Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Sher Shah Suri

ঐতিহাসিক সাসারামের অন্দরে...

১৮৮২ সালে ব্রিটিশ ভাইসরয় জর্জ ফ্রেডরিক সামুয়েল রবিনসনের এই সমাধিস্থলটির মেরামতি, গম্বুজের মূল স্থাপত্য টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

শেরশাহর সমাধি। ছবি: লেখক

শেরশাহর সমাধি। ছবি: লেখক

ড. আশিস ঘোষ হাজরা
শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৬:৩৮
Share: Save:

‘সাসারাম’ নামটা শুনলে প্রথমেই ছোটবেলায় ইতিহাস বইয়ে পড়া শেরশাহের কথা মনে পড়ে। তৎকালীন প্রজাদের সুবিধার্থে অনেক অভিনব পরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গে ১৫৪৫-এ নিজের সমাধিস্থলের নির্মাণ কার্যও শেরশাহ শুরু করেছিলেন। তিনি সমাধিস্থ হওয়ার তিন মাস পর তাঁর পুত্র সেলিম শাহ এই গম্বুজটির নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণ করেন। চারিদিকে সবুজে ঢাকা স্বচ্ছ জলের পরিখার কেন্দ্রে প্রস্তর নির্মিত সুদৃশ্য সমাধিস্থলটির নির্মাণ কৌশল আফগান স্থাপত্যের এক মহান নিদর্শন। ২২২ ফুট উঁচু গম্বুজের অন্দরে শেরশাহের পরিবারের সদস্যদের সমাধি পর পর বিন্যস্ত। আপাতদৃষ্টিতে সমাধিগুলি একই রকম দেখতে লাগলেও প্রত্যেকটি সমাধি একটি বিশেষ অলঙ্করণের দ্বারা অন্যগুলির থেকে পৃথক। সবুজ চাদরে আবৃত ইতিহাস বইয়ের সেই শেরশাহের সর্ববৃহৎ সমাধিটি এত বছর পরেও শিহরন জাগায়। ১৮৮২ সালে ব্রিটিশ ভাইসরয় জর্জ ফ্রেডরিক সামুয়েল রবিনসনের এই সমাধিস্থলটির মেরামতি, গম্বুজের মূল স্থাপত্য টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

এ বারের গন্তব্য তুতলা ভবানীর মন্দির। সাসারাম থেকে প্রায় ঘণ্টা দুয়েকের উঁচু নিচু অমসৃণ পথ পেরিয়ে পৌঁছলাম মন্দিরের পার্কিং পয়েন্টে। দূরে সবুজের মাঝে ব্যাসল্ট পাথরের খাড়া পাহাড়ে ও তার গা বেয়ে নেমে আসা শীর্ণ জলধারায় দৃষ্টিপথ রুদ্ধ হয়ে যায়। এখান থেকে প্রায় দু’কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের গায়ে মা তুতলা ভবানীর মন্দির। সূর্যের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে দু’পাশের ঝোপ ও বাঁদরদের বাঁদরামি দেখতে দেখতে বন্ধুর পথের শেষে পৌঁছলাম মন্দিরের কাছাকাছি। এখান থেকে দু’দিকে জালের রেলিং দেওয়া ঝুলন্ত ফুট ব্রিজে দুলতে দুলতে পাহাড়ের গায়ে অবস্থিত মন্দিরের দিকে এগিয়ে চললাম। দূর থেকে দেখা শীর্ণ জলধারা যথেষ্ট প্রশস্ত, উচ্ছল ও পাহাড়ের উপর থেকে কুণ্ডে এসে সশব্দ পড়ছে। এলোমেলো হাওয়ায় মাঝে মাঝে জলপ্রপাতের জলের নির্মল স্পর্শে সকলে আনন্দের সঙ্গে সিক্ত হচ্ছেন। কেউ বা আবার এই জলবিন্দুকে দেবী মায়ের চরণামৃত ভেবে পান করার আশায় হাঁ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। জলের ছাটে ভিজে যাওয়া পাহাড়ি সিঁড়ি ভেঙে অতি সাবধানে মন্দিরের প্রবেশ দ্বারে পৌঁছতেই হঠাৎ দমকা হাওয়ায় জলপ্রপাতের জলধারা দিক পরিবর্তন করে বৃষ্টির মতো মাথায় এসে পড়ে। দেবী মা যেন পুজোর পূর্বে স্নান করিয়ে নিলেন। সিক্ত বেশে মায়ের দর্শন সেরে একই পথে ফিরে এলাম। সবুজে ঘেরা ব্যাসল্টের খাড়া পাহাড়, উচ্ছল জলরাশি ও তার গর্জন, সঙ্গে মন্দিরের ঘণ্টা ও শঙ্খধ্বনি- প্রাকৃতিক ও আধ্যাত্মিক দর্শনের এই মেলবন্ধন সত্যিই বিরল।

সকাল ন’টায় শুরু হল কুণ্ড অভিযান। হাইওয়ে পেরিয়ে পাহাড়ি পাকদণ্ডী দিয়ে কিছুটা ওঠার পর লাল কাঁকুড়ে মাটির উঁচু-নিচু খানাখন্দে ভরা রাস্তায় দুলতে দুলতে প্রথমে থামলাম মানঝার বা মাঝের কুণ্ডে। কাই নদী থেকে স্বচ্ছ কাচের মতো জলধারা শীতল কুণ্ড হয়ে মাঝের কুণ্ডে বড় বড় পাথরের উপর থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে নীচে নামছে। পাথরগুলো সমতল ও প্রশস্ত হওয়ায় রুপোলি জলস্রোতের তীব্রতা হারিয়ে লাস্যময়ী ভঙ্গিতে নেমে আসার রূপ অনবদ্য। আর থাকতে না পেরে দ্রুত পোশাক বদলে পিচ্ছিল পাথরে পা টিপে টিপে গিয়ে কিছুক্ষণ জলে নাকানিচোবানি খেলাম। এখান থেকে উঠে ঝোপঝাড় পেরিয়ে কাই নদীর শীর্ণ সেতু অতিক্রম করে হাঁটা দিলাম ধোঁয়া কুণ্ডের দিকে। যত এগোচ্ছি ধোঁয়া কুণ্ডের জলরাশির গম্ভীর গর্জন কানে আসছে। পাহাড়ের গায়ে ঝুলন্ত শেরাওয়ালি মন্দিরে মাকে প্রণাম করে মন্দিরের পিছনে আসতেই দেখি দু’টি বলিষ্ঠ জলধারা মাঝের কুণ্ড থেকে চড়াই উতরাই পথে এসে ঝাঁপ দিচ্ছে গভীর কুণ্ডের মধ্যে। কিছুক্ষণের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম গলানো রুপোর ওই বাধাহীন ভাবে আকাশ বাতাস মুখরিত করে সশব্দ পতনের ছন্দে। বর্ষার সময় দু’টি ধারার বদলে ওই কুণ্ডের চারপাশ থেকে জলরাশি অজস্র ধারায় কুণ্ডে এসে পড়ে এবং রাশি রাশি জলবিন্দু নীচ থেকে উপরে উঠে আসে ধোঁয়ার মতো। তাই এর নাম ধোঁয়া কুণ্ড। কিছুক্ষণ ধোঁয়া কুণ্ডের অভূতপূর্ব রূপ উপভোগ করে ফিরে এলাম শীতল কুণ্ডে। এখানে কাই নদীর জল অপেক্ষাকৃত সমতল ভূমির উপর দিয়ে ধীরে ধীরে মাঝের কুণ্ডের দিকে নেমে যাচ্ছে। শীতল কুণ্ড, মাঝের কুণ্ড ও ধোঁয়া কুণ্ডের তিন রকম রূপ— শান্ত, উচ্ছল ও উদ্দাম অত্যন্ত বৈচিত্রপূর্ণ ও মনোমুগ্ধকর। ভাবছিলাম বর্ষার দু’মাস পরে যদি এই দৃশ্য হয়, তা হলে বর্ষার সময় পূর্ণ যৌবনা কুণ্ডগুলি কী অপূর্ব হবে।

সাসারাম যেমন শেরশাহের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক স্থান, তেমনই বৈচিত্রপূর্ণ জলপ্রপাতে ভরা এক সম্ভাবনাময় পর্যটন কেন্দ্র। এ ছাড়া যাঁরা অফরুট বাইক টুর বা ট্রেকিং পছন্দ করেন তাঁদের পক্ষে হতে পারে আদর্শ গন্তব্য।

অন্য বিষয়গুলি:

Sher Shah Suri Tomb Travel and Tourism
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy