স্বর্ণশস্য: জ়িরো উপত্যকায় পাকা ধান
ভ্রমণের পরিকল্পনা শুরু করতেই এক বন্ধু বলল, ‘‘যা, শূন্যে ঘুরে আয়।’’ ভেবেছিলাম, নিছক মজা। কিন্তু ইন্টারনেট জানাল, সত্যি সত্যি শূন্যে ঘুরে আসা যায়! জায়গাটি অরুণাচল প্রদেশের জ়িরো ভ্যালি। প্রাচীন জনজাতি আপাতানি অধ্যুষিত এই অঞ্চলকে ইউনেসকো ‘ওয়র্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ হিসেবে শর্টলিস্ট করেছে। প্রকৃতি এখানে অকৃপণ, অপরূপা। কলকাতা থেকে ইটানগর পৌঁছে সেখান থেকে শেয়ার জিপে জ়িরো ১১৫ কিলোমিটার।
সময়টা অক্টোবর। পুজোর ছুটি। গন্তব্যে পৌঁছে চায়ে চুমুক দিতেই হোটেলের ম্যানেজার হাসি হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘ঠাকুর দেখতে যাবেন নাকি?’’ এই অঞ্চলে দুর্গাপুজো! বিস্ময় কাটালেন তিনি। জানালেন, বহু বছর আগে কোচবিহার থেকে কয়েকজন ব্যবসায়ী এখানে আসেন। তাঁরাই শুরু করেন পুজো। সোয়েটার, চাদর জড়িয়ে পুজোমণ্ডপে পৌঁছে দেখি আলো ঝলমলে বিরাট মণ্ডপ। তার বাইরে জিলিপি, বাদাম, নাগরদোলা, বেলুনওয়ালা... জমজমাট মেলা। বাঙালি কর্মকর্তারা হঠাৎ নতুন অতিথি পেয়ে না খাইয়ে ছাড়লেন না। তাঁরা জানালেন, এখানে সব ধর্মের মানুষই চাঁদা দিয়ে মিলেমিশে এই পুজো করেন।
পরের দিন বেরিয়ে পড়লাম গাড়ি নিয়ে। কিছু দূর যেতেই চোখে পড়ল রাস্তার দু’ধারে সোনার ফসল! পাহাড়ের পাদদেশে পাকা ধান, উপরে নীল আকাশ, সাদা মেঘ। এমন ল্যান্ডস্কেপ বাধ্য করল বারবার গাড়ি থামিয়ে ক্যামেরায় চোখ রাখতে। অক্টোবরে জ়িরোতে হারভেস্টিং সেরেমনি দেখার মতো। ধান রোপণ থেকে ধান কাটা, আপাতানিদের কাছে পুরোটাই একটা উৎসব। ধান রোপণের সময় ওই জমিতে মাছ চাষও হয়। এই দ্বৈত পদ্ধতির আবিষ্কারক আপাতানিরাই!
যেতে যেতে দেখি, ধান খেতের পাশে ছাতার তলায় বসে কয়েকজন সুবেশ মহিলা ও পুরুষ খাওয়াদাওয়া করছেন। কাছাকাছির মধ্যে কয়েকটা গাড়িও দাঁড়িয়ে। এমন আবহাওয়ায় পিকনিকই তো জমে! ভুল ভাঙালেন গাড়ির চালক। পিকনিক নয়, ধান কাটার ফাঁকে বিশ্রাম নিচ্ছেন ওঁরা! নিজেদের গাড়ি নিয়ে এসেছেন। এমন দৃশ্য দেখার অভিজ্ঞতা নেই। গাড়ি থামাতেই হল। নামতেই ওঁরা ডেকে নিলেন। এগিয়ে দিলেন কাস্তে। দেখিয়ে দিলেন, কী ভাবে ধান কেটে বাঁশের লম্বা ঝুড়িতে ধান ঝাড়তে হয়। মিশে গেলাম ওঁদের সঙ্গে। আপাতানি মহিলাদের থুতনি ও কপালে উল্কি। নাকের দু’দিকে বড় বড় নাকছাবি। তাঁদের এই সাজের পিছনে আছে ইতিহাস। কয়েকশো বছর আগে সুন্দরী আপাতানিদের অপহরণ করে নিয়ে যেত দস্যুরা। তাই এমন সাজে নিজেদের কুরূপা করে ফেলেন তাঁরা। সেই প্রথাই চলে আসছে। এখন অবশ্য বয়স্কদেরই এই সাজে দেখা যায়। অধিকাংশ আধুনিক আপাতানি মেয়েরা স্বচ্ছন্দ পশ্চিমি ফ্যাশনে। মুখে রুমাল বেঁধে, হাতে গ্লাভস পরে তাঁরা চাষ করেন। ওঁদের মধ্যে অনেকেই বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদে চাকরি করেন। এ সময়ে সকলেই ছুটি নিয়ে চলে আসেন ধান কাটতে। মুঠোভর্তি বিস্কিট আর একরাশ আনন্দ নিয়ে বাঁশ, পাইনের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে আবার এগিয়ে চলা।
একে একে দেখা হল ওল্ড জ়িরোর হিজ়া, দত্তা, বুলা, হং... আপাতানি গ্রামগুলো। এমনই এক গ্রামে পরিচয় হল আপাতানি যুবক জেমসের সঙ্গে। সাদরে নিয়ে গেলেন তাঁর বাঁশের তৈরি বাড়িতে। তখন জেমসের বৃদ্ধা মা কাঠের উনুনের ধারে বসে আগুন পোহাচ্ছেন। আলাপ হল। শুরু হল আড্ডা। জানলাম, ‘জ়িরো’ নামকরণ ইন্দিরা গাঁধীর। স্যাটেলাইট থেকে এই অঞ্চলটাকে এক্কেবারে গোল দেখায়, তাই। অরুণাচলের সবচেয়ে বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে এখানেই। প্রতি বছর সেপ্টেম্বরে হয় জ়িরো মিউজ়িক ফেস্টিভ্যাল! পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সঙ্গীতপ্রেমীরা ভিড় করেন তখন। এখানে চুরির ভয় নেই। তাই দরজা খোলা রেখে, সকলে মাঠে চলে যান। এমন অনেক কথার ফাঁকে এল ব্যাম্বু চিকেন ও ঘরে তৈরি রাইস বিয়ার। শুধু ধানে-মাছে নয়, আড্ডার দিক থেকেও এঁরা বাঙালির জাতভাই!
আরও দুটো দিন গেল হাপলি, ট্যালে ভ্যালি, কার্দো জঙ্গল দেখতে। জ়িরো থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে ট্যালে অভয়ারণ্য। কপাল ভাল থাকলে দেখা মেলে ক্লাউড লেপার্ডের। সারা দিন কেটে গেল মিনিভেট, নীলতাভা, ক্রসবিল... পাখিদের খোঁজে। গভীর কার্দো জঙ্গলের মাঝে আছে ২৫ ফুট লম্বা শিবলিঙ্গ। সে এক অদ্ভুত পরিবেশ।
এই ঘোরাঘুরির মাঝে বারবার চোখে পড়েছে কিউয়ি খেত। ফেরার পথে প্রায় জলের দরেই ব্যাগ বোঝাই করে কিউয়ি নিতে ভুলিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy