নীল নির্জনে: লেক তাহোর বুকে
সেদিন আমার সারমেয় চিন্তামণিকে নিয়ে সান্ধ্যভ্রমণে বেরিয়ে মনে হল, অনেক দিন মারিয়ার হাতের হালাপেনো ব্রেড খাওয়া হয়নি। চলে গেলাম বাড়ির কাছে মেক্সিকান বেকারিতে। ছোট বেকারি, সব সময়ে তাজা পাউরুটির গন্ধে ম-ম করে। পৌঁছে দেখলাম নোটিস ঝোলানো, ‘অস্থায়ী ভাবে অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ’। মারিয়ার পরিবারের একমাত্র সম্বল এই বেকারি। আবারও বুঝলাম যে, এই অতিমারির প্রভাব কতটা গভীর। তাও এটা মে মাসের কথা।
দশ বছর আমি ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রান্সিসকোর বে এরিয়ার বাসিন্দা। এ অঞ্চলের একটি বড় অংশ বিখ্যাত ‘সিলিকন ভ্যালি’ হিসেবে। বিবাহসূত্রে বে এরিয়ায় এসে মুগ্ধ হয়েছিলাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও আবহাওয়ার বৈচিত্রে। এখানে এসেই জেনেছি ‘মাইক্রো-ক্লাইমেট’ কথাটি। শহরে যখন কাঠফাটা রোদ্দুর ও তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, তখন ট্রেনে চেপে ২০-৩০ মিনিটেই পৌঁছে যেতে পারেন শীতল সান ফ্রান্সিসকোয়। সেখানে তখন তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি!
সিলিকন ভ্যালিতে বহু ভারতীয় কর্মরত এবং তার একটি বড় অংশ বাঙালি। শহরটিকে চিনতে গেলে একটি আরামদায়ক জুতো পরে পায়ে হেঁটে ও বাসে করে ঘোরাই শ্রেয়। বে-র ধার বরাবর সোজা হেঁটে যান পিয়ার ৩৯, যেখানে সব সময়ে মেলার পরিবেশ। রাস্তায় হিপহপ মিউজ়িক চালিয়ে কেউ নাচছেন, পথশিল্পীরা আঁকছেন লাইভ পোর্ট্রেট বা বে-র দৃশ্য। এখানে পিয়ারের ধারের স্টল থেকে ক্ল্যাম চাউদার ও কালামারি খেতে ভুলবেন না। শহরের মধ্যে ঘুরে দেখুন ক্রুকেড স্ট্রিট, ক্যাস্ট্রো স্ট্রিট, ও চায়নাটাউন। বিকেলবেলায় গোল্ডেন গেট ব্রিজ থেকে সূর্যাস্তের নরম আলোয় এই ব্রিজের দৃশ্য অনিন্দ্যসুন্দর। ব্রিজের ওয়াকওয়ে ধরে হাঁটতে হাঁটতে প্রশান্ত মহাসাগর থেকে ঢুকে আসা উপসাগর, আলকাটরাজ ও এঞ্জেল দ্বীপের ছবি ভোলার নয়। পিয়ার থেকে ফেরি নিয়ে কয়েক ঘণ্টার জন্য ঘুরে আসা যায় দ্বীপগুলোয়। এখানকার দে ইয়ং মুসিয়াম-এ রয়েছে পিকাসো বা সালভাদোর দালির মতো শিল্পীদের অনবদ্য শিল্পকর্ম। সমকালীন শিল্পীদের কাজ দেখতে হলে ডাউনটাউনের গ্যালারিতে যেতে হবে।
যোগসূত্র: গোল্ডেন গেট ব্রিজ
ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে বে এরিয়া আশীর্বাদধন্য। এখানে শীতে তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রিতে নেমে যায়। বরফ ভাল লাগলে ৩ ঘণ্টার ড্রাইভে লেক তাহো। অসাধারণ অভিজ্ঞতা হয়েছিল যখন বাবা-মাকে নিয়ে ‘হেভেনলি গন্ডোলা’ চড়ে বরফে মোড়া পাহাড়চুড়োয় উঠেছিলাম। আড়াই মাইলের এই রোপওয়ে আপনাকে নিয়ে যাবে ৯,১২৩ ফুট উপরে স্কি রিসর্টে। সেখান থেকে দেখা যায় পান্না-রঙা লেক ও নীল আকাশের বুকে তুষার-ঢাকা পাহাড়ের স্বর্গীয় দৃশ্য।
বে এরিয়ার দক্ষিণে আছে গিলরয়। এখানকার গ্রীষ্মকালীন গার্লিক ফেস্টিভ্যালে খেয়েছিলাম রসুনের আইসক্রিম। এরিয়ার উত্তরে নাপা ভ্যালিতে ওয়াইন ট্রেনে চড়ে ওয়াইন টেস্টিংয়ের অভিজ্ঞতাও দারুণ। মাইলের পর মাইল জুড়ে আঙুরের খেত। সারা বছর পর্যটকরা আসেন ওয়াইন টেস্টিংয়ের জন্য। বে এরিয়ায় বেশ কয়েকটি রেডউড ফরেস্ট আছে, যার মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় মুইর উডস। এই নিস্তব্ধ জঙ্গলে ১২০০ বছর বয়সি রেডউড গাছগুলো গগনচুম্বী। আকাশকেও আড়াল করে রেখেছে ২৫০ থেকে ৩৭৯ ফুট উচ্চতার গাছগুলো। শোনা যায় কুলকুল করে বয়ে চলা ছোট নদীর শব্দ। রেডউড গাছের দীর্ঘায়ুর রহস্য হল, মোটা খোলসের জন্য দাবানলে ধ্বংস হয় না।
আপেক্ষিক আর্দ্রতার অভাবে গ্রীষ্মের শেষে বে এরিয়ার প্রান্তরের পর প্রান্তরে তৃণভূমি শুকিয়ে যায়। ঘন সবুজ পাহাড় তখন সোনালি বর্ণ ধারণ করে। সেই রূপের নিজস্ব সৌন্দর্য থাকলেও পাহাড়তলি তখন পরিণত হয় জতুগৃহে। বেশ কিছু দিন আগেই কয়েক সপ্তাহ ধরে এখানে মাইলের পর মাইল অঞ্চল দাবানলে জ্বলেছে। ইভ্যাকুয়েশনের আঁচ পড়েছে আমাদের পাশের পাড়াতেও। আকাশ ঘন ধোঁয়ার আস্তরণে আচ্ছন্ন। করোনার প্রকোপ ক্রমাগত বেড়ে চলায় মার্চের ১৬ তারিখ থেকে বে এরিয়ার অধিকাংশ কাউন্টি ‘শেল্টার ইন প্লেস’ নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু নিরাপদ সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে মাস্ক পরে হাঁটতে বেরোলে বিধিনিষেধ নেই।
এরই মধ্যে একদিন বিকেলের আমার সদাশান্ত সারমেয় কন্যা জানালার দিকে তাকিয়ে বেজায় চিৎকার। দেখি বাড়ির পিছনেই ঘুরছে একজোড়া হিংস্র কোয়োটি। পাহাড়ে যখন আগুন আর শহর জনমানবশূন্য, তখন এই জঙ্গলের প্রাণীগুলি নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে চলে আসছে আমাদের খুব কাছাকাছি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy