ছ’শো বছরেরও বেশি পুরনো মাহেশের রথযাত্রা ঘিরে ভক্তদের ভিড়। ছবি: সংগৃহীত।
রথযাত্রা বললেই দৃশ্যপটে ভেসে ওঠে এক আবেগের ছবি। পথ জুড়ে বিশাল রথ। সেই রথের রশিতে এক বার টান দেওয়ার জন্য হাজার হাজার মানুষের আকুলতা। একটি বার সেই রশি ছুঁয়ে দেখার বাসনা। জগন্নাথের জয়ধ্বনিতে মুখর আকাশ-বাতাস।
প্রাচীনত্ব ও ঐতিহ্যের নিরিখে রথযাত্রা বললেই প্রথমেই নাম আসে পুরীর। ওড়িশার এই সৈকত শহরে লক্ষ লক্ষ মানুষ ছুটে আসেন একটি বার জগন্নাথদেবের রথের রশি স্পর্শ করতে। আরাধ্যকে ঘিরে আবেগ কোন পর্যায়ে পৌঁছতে পারে, তা না দেখলে বোঝা সম্ভব নয়। ভারতীয় সংস্কৃতির সাক্ষী হতে ছুটে আসেন বিদেশিরাও। তবে চাইলেও তো সব সময় পুরী যাওয়া যায় না! বদলে ঘুরে নিতে পারেন পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায়। বাংলার মানুষের কাছেও জগন্নাথদেবের মাহাত্ম্য কিছু কম নয়! রথ নিয়ে আবেগের ছবি ধরা পড়ে জেলায় জেলায়।
মাহেশের রথযাত্রা
প্রাচীনত্ব ও ঐতিহ্যের বিচারে বাংলার মধ্যে হুগলির মাহেশের রথের স্থান সম্ভবত সর্বাগ্রে। রথযাত্রার দিনে প্রাচীন এই জনপদে রথ টানতে ভিড় করেন অসংখ্য পুণ্যার্থী। রাস্তায় তো বটেই, দু’পাশের প্রতিটি বাড়ির বারান্দায়, ছাদে, দোকানেও তখন উপচে পড়া ভিড়। সকলেই চান রথে আসীন জগন্নাথের এক বার দর্শন পেতে।
ইতিহাস বলছে, পুরী যাওয়ার পথে শ্রীচৈতন্য মাহেশের জগন্নাথ মন্দিরে এসেছেন। তিনি মাহেশকে ‘নব নীলাচল’ আখ্যা দিয়েছিলেন বলে কথিত আছে। প্রাচীন মন্দিরে এসেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণও। ৬২৩ বছরের পুরনো শ্রীরামপুরের মাহেশের রথযাত্রা। কথিত আছে, জগন্নাথভক্ত ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী পুরীতে গিয়ে জগন্নাথ দেবের দর্শন না পেয়ে মনঃকষ্টে ছিলেন। পরে স্বপ্নাদেশ পেয়ে মাহেশে যান। এক ঝড়ঝঞ্ঝার রাতে গঙ্গা থেকে নিমকাঠ ভেসে আসতে দেখেন। তা দিয়েই তৈরি করেন জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার বিগ্রহ। অতি প্রাচীন সেই বিগ্রহ এখনও পুজো হয়।
মাহেশে এখন যে রথ টানা হয়, সেটি চার তলবিশিষ্ট লোহার রথ। উচ্চতা ৫০ ফুট। ১২টি লোহার চাকা। রথের প্রথম তলে চৈতন্যলীলা, দ্বিতীয় তলে কৃষ্ণলীলা এবং তৃতীয় তলে রামলীলা চিত্রিত রয়েছে। চার তলায় বিগ্রহ বসানো হয়। তামার দু’টি ঘোড়া রথের সামনে লাগানো হয়। কাঠের তৈরি সারথিও থাকে। মাহেশের জগন্নাথ মন্দির থেকে মাসির বাড়ি বল্লভপুরে নিয়ে যাওয়া হয় জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রাকে। মাহেশে এখন যে রথটি টানা হয়, সেটি কলকাতার মার্টিন বার্ন প্রতিষ্ঠানের তৈরি।
ছ’শো বছরের পুরনো এই রথযাত্রাকে ঘিরে শুরু হওয়া মেলা এখনও বসে। জিলিপি-পাঁপড়, নাগরদোলার টানে বহু মানুষ আসেন এখানে। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘রাধারাণী’ উপন্যাসেও মাহেশের রথের মেলার উল্লেখ রয়েছে।
কোথায় ঘুরবেন: মাহেশে রথযাত্রা দেখে, জগন্নাথ মন্দির দর্শন করে, মেলা ঘুরে চলে যেতেন পারেন প্রাচীন রাধাবল্লভপুর মন্দিরেও। ঘুরে নিতে পারেন শ্রীরামপুরের গঙ্গার ঘাট, কোর্ট চত্বর।
কী খাবেন: পাঁপড়ভাজা, জিলিপি তো আছেই। শ্রীরামপুরে জগন্নাথ মন্দিরের আশপাশে ও খটির বাজারে খুব পুরনো কিছু মিষ্টির দোকান রয়েছে। সেখান থেকে চেখে নিতে পারেন রকমারি মিষ্টি। এখানকার আদি হাজরা মিষ্টির দোকান প্রায় ২০০ বছরের পুরনো। এখানে রকমারি নাড়ু পাওয়া যায়। মহেশচন্দ্র দত্ত নামে আরও একটি ২০০ বছরের পুরনো মিষ্টির দোকান পাবেন। এখানে খেয়ে দেখতে পারেন দোকানের বিখ্যাত গুটকে সন্দেশ। মাহেশ পর্যন্ত চলে এলে রিষড়ার ফেলু মোদকের মিষ্টি চেখে দেখবেন না, তা কি হয়! তবে যদি রথযাত্রার দিনে আমিষ খাওয়ায় বাধা না থাকে, তা হলে অবশ্যই খেয়ে দেখতে পারেন শ্রীরামপুর স্টেশনের কাছে মদনের ফিশফ্রাই, ফিস চপ। এদের ঝাঁঝালো কাসুন্দিরও নামডাক কম নয়। এ ছাড়াও গঙ্গার ধারে প্রাচীন ড্যানিশ সরাইখানার আধুনিক রূপ ডেনমার্ক ট্র্যাভার্নে গিয়ে খেতে পারেন নানা রকম পদ। আছে আরও অনেক নাম করা রেস্তেরাঁও।
কী ভাবে যাবেন: হাওড়া থেকে ব্যান্ডেল মেন শাখায় পড়ে শ্রীরামপুর স্টেশনটি। হাওড়া থেকে অষ্টম রেলস্টেশন। রিষড়া স্টেশনে নেমেও মাহেশে আসা যায়। তবে রথযাত্রার সময় স্টেশন থেকে অটো-টোটো বন্ধ থাকে কয়েক ঘণ্টার জন্য। সেই সময়ে এলে হাঁটতে হতে পারে বেশ কিছুটা।
গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রা
বাংলার আরও একটি সুপ্রাচীন রথযাত্রার সাক্ষী হতে চাইলে চলে যেতে পারেন হুগলির গুপ্তিপাড়ায়। বলাগড় থানা এলাকায় বর্ধমান জেলার সীমানায় রয়েছে বর্ধিষ্ণু এই জনপদ। গুপ্তিপাড়ার রথ ও রথের মেলার খ্যাতি বহু দিনের। এ বার ২৮৫ বছরে পড়বে এখানকার রথ। তবে এখানকার রথকে বলা হয় ‘বৃন্দাবন জিউর রথ’। শুরুতে ১২টি চূড়া বিশিষ্ট কাঠের রথ থাকলেও, এখন ৯ চূড়ার রথই টানা হয়। প্রতিটি চূড়াতেই থাকে রঙিন ধ্বজা। বৃন্দাবন মন্দির থেকে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা যান প্রায় এক কিলোমিটার দূরে গোঁসাইগঞ্জ-বড়বাজারে মাসির বাড়ি।
গুপ্তিপাড়ার পূর্বপ্রান্তে গঙ্গার ধারে রয়েছে বৃন্দাবনচন্দ্র মঠ ও মন্দির। এই চত্বরে একসঙ্গে রয়েছে চারটি মন্দির। বৃন্দাবনচন্দ্র, চৈতন্যদেব, রামচন্দ্র ও কৃষ্ণচন্দ্রের মন্দির। চারটি মন্দির মিলে তৈরি হয়েছে গুপ্তিপাড়ার মঠ। বৃন্দাবন জিউর মন্দিরেই থাকেন জগন্নাথ। শোনা যায়, স্বপ্নাদেশ পেয়ে জগন্নাথের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স্বামী মধুসূদনানন্দ।
এখানকার রথের বিশেষত্ব হল ভান্ডার লুট। উল্টোরথের দিন মাসির বাড়ির মন্দিরের তিনটি দরজা একসঙ্গে খোলা হয়। ভিতরে মালসায় থাকে রকমারি খাবার। সেই ভোগ প্রসাদের জন্যেই হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। ৫২টি পদের প্রচুর মালসা থাকে। পুণ্যার্থীরা সেখানে ঢুকে যা প্রসাদ পান, তুলে নেন।
কোথায় ঘুরবেন: গুপ্তিপাড়ার মঠ ছাড়াও পাশেই কালনায় শিবমন্দির ও অন্যান্য মন্দির ঘুরে নিতে পারেন। দেখে নিতে পারেন গুপ্তিপাড়ার প্রাচীন সেনবাড়ি।
কী খাবেন: গুপ্তিপাড়ায় গেলে পুজোর ভোগ-প্রসাদ ছাড়াও গুপো সন্দেশ চেখে দেখতে ভুলবেন না।
কী ভাবে যাবেন: হাওড়া থেকে কাটোয়া লোকালে করে নামুন গুপ্তিপাড়া স্টেশনে।
মহিষাদলের রথযাত্রা
উত্তরে বহমান রূপনারায়ণ, দক্ষিণে হলদি নদী। তারই পাশে ঐতিহ্যের জনপদ মহিষাদল। সেখানেই এখনও সগৌরবে দাঁড়িয়ে রয়েছে রাজপ্রাসাদ। রাজবাড়ি সূত্রে জানা যায়, স্বপ্নাদেশ পেয়ে রানি জানকীদেবী জল থেকে পেয়েছিলেন শালগ্রাম শিলা। সেই শিলাকেই তিনি কুলদেবতার আসনে বসিয়ে পুজো করেন। জনশ্রুতি, প্রজাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে রথযাত্রার শুরু করেছিলেন রানি। ইতিহাসের সরণি বেয়ে প্রাচীন এই রথেও এসেছে বিবর্তন। ১৭ চূড়ার রথ কমে ১৩ চূড়ার হয়। ওই চার চূড়ার জায়গায় বসানো চারটি ঘোড়া। প্রতিটি চূড়ায় শোভা পায় পেতলের কলস, চক্র, ধ্বজা। তবে সময়ের সঙ্গে রথের বিবর্তন হলেও, এখনও বদলায়নি দুই শতাব্দী প্রাচীন রাজবাড়ির রথযাত্রা ঘিরে স্থানীয় মানুষের উচ্ছ্বাস ও আনন্দ।
প্রতি বছর রথের আগের দিন রথতলায় পুজো-অর্চনার মাধ্যমে এই অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। মহিষাদল রাজবাড়ির রথে অধিষ্ঠান করেন রাজবাড়ির কুলদেবতা নবরত্ন মন্দিরের মদনগোপাল জিউ, জগন্নাথদেব ও রাজরাজেশ্বরজি। চতুর্দোলায় ভক্ত সমারোহে সিংহদুয়ারের সামনে দিয়ে বিগ্রহ এনে স্থাপন করা হয় সুসজ্জিত রথে। পরম্পরা মেনে এখানেও রাজপরিবারের প্রতিনিধি পালকি চেপে আসেন। সঙ্গে থাকে রাজছত্র। রাজা বা রাজপ্রতিনিধি রথের রশি প্রথম স্পর্শ করেন। হাজার হাজার মানুষের ভক্তির টানে এগিয়ে চলে সেই রথ।
কী ভাবে যাবেন:
সাঁতরাগাছি থেকে একাধকি ট্রেন যায় মহিষাদল। ট্রেনে স্টেশনে নেমে চলে যেতে পারেন। সরাসরি গাড়িতেও যেতে পারেন।
কী দেখবেন: মহিষাদল রাজবাড়ি ও সেখানকার সংগ্রহশালা অবশ্যই দ্রষ্টব্য। তবে রথের দিনে কিন্তু তা খোলা থাকে না। কাছাকাছির মধ্যে ঘুরে নিতে পারেন ৮ কিলোমিটার দূরে গেঁওখালি। ২০ কিলোমিটার দূরেই রয়েছে হলদিয়া। ১৫ কিলোমিটার দূরে বালুঘাটার ম্যানগ্রোভ জঙ্গলও ঘুরে নিতে পারেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy