Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
রাবণ রাজার দেশে
Travel

পাহাড়, চা বাগান, ঝর্না আর সমুদ্র... হাতছানি দেয় শ্রীলঙ্কা

এয়ারপোর্ট থেকে ক্যান্ডির দূরত্ব ১০০ কিলোমিটারের কিছু বেশি। আশ্চর্য যে, সিগন্যাল বা ট্রাফিক পুলিশের বালাই নেই।

জলছবি: শ্রীলঙ্কার ক্যান্ডিতে মিশে গিয়েছে আকাশ ও জলরাশি

জলছবি: শ্রীলঙ্কার ক্যান্ডিতে মিশে গিয়েছে আকাশ ও জলরাশি

সোহিনী দাস
শেষ আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

তার পরে শীতের কমলালেবু রোদ্দুরমাখা শহরটাকে মাটিতে রেখে হুশ করে উড়ে গেল প্লেনটা। ক্রমশ আরও ছোট পুতুলের ঘর। এখন শুধুই মেঘ। আরও পরে সূর্য ছুঁয়ে নেমে আসা— সমুদ্র, পাহাড় আর নারকেল গাছে ঘেরা ছোট্ট জনপদ।

আমরা এখন রাবণ রাজার দেশে। বন্দরনায়েক এয়ারপোর্ট ছাড়তেই চড়া রোদের সঙ্গে সাইনবোর্ড হাতে স্বাগত জানালেন সফরসঙ্গী কান্নান, একাধারে সারথি ও গাইড। ব্যস্ত শহর ছেড়ে ছুটল গাড়ি। প্রথম গন্তব্য ক্যান্ডি।

এয়ারপোর্ট থেকে ক্যান্ডির দূরত্ব ১০০ কিলোমিটারের কিছু বেশি। আশ্চর্য যে, সিগন্যাল বা ট্রাফিক পুলিশের বালাই নেই। রাস্তায় আঁকা সাঙ্কেতিক নিয়ম মেনে দিব্যি ছোটে অজস্র গাড়ি। পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধে গড়ায়। গাড়ি পৌঁছল নেচার রিসর্টে।

পরদিন ভোর থাকতে বেরিয়ে পড়া। রিসর্টের ভিতরে বিশাল জঙ্গল। নানা পাখির আশ্চর্য মেলা। এখানকার ছাতারে পাখির শিস মিষ্টি। আমাদের দেশের মতো ঝগড়ুটে নয় তারা...

ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়া হল রাবণ সাম্রাজ্য পরিদর্শনে। রাবণের থেকেও এ রাজ্যে গৌতম বুদ্ধের জনপ্রিয়তা ঢের বেশি। মোড়ে মোড়ে ঢাউস ঢাউস বুদ্ধমূর্তি।

পথেই পড়ল সুবিশাল টুথ রেলিক টেম্পল। শ্রীলঙ্কার অন্যতম পবিত্র ধর্মস্থান। গৌতম বুদ্ধের দাঁত এনে এই মন্দিরে স্থাপন করেছিলেন রাজকন্যা হেমামালী ও তার স্বামী যুবরাজ দন্ত। তার পরে কত যুদ্ধ! বিদেশি শক্তির লাল চোখ দেখেছে এই মাটি, তার চিহ্ন রয়েছে মন্দিরের আনাচকানাচে। রয়েছে তথাগতের বোধিবৃক্ষও। ইতিহাস বাদ দিলেও ভারী সুন্দর, নিপুণ ভাস্কর্যের সাক্ষী এই মন্দির।

সেখান থেকে মাত্র ন’মিনিট দূরেই পেরাডেনিয়ার রয়্যাল বটানিক্যাল গার্ডেন। প্রায় ১৪৭ একর জায়গা জুড়ে এই বাগানে রয়েছে তিনশোরও বেশি অর্কিড, অসংখ্য গাছ— সে এক সমারোহ। কতক্ষণ যে সেখানে কাটল!

পরদিন ভোরে ক্যান্ডি ছেড়ে গাড়ি ছুটল নুয়েরাএলিয়ার দিকে। ভেলভেটের মতো চা বাগান ঘেরা পাকদণ্ডী পথ। দারুণ সুন্দর একটা ভিউ পয়েন্টে গাড়ি থামল। পাহাড়, ঝর্না আর চা বাগানের অদ্ভুত প্যানোরমিক ভিউ। রাস্তাতেই পড়ল রামবোডা ফলস। উঁচু পাহাড়ের মাথা থেকে লাফিয়ে নামছে জলরাশি। সেখান থেকে গেলাম টি এস্টেটে। কত রকমের চা যে এখানে মেলে! চা তৈরির কারখানাও ঘুরে দেখলাম।

সবুজস্নাত: নুয়েরাএলিয়ার চা বাগান

শৈলশহর নুয়েরাএলিয়াকে ‘লিটল ইংল্যান্ড’ বলা হয়। যে দিকে তাকানো যায় উঁকি মারছে পাহাড়, পাহাড়ের গা বেয়ে নামছে ঝর্না। পরের দিন ভোরে দেখি হিম ঠান্ডা। সঙ্গে বৃষ্টি। পাশেই রেস কোর্স। একটু এগিয়ে ছোট মনাস্ট্রি। ওটাই আবার বাচ্চাদের স্কুল। শীত গায়ে মেখে স্কুলে যাচ্ছে একদল শিশু। প্রথম গন্তব্য সীতাএলিয়া। খাস রাবণসাম্রাজ্য। শোনা যায়, হরণের পরে সীতাকে এখানেই রেখে যান লঙ্কেশ্বর। ছোট্ট মন্দিরে লাফালাফি করছে অসংখ্য বানরসেনা। পাহাড়ি জঙ্গল থেকে উপচে পড়ছে ঝর্না, নীচে নদী। অশোকবনে থাকাকালীন এখানেই নাকি স্নান সারতেন সীতা। রয়েছে হনুমানের সুবিশাল পায়ের ছাপও।

এর পরে গ্রেগরি লেকে নৌকাবিহার। বৃষ্টি বাড়ছে, সঙ্গে ঠান্ডা হাওয়া। জলে তৈরি হচ্ছে রূপকথা। ভিনদেশি কন্যার আবদার রেখে হ্রদ থেকে শাপলা ছিনিয়ে এনে হার বানিয়ে দিলেন মাঝি। মুগ্ধতা ছাড়া আর কী-ই বা দেওয়ার থাকে এ দেশকে!

বোটিং সেরে স্থানীয় বাজার ঘুরে দেখলাম। কাছেই ভিক্টোরিয়া গার্ডেন— ঈশ্বরের সাজানো বাগান যেন! বিকেল কাটল সেখানেই।

পরের দিন সকাল সকাল নুয়েরাএলিয়া ছাড়লাম। তৃতীয় স্টপ বেনটোটা। রাস্তাতেই পিনাওয়ালা এলিফ্যান্ট অরফ্যানেজ। রোদ্দুরমাখা তিরতিরে নদীর বুকে ৫০-৬০ খানা হাতির একসঙ্গে স্নান! বেনটোটা পৌঁছতে রাত গড়াল। সাজানো হোটেলের ঘরেও কানে এল গর্জন। পরদিন ঘুম ভেঙেই ছুটলাম উৎসের দিকে। ঘরের বাইরেই দাঁড়িয়ে সমুদ্র। স্বচ্ছ আয়নার মতো নীল জলে নিজেকে চিনি। এ ‘বিপুল তরঙ্গ’, এই নিরন্তর বহমানতার কাছে নতজানু হই।

হাতিদের স্নান: পিনাওয়ালা এলিফ্যান্ট অরফ্যানেজে

প্রাতরাশ সেরে গেলাম মাডু নদীর ধারে। ম্যানগ্রোভে ঘেরা, মধ্যে মধ্যে জেগে এক-একটি দ্বীপ। কোনওটা সাপেদের রাজ্য, আর কোনওটা কবিতার সেই দারুচিনি দ্বীপ। দু’-একটি পরিবারের বাস। জীবিকা দারুচিনি উৎপাদন। পুরো প্রক্রিয়াটি বুঝিয়ে বললেন এক বৃদ্ধা। মাথার উপর ঘাই মারছে শঙ্খচিল।

একটি টার্টল হ্যাচারি ঘুরে দেখলাম। পিছনেই অকল্পনীয় এক সৈকত। ছোট ছোট টিলা আর নারকেল গাছে ঘেরা স্বপ্ন যেন। চিকচিকে রোদ্দুরে সাদা ডানা ছড়িয়ে দিয়েছে সিগালের দল। বালির উপরে ছুটে বেড়াচ্ছে কাঁকড়া। বিকেলটা কাটল হালকা বৃষ্টি আর সমুদ্রের লোনা হাওয়ার সঙ্গে। রাতে টাটকা চিংড়ি সহযোগে সুস্বাদু নৈশাহার।

হাতে আর মাত্র একদিন। অথঃ সমুদ্রকথা সেরে কলম্বো পৌঁছলাম। সাজানো গোছানো বাণিজ্য শহর। ঘুরে দেখলাম ন্যাশনাল মিউজ়িয়াম। সময় কম, তাই গাড়ি থেকেই দেখতে হল গল ফেস গ্রিন, মার্কিন আদলে তৈরি টুইন ওয়র্ল্ড ট্রেড সেন্টার... আরও কত কী। উচ্ছ্বাসের রাত পেরিয়ে খুব ভোরে সারথি ফের পৌঁছে দিয়ে গেেলন বিমানবন্দরে।

অনেক দিন ঘরছাড়া। আচ্ছা, কেমন আছে আমার শহর কলকাতা?

অন্য বিষয়গুলি:

Travel Tourism Sri Lanka
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy