নৈসর্গিক: যাওয়ার পথে এই জায়গাটার নাম বাঞ্জা লুকা। ছবি: কৃষ্ণেন্দু বসু
পাহাড়ি রাস্তা। গাড়ি চলছে শামুকের গতিতে। এক পাশে জঙ্গল, অন্য দিকে পাহাড়। ঘুটঘুটে অন্ধকার। গাড়ির আলো সেই আঁধার ভেদ করতে পারে না। হার্ট অব ডার্কনেস ছুঁয়ে দেখার জন্য গাড়িটা থামাতে বললাম। তবে গুনে গুনে ৩০ সেকেন্ড। শহুরে আলোয় অভ্যস্ত চোখ তার বেশি সহ্য করতে পারল না। গাড়িতে উঠে পড়লাম। তখনও সিপোভো গ্রামে পৌঁছতে বাকি ৭৫ কিলোমিটার।
ওই গ্রামে যাওয়ার কথা ছিল না। আসলে আমাদের প্ল্যানে বসনিয়াই ছিল না। ক্রোয়েশিয়ায় ঘুরতে এসেছিলাম চার বন্ধু। এখানকার একটি শহর থেকে অন্য শহরে যেতে মাঝের ৯ কিলোমিটার রাস্তা পড়ে বসনিয়ার অধীনে। জাগরেব (ক্রোয়েশিয়ার রাজধানী) থেকে ডুবরোভনিক গাড়িতে গিয়েছিলাম, বসনিয়ার সীমানা পেরিয়ে। ফেরার পথে ভাবলাম, বসনিয়ার ভিতর দিয়ে গেলে কেমন হয়? ঘুরপথে বসনিয়ায় ঢুকতেই অভিবাসন দফতরের অফিসাররা জানালেন, গাড়ি রেখে যেতে হবে। গাড়ির ইনশিয়োরেন্স শুধু ক্রোয়েশিয়ায় বৈধ। লাগেজ নিয়ে ওখানে পৌঁছব কী করে? ‘‘হিচ হাইকিং,’’ উপায় বললেন অফিসার।
অন্যের গাড়িতে লিফ্ট চেয়ে চেয়ে যাওয়াকে বলে হিচ হাইকিং। হলিউড সিনেমা দেখে ব্যাপারটা ভালই জানতাম। তবে জানা আর হাতেনাতে করা এক নয়। তখন বেলা বারোটা। হাইওয়েতে দাঁড়িয়ে আছি। কালেভদ্রে দু’-তিনটে গাড়ি যাচ্ছে। সহৃদয় কেউ যদি বা দাঁড়াচ্ছেন, চার জনের জায়গা হবে না বলে হনহনিয়ে চলে যাচ্ছেন। প্রায় দু’ঘণ্টা দাঁড়ানোর পরে একটি বড় গাড়িতে আমাদের ঠাঁই হল।
চালক ৪০০ কিলোমিটার পর্যন্ত যেতে রাজি হলেন। আরও ৪০০ কিলোমিটার পেরোলে গন্তব্য। আমার দেশের উত্তর-পূর্বের প্রত্যন্ত গ্রামের মতো এখানকার রাস্তা। মানুষ খুঁজে পাওয়াও দুষ্কর। একটা রেস্তরাঁ থেকে খাবার কিনে ডিকিতে রাখতে গিয়ে বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। কুঠার, আরও নানা যন্ত্রপাতিতে ভর্তি ডিকি। হলিউড ভরসা দেয়, ভয়ও দেখায়। লোকটার কোনও অসৎ উদ্দেশ্য নেই তো? আমি চালকের পাশের সিটে। বন্ধুদের হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করলাম। তবে ক্লাইম্যাক্সে যবনিকা পতন! বিকেল গড়াতে গড়াতে যথাস্থানে চালক আমাদের পৌঁছে দিলেন।
আশার গন্তব্য: সেই সিপোভো গ্রাম, যার উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল বন্ধুর দল। এখান থেকে বেরিয়ে ক্রোয়েশিয়ার গাড়ি ধরা হয়েছিল
এর পরের গাড়ির চালক এক বৃদ্ধ। গ্রামের নাম শুনে বললেন, ওই দিকেই যাচ্ছেন। যেতে যেতে বলছিলেন, হিচ হাইকিংয়ের চল এখানে খুব পুরনো। তবে এখন অনেক কমে গিয়েছে। রোজগারের অভাবে গাড়ি চুরির প্রবণতা বেড়েছে। কৌতূহলবশত জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, ‘‘আমাদের লিফ্ট দিলেন কেন?’’ বললেন, ‘‘তোমাদের চুলের-চামড়ার রং দেখে স্পষ্ট, তোমরা এখানকার নও। তাই গাড়ি নিয়েও কিছু করতে পারবে না।’’ যে স্পিডে ভদ্রলোক চালাচ্ছিলেন, রাত ন’টাতেও গ্রামে পৌঁছব কি না, সন্দেহ ছিল! পাহাড়ি রাস্তা, একটা ল্যাম্পপোস্ট নেই। রাস্তায় দ্বিতীয় কোনও গাড়িও নেই।
আমার জন্য এক বার ভুল পথেও গিয়েছিলেন। রেগে গিয়ে চালকের জেদ, আর গাড়ি চালাবেন না। অগত্যা এক বন্ধুই হাল ধরল। ভদ্রলোক যদি শামুকের গতিতে চালান, আমার বন্ধু পাহাড়ি রাস্তায় ছোটাচ্ছিল রেস কার। ঠাকুরের নাম করে রাত দশটা নাগাদ পৌঁছলাম একটি পেট্রোল পাম্পের কাছে। একটি ক্যাফেতে ঢুকতেই কয়েক জোড়া বিস্ফারিত চোখ আমাদের আপাদমস্তক দেখতে লাগল। ‘‘কোথা থেকে?’’ ইন্ডিয়া বললে খুশি হবেন কি না বুঝতে না পেরে বললাম, ‘‘ইন্ডিয়ান, কিন্তু ক্রোয়েশিয়ায় থাকি।’’ ‘‘ইন্দিরা গাঁধী?’’ শুনে সাহস পেলাম।
কাদামাখা রাস্তায় গাড়ির দুলুনি। পৌঁছলাম সিপোভোর কাছে। ধু ধু প্রান্তরে একটা কটেজ। ওখানেই আমাদের অপরিকল্পিত রাত্রিবাস।
পুকুর থেকে ধরা মাছ, ব্রেড, ঘরে তৈরি পানীয়... আতিথেয়তায় ত্রুটি ছিল না। পরদিন লাঞ্চ না খাইয়ে দম্পতি ছাড়বেন না। আবার কি হিচ হাইকিং না টাকা দিয়ে গাড়ি? দ্বিতীয়টাই শ্রেয়। তবে সে দিন ছিল ইস্টার। গ্রামের কাছেপিঠে কেউ নেই। অ্যাডভেঞ্চার হওয়ারই ছিল।
রাস্তা পেরিয়ে আমার বান্ধবী খাবার কিনতে যাচ্ছিল দোকানে। তখনই একটি গাড়ি প্রায় ধাক্কা দিতে দিতে স্লো হয়ে যায়। বান্ধবী ‘উফ কী লাগল’ বলে চেঁচাতে শুরু করল। আমরাও সুযোগটা লুফে নিলাম। ‘‘ডাক্তারখানা কোথায়? নিয়ে যেতে হবে।’’ চালক জানালেন, তিনি ক্রোয়েশিয়ার লোক। ‘‘ওহ! আমরাও ওখানেই যাব,’’ শুনে তুলে নিলেন।
শহরের কাছে পৌঁছতেই চোখ আটকে গেল দূরে। ওই পাহাড়-জঙ্গল-আঁধারে মোড়া বসনিয়া। আর এ দিকে আলোর ঝলকানি, জনবসতি, দোকানপাট... হাতছানি ক্রোয়েশিয়ার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy