিক এবং দলীয় সতীর্থ সত্যিই আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন বলে খবর পেয়ে শুক্রবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “যারা এত লোকের সঙ্গে প্রতারণা করেছে, তাদেরই সাধু সাজিয়ে দিচ্ছে সংবাদমাধ্যম! দুর্ভাগ্যজনক! যারা গরিব মানুষের পয়সা নিয়েছে, তারাই আজ মহাপুরুষ হয়েছে!”
কিছু দিন আগে এই কুণালকেই অবশ্য ‘চোর’ বলে মানতে আপত্তি ছিল মমতার! সারদা-কাণ্ডে দলের রাজ্যসভার সাংসদের নাম জড়িয়েছে দেখে আক্রমণাত্মক তৃণমূল নেত্রীর প্রথম যুক্তি ছিল, কুণাল সারদা গোষ্ঠীর সংবাদমাধ্যমে চাকরি করতেন শুধু। তাঁর কী দোষ? জল আরও গড়ানোর পরেও গত বছর ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে দলীয় বৈঠকে এবং কয়েক দিনের মধ্যে শ্যামবাজার ও পানিহাটিতে দু’টি জনসভায় মমতা বলেছিলেন, “কুণাল চোর? মদন চোর? মুকুল চোর? আমি চোর?”
বছর ঘুরে সেই কুণালের আত্মহত্যার চেষ্টা যখন তাঁর দল ও সরকারকে বিড়ম্বনায় ফেলছে, তখন সেই মমতাই ‘মহাপুরুষ’ বলে কটাক্ষ করে দায় ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করছেন! চোর-মহাপুরুষের এই পর্বান্তরের দিকেই ইঙ্গিত করে সিপিএমের এক বিধায়কের কটাক্ষ, “চুরিবিদ্যা তত ক্ষণই মহাবিদ্যা, যত ক্ষণ না পড়ছ ধরা! তৃণমূল নেতৃত্ব এটাই বুঝিয়ে চলেছেন!” তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতারও মন্তব্য, “বিধানসভায় জিতে আমাদের সরকার হওয়ার পরে প্রথম ব্রিগেড সমাবেশে কুণাল সঞ্চালক। আর আজ সেই কুণালের আত্মহত্যার চেষ্টায় সরকার হয়রান হয়ে যাচ্ছে!”
এমন অবশ্য এই প্রথম নয়। সদ্যই এমন প্রয়াস টের পেয়েছেন আসিফ খান। এক সময়ে সাদরে দলে নিয়ে আসিফকে উত্তরপ্রদেশে সংগঠনের পর্যবেক্ষক করেছিলেন তৃণমূল নেতৃত্ব। সারদা-কাণ্ড নিয়েই সেই আসিফ যেই সিবিআইয়ের কাছে তথ্য দিতে শুরু করলেন, প্রকাশ্যে তোপ দাগতে লাগলেন তৃণমূল নেতৃত্বের বিরুদ্ধে, তখনই তাঁর সঙ্গে দূরত্ব তৈরির চেষ্টায় নামে শাসক দল। তৃণমূল ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা করে আক্রমণ জারি-রাখা আসিফ আপাতত প্রতারণার অভিযোগে হাজতে। তৃণমূলের আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তুলে তাঁকে বলতে হচ্ছে, “রাম-সীতা ঘুরে বেড়াচ্ছে আর হনুমান হাজতে!”
একই ঘটনা রজত মজুমদারের গ্রেফতারির সময়েও। সারদা-কাণ্ডে এই প্রাক্তন পুলিশ-কর্তা এবং তৃণমূল নেতাকে সিবিআই গ্রেফতার করতেই রজতবাবুকে আর চিনতে পারছিলেন না শাসক দলের নেতারা! সুবিধামতো অবস্থান নেওয়ার এই কৌশলেরই অন্য এক পর্ব আবার দেখা গিয়েছে মুকুল-মদনকে নিয়ে। দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় এবং পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র যে ‘চোর’ নন, কুণালের সঙ্গে এক বাক্যেই গত বছর বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। সারদা-কাণ্ডে সিবিআইয়ের ফাঁস যত চেপে বসতে থাকল, মদন-মুকুলের সঙ্গে সাময়িক দূরত্ব তৈরি করে ফেললেন তৃণমূল নেত্রী। আবার পুরভোট যখন দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করল, সংগঠন দেখার তাগিদে, পরিবহণ ক্ষেত্রে সাংগঠনিক প্রভাব রক্ষার স্বার্থে মুকুল-মদনকে ফের কাছে টেনে নিলেন দলনেত্রী! কালীঘাটে দলীয় বৈঠকে বলে দিলেন, মদন-মুকুলকে গ্রেফতারের ষড়যন্ত্র হচ্ছে। তাঁরা অপরাধী, এ সব তিনি বিশ্বাস করেন না! দলনেত্রীর বরাভয় পেয়ে মুকুল আবার উঠে পড়লেন মমতার গাড়িতে, মদনের প্রত্যাবর্তন হল খোশ মেজাজে!
কুণালের ক্ষেত্রেও প্রয়োজন মতো নিজের অবস্থান বদলে নিয়েছেন মমতা। রাজ্য পুলিশের ‘সিট’ তাঁকে গ্রেফতার করার সময় থেকেই বোঝা গিয়েছিল, দলকে বাঁচানোর ‘বৃহত্তর স্বার্থে’ প্রয়োজনে কুণালকে বলি দিতে কুণ্ঠা করবেন না মমতা। সেই বৃত্তই যেন সম্পূর্ণ হল কুণালের আত্মহত্যার চেষ্টায়।
তবে কুণাল বারবার কিছু নাম বললেও সিবিআই কিন্তু এখনও রাজ্যের হাতেগোনা কয়েক জন প্রভাবশালী ব্যক্তি ছাড়া কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। যাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, তাঁরা অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবসায়িক সম্পর্কে সারদার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। অনেকেই বলছেন, সারদা কেলেঙ্কারিতে জড়িত প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নাম বলার জন্যই কুণাল বারবার আদালতের কাছে গোপন জবানবন্দি দিতে চাইছেন। কুণাল যে শাসক দলের প্রভাবশালী মন্ত্রী-নেতাদের নাম বলতে চাইছেন, সেটা আঁচ করছেন সিবিআইয়ের তদন্তকারীরাও। কিন্তু তাঁদের বক্তব্য, সারদা কেলেঙ্কারির বহু প্রামাণ্য নথিই তাঁরা হাতে পাননি। প্রাথমিক ভাবে রাজ্য পুলিশ তদন্ত শুরু করলেও পরবর্তী কালে সেই সব নথি কোথায় গিয়েছে, তা-ও তাঁরা জানেন না। ফলে শুধু কুণালের বয়ানের উপরে ভিত্তি করে তদন্ত এগোনো যে লাভজনক হবে না, তা কার্যত স্বীকার করে নিয়েছেন সিবিআইয়ের অনেক তদন্তকারীই। সিবিআইয়ের এক কর্তার কথায়, “সারদা কেলেঙ্কারির মতো আর্থিক অপরাধের তদন্তের মূল ভিত্তি নথিপত্র। সেটা ছাড়া কোনও অপরাধীকে ধরে লাভ হয় না।”
আপাতত এই বাস্তবের উপরে নির্ভর করেই কুণাল-কাণ্ডে হাত ধুয়ে ফেলছেন মমতা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy