ঘরের ভিতর থেকেই চোখের সামনে কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয়। —নিজস্ব চিত্র।
অজানা বাঁকের হাতছানি। উড়ে আসা মেঘ। দিগন্তে কাঞ্চন। পাইনের জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়ার ডাক। পাহাড় যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছিল।
ট্রেনের টিকিট কাটায় শুরু। মাঝের চার মাস যেন অন্তহীন প্রতীক্ষা। অবশেষে ট্রেন শিয়ালদহ ছাড়তেই যেন মুক্তি। গতানুগতিকতার রোজকার রুটিন গঙ্গার ওপারে ফেলে আসা। ট্রেনের দুলুনিতে পাহাড়ের আবেশ আনা।
ঘণ্টা দেড়েকের লেটে কী এসে যায়! এনজেপি, শিলিগুড়ি, সেবক হয়ে কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস ঠিক একসময় সেঁধিয়ে গেল ঘন জঙ্গলে। তিস্তা পেরনোর সময় এক ঝলক দেখা দিল করোনেশন ব্রিজ। তারপর এক টুকরো জঙ্গল সাফারি। যা আনল রোমাঞ্চ। ক্যামেরা হাতে চলে এলাম দরজায়। ওই তো চা-বাগান, সরু ঝোরা, পায়ে চলা গহন পথ, সবুজের সমারোহ। জঙ্গলের কিনারায় চোখে পড়ল ময়ূরের রোদ পোহানো। সিগন্যালে ট্রেন দাঁড়িয়ে অনেক ক্ষণ, বিরক্তি মুছিয়ে দিল পাহাড়ের ক্যানভাসে গুলমা নামের এক ছোট্ট স্টেশন। রেললাইন ক্রমশ বাঁক খেয়ে ঢুকে পড়েছে অরণ্যে। সামনে-পিছনে ট্রেনের বগিগুলো সেই বাঁকেরই অংশ হয়ে উঠল। ট্রেন ডামডিম পেরোতেই মালপত্র নিয়ে দরজায় লাইন। নিউ মাল হল ডুয়ার্সের প্রবেশদ্বার। অধিকাংশ ডুয়ার্স যাত্রীর গন্তব্য এটাই। অথচ, ট্রেন থামে মিনিট দুয়েকের জন্য। লাগেজ নিয়ে নামতে হুড়োহুড়ি তো হবেই।
নিস্তরঙ্গ অবসরের দুর্দান্ত ঠিকানা কাফের। —নিজস্ব চিত্র।
ড্রাইভার নিমা অবশ্য ডুয়ার্স নয়, ওদলাবাড়ি-বাগরাকোট হয়ে ধরল লোলেগাঁওয়ের রাস্তা। ঘিস নদীর ব্রিজ পেরিয়ে পাহাড়ি পথে পাক খেয়ে ক্রমশ উঠতে থাকলাম উপরে। ঝকঝকে রোদ। পাহাড় যেন সত্যিই খিলখিলিয়ে হাসছে।
একসময় বাঁ দিকে চারখোলের রাস্তা রেখে আমরা ধরলাম জঙ্গুলে পথ, এবড়ো-খেবড়ো, পাথরে ভর্তি। তার উপর রাস্তা বড় করার জন্য চলছে গাছ কাটা। যা ডাঁই করে ফেলা রয়েছে পথে। পাথর-কাদা-গাছ মিশে কোথাও কোথাও বেশ পিচ্ছিল হয়েছে যাত্রাপথ। লাফাতে লাফাতে একসময় পৌঁছলাম লোলেগাঁও। স্বস্তি। অবশেষে মিলল চকচকে মসৃণ রাস্তা।
কে জানত, কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফের ঢুকে পড়ব ঘন জঙ্গলের গহীনে। যে রাস্তা, নিমার ভাষায়, ‘ড্যান্সিং, ডেঞ্জারাস।’ কোমর-পিঠ তত ক্ষণে সবারই বিদ্রোহ ঘোষণা করে দিয়েছে। নিমা একসময় দিল ভরসা। বেশি নয়, পৌঁছতে আর লাগবে বড়জোর মিনিট পাঁচেক। যদিও মিনিট দশেক পরেই চোখের সামনে আচমকা ঘটল ভোজবাজি। পাইন, ফার, শালের ঘন জঙ্গল হঠাৎই ভ্যানিশ। হাজির ছোট্ট একটা গ্রাম। এটাই কাফের!
ফুলের বাহার মন ভরাবেই। —নিজস্ব চিত্র।
লেপচা ভাষায় লোলেগাঁওকেই ডাকা হয় এই নামে। আবার কাফের নামে ৫২০০ ফুট উচ্চতায় এটা খুদে একটা গ্রামও। যাতে ঘরের সংখ্যা মোটে ৩১। থাকেন সাকুল্যে দেড়শো জন। শুনলাম, বরফ না পড়লেও শীতকালে এখানে তাপমাত্রা কখনও কখনও নেমে যায় হিমাঙ্কের হাতছোঁয়া দূরত্বে।
গাড়ি থেকে নামতেই টের পেলাম হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডা। জানলাম, এখনই পাঁচ ডিগ্রি। রাতে আরও কমার আশঙ্কা। এতটা কনকনে শীত আন্দাজ ছিল না, তড়িঘড়ি চাপাতে হল সোয়েটার। কাঁপতে কাঁপতেই ঢুকে পড়লাম অসামান্য কটেজে। ছবিতে দেখেই পছন্দ হয়ে গিয়েছিল বেগুনি রঙের চোঙার মতো কাঠের কটেজগুলো। কটেজে ঢুকে মন ভরে গেল। কাঠের ঘর। বিছানার এক পাশে জানলার খাঁজ কেটে ধাপের মতো জায়গা। পশ্চিমের জানলা দিয়ে পড়ন্ত বিকেলে উঁকি মারছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। শুয়ে শুয়ে তাকালেই চলবে! অবশ্য তাতেও স্যাঁতসেঁতে লাগছে বিছানা। জোড়া কম্বলের ওম যেন ডাকছে।
বিশ্রাম নয়, সবার আগে দরকার পেটপুজো। পৌঁছেছি দুপুর সাড়ে তিনটে নাগাদ। টুকটাক যা পড়েছে পেটে, তা কখন হজম। ছুঁচোয় ডন দিচ্ছে যেন। কিন্তু লাঞ্চ পরে, আগে সুনীল তামাং ও তাঁর পরিবার জানাবেন ‘ওয়েলকাম’। এটাই প্রথা। ডাইনিং হলের মধ্যেই আন্তরিকতার সঙ্গে গলায় খাদা পরানো হল সবাইকে।
ঘরের জানলা দিয়েই ঘুমন্ত বুদ্ধের লালচে, গোলাপি থেকে সাদায় রূপান্তর দৃশ্যমান। কোনও তথাকথিত ‘স্পট’-এ যাওয়ার দরকারই নেই। ঘরের সামনেই লন। বাহারি সব গাছ। রঙিন ছাতাওয়ালা টেবিল। সঙ্গে কয়েকটা চেয়ার। ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার ব্যবস্থা। উঠোনের অন্যপাশে ডাইনিং হল। তার উপরে প্রার্থনার জায়গা। নীচে থাকার ব্যবস্থাও রয়েছে।
নিভৃতে থাকার ঠিকানা। —নিজস্ব চিত্র।
এখানে সবাই থাকেন পাশাপাশি, বিপদেআপদে একসঙ্গে। এমনকি, খাওয়াদাওয়ার পরে দুপুর তিনটে নাগাদ সবাই মিলে একসঙ্গে গল্প করতে করতে চলে চা-পান। আবহাওয়া, পরিবেশ প্রতিকূল বলেই এই একতা মন ভাল করবে।
চাইলে এখান থেকে সাইটসিয়িংয়ে বেরিয়ে দেখা যায় লাভা-লোলেগাঁও-রিশপ। সূর্যোদয় দেখতে ঘুরে আসা যায় ঝান্ডিদাড়া। আবার না-ও যাওয়া যায়। ঘর থেকেই যে সানরাইজ দেখা যাচ্ছে দিব্যি। হুজুগ বলেই ছোটার দরকার নেই! মুশকিল হল, সাইটসিয়িংয়ের চক্করে আমরা অধিকাংশ সময়েই যেখানে থাকি, সেটাকেই উপেক্ষা করি। সেটাই দেখি না, দৌড়ই বাইরে।
তার চেয়ে বরং কাফেরের রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধ উপলব্ধি করুন। পুরি-সব্জি দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে, জমিয়ে চা-পর্ব সেরে হাঁটতে বেরিয়ে পড়া যায় জঙ্গলে। মায়াবি আলো-আঁধারিতে হারিয়ে যাওয়া যায়। সঙ্গী হোক না নিস্তব্ধতা।
হোমস্টে-র ঠিক নীচেই রয়েছে কয়েক ঘর বসতি। লোয়ার কাফের বলা হয় এখানকে। প্রতিটা বাড়িতে বাহারি ফুল। সহজ-সরল অনাড়ম্বর জীবনও বেরঙিন নয়। বরং রঙের প্রাচুর্যে প্রাণের ছোঁয়া। মাথায় রাখুন, পাহাড়িয়া মানেই সরল, আন্তরিক। এই আন্তরিকতা সমতলে বিরল!
ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম কাফের। —নিজস্ব চিত্র।
বয়স্কদের আবার হাঁটাহাঁটির ব্যস্ততায় না গেলেও চলে। লনে চেয়ারে বসেই কাটিয়ে দেওয়া যায় একটা আস্ত দিন। দূরের পাহাড়, পাখির ডাক, প্রজাপতির ওড়াওড়ি নিয়ে অলস দিন রয়েছে অপেক্ষায়। না হয় গায়ে মাখলেন সূর্যের উত্তাপ। ঘাসে ঘাসে রাখলেন পা।
আর সূর্যের উত্তাপও তো পাবেন না দিনভর। দুপুরের পর ঝুপ করে নেমে আসে অন্ধকার। সূর্য ঢাকা পড়ে লম্বা লম্বা পাইন বনের ওপাশে। আচমকা বাড়ে ঠাণ্ডা। হাওয়ায় লাগে কাঁপন। আবহাওয়ার এই হঠাৎ বদলও উপলব্ধি করার মতো। ক’দিন আগেও আকাশ ছিল মেঘলা। কাঞ্চনজঙ্ঘা ছিল মেঘের আড়ালে। বৃষ্টিতে কেটেছে মেঘ। দৃশ্যমান হয়েছে বরফের পাহাড়। আর বেড়েছে ঠাণ্ডা। অবশ্য সুনীলজিকে দেখে পাঁচ না পনেরো ডিগ্রি, তা বোঝা মুশকিল। বাড়তি সোয়েটার চাপাতে তো দেখলাম না এক বারও! দুপুরে রোদেও যা, রাত দশটাতেও পরনে একই পোশাক।
জানা গেল, এই হোমস্টে চালু হয়েছে বছর দশেক। এক একটা কটেজ তৈরিতে লেগেছে প্রায় পাঁচ লক্ষ টাকা। এখন এখানে রুমের সংখ্যা ১২।
অবকাশযাপনের জন্য আদর্শ। —নিজস্ব চিত্র।
এখানে জীবন কঠিন। ক্লাস টেন পেরলেই গিয়ে থাকতে হয় কালিম্পংয়ে, আবাসিক স্কুলে। তার আগে পর্যন্ত স্থানীয় স্কুল রয়েছে ঠিকই, তবে সেটাও কয়েক কিমি দূরে। পাহাড় টপকে নিত্যদিনের যাওয়া-আসা। চিকিৎসার জন্য যেতে হয় কালিম্পং। কেউ অসুস্থ হলে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গাড়িতে লাফাতে লাফাতে যাওয়াই ভবিতব্য। স্বাধীনতার পরে কেটেছে এত বছর, তবু সভ্যতার প্রাথমিক ব্যাপারগুলোতেও অনেক পিছিয়ে এঁরা। আশ্চর্যের বিষয়, এটাকেই মেনে নিয়েছেন সকলে। অভিযোগ নয়, মুখে সবসময় একচিলতে হাসি।
খাওয়াদাওয়াও বেশ ভাল। দু’রাত কেটে গেল হুশ করে। টেরই পেলাম না। ফেরার সময় মনটা কেমন করে উঠল। জঙ্গলের মধ্যে বাঁক নিতেই মুহূর্তে উধাও কটেজ, সুনীলজির সংসার। চোখের আড়ালে চলে গেল কাফের, যদিও মনের আড়ালে নয়।
যাত্রাপথ:
নিউ মাল স্টেশন থেকে প্রায় তিন ঘণ্টা লাগবে। বাগরাকোট হয়ে লোলেগাঁও এসে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আরও কয়েক কিমি। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে কালিম্পং, লাভা হয়েও আসা যায়।
ভাড়া:
হোমস্টে থেকেই গাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয় নিউ মাল স্টেশনে। ভাড়া সাড়ে তিন হাজার। তবে এনজেপি থেকে গাড়িতে এলে পড়ে চার হাজার টাকা। বাগডোগরা থেকে এলে পড়বে সাড়ে চার হাজার টাকা। মরসুম অনুসারে বাড়তেও পারে। তবে, বুকিংয়ের সময় সাম্প্রতিকতম ভাড়া যাচাই করে নেবেন।
রাত্রিবাস:
কাফের হোমস্টে।
যোগাযোগ: সুনীল তামাং ৯৮৩২৩১১৫০৫
থাকাখাওয়ার খরচ: জনপ্রতি দৈনিক ১৫০০।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy