পুরনো চিৎপুর রোড
নন্দরাম সেন স্ট্রিট পেরিয়ে একটু এগুলেই শোভাবাজার মোড়। দোকান-বাজারে জনাকীর্ণ এই স্থানটিতে অসংখ্য অটো রিকশা যেন হাট বসিয়ে দিয়েছে। একদা হুতোম চিৎপুর রোডে সেকালের নানাবিধ ‘গাড়ির হররা’ প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, ‘...বিনা ব্যাঘাতে রাস্তায় চলা সোজা কর্ম নয়।’ হালের শোভাবাজারের এই মোড়ে দেখা গেল, অটো রিকশা ও মিনি বাস যেন সেই ট্র্যাডিশন বজায় রাখার জন্য অবতীর্ণ হয়েছে।
শোভাবাজার স্ট্রিট, পশ্চিমে গঙ্গার ঘাট অবধি প্রসারিত। এ রাস্তায় বাঁ-হাতি পড়বে বিখ্যাত ঔষধবিক্রেতা বটকৃষ্ণ পালের তিনতলা বাড়ি, যেটিকে দেশি ও বিদেশি স্থাপত্যশৈলীর সংমিশ্রণে গঠিত এক অভিনব অট্টালিকা বলা চলে। পালমশায়ের নির্মিত অনুরূপ স্থাপত্যের আর একটি দোকান বাড়ি দেখা যায় বনফিল্ডস লেনে। আরও একটু এগিয়ে গেলে বাঁ-হাতি পড়বে সুর পরিবারের প্রতিষ্ঠিত উনিশ শতকের এক নবরত্ন মন্দির। শোভাবাজার মোড় থেকে রবীন্দ্র সরণি ধরে দক্ষিণে সামান্য এগিয়ে গেলে কথিত বটকৃষ্ণ পালের নামাঙ্কিত বি. কে. পাল অ্যাভেনিউ রবীন্দ্র সরণির উপর দিয়ে আড়াআড়িভাবে প্রসারিত। বলতে গেলে, এখান থেকেই বাঁ-হাতি দক্ষিণ-পূবে শুরু হল সেকালের ‘বটতলা’ এলাকা। সরণি দিয়ে সামান্য এগিয়ে গেলে সামনেই পড়বে চারদিক বাড়ি ঘেরা একফালি জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছে জয় মিত্র পার্ক। তারপরেই বাঁ ফুটপাত দিয়ে এগিয়ে গেলে আয়রন চেস্ট, মাটিতে গেঁথে রাখার প্রয়োজনে সাবেকি লোহার ছোট-বড় সিন্দুক আর লোহার আলমারি তৈরির বেশ কয়েকটি কারখানা সেকালের তস্কররোধক বিত্ত সঞ্চয়ের স্মৃতিকে আজও টিকিয়ে রেখেছে। এ সব পেরিয়ে বাঁ-হাতি এবার সোনাগাজি পীরের গলি; দূরে পীর সাহেবের মাজার ইত্যাদি ধর্মস্থানটির স্থাপত্যটিকে দেখা যাচ্ছে। তবে সোনাগাজির গলি আজ দুর্গাচরণ মিত্র স্ট্রিট নামাঙ্কিত হলেও, কলকাতার সুবৃহৎ রূপবিলাসিনীদের আখড়া হিসেবে চিৎপুরের ‘সোনাগাছি’ নামেই সমধিক প্রসিদ্ধ।
চিৎপুরের গণেশ ঘর
আরও পড়ুন: সাবেক চিৎপুর রোড, অধুনা রবীন্দ্র সরণি যেন স্মৃতির সরণি
সেকালের বটতলা এলাকার শুরু থেকে চলে আসা গেল বটতলার বইপাড়ায়। আঠারো শতকের শেষ দিকে এই এলাকাতেই ছোটখাটো ছাপাখানা গজিয়ে ওঠার সুবাদে ছাপা শুরু হয়েছিল নানাবিধ ধর্মীয়, গল্প, উপন্যাস, নাটক ও সমাজধর্মী প্রহসন এবং আদিরসাত্মক পু্স্তকাদি। তাই ছাপাখানা যখন এল তখন ওই সব বিষয়ে বিবিধ পুস্তক পাইকারি ও খুচরো বিক্রির কেন্দ্র হিসাবে এই বটতলাই ছিল কলকাতার আদি বইপাড়া। আজ হয়তো সেকালের মতো অত বইয়ের দোকান আর নেই, তবুও যে’কটি দোকান আজও আছে তার মধ্যে নাম করা যেতে পারে, ‘নৃত্যলাল শীলস লাইব্রেরী’, ‘মহেন্দ্র লাইব্রেরী’, ‘কলকাতা টাউন লাইব্রেরী’, ‘ডায়মন্ড লাইব্রেরী’, ‘তারাচাঁদ দাস অ্যান্ড সন্স’, ‘অক্ষয় লাইব্রেরী’, ‘তারা লাইব্রেরী’, ‘ক্রাউন লাইব্রেরী’ প্রভৃতি। হুতোম তাঁর নকশায় এই এলাকাকে কেন্দ্র করে একদা লিখেছিলেন, ‘হাফ আখড়াই, ফুল আখড়াই, পাঁচালী ও যাত্রার দলেরা জন্মগ্রহণ কল্লে….’ ইত্যাদি। যদিও আজ হাফ বা ফুল আখড়াই, তরজা, কবিগান ও পাঁচালীর দলেরা তেমন মহিমায় প্রতিষ্ঠিত নেই, কিন্তু যাত্রাপালার সদর দফতর আজও চিৎপুরে রয়ে গেছে।
উত্তর কলকাতার ঐতিহ্য
বটতলার বইপাড়ার ডানহাতি নিমু গোস্বামীর গলি। যাঁর নামে এই রাস্তা সেই নিমাইচরণ গোস্বামীর বৃহৎ বসতবাটিতে একসময়ে বলরামের রাস হত চৈত্র মাসে। সেজন্যই লোকেরা গান বেঁধেছিল, ‘জন্ম মধ্যে কর্ম নিমুর চৈত্র মাসে রাস/ আলোর সঙ্গে খোঁজ নেইকো, বোঝা বোঝা বাঁশ।’ এ গলি পেরিয়ে আর একটু এগোলেই ডানদিকে বৃন্দাবন বসাক স্ট্রিট। এক সময় এখানেই ছিল এক বিখ্যাত টাইপ ফাউন্ড্রির কার্যালয়। কাছেই নিমতলার কাঠগোলার দৌলতে ছাপাখানার প্রয়োজনে কাঠের অক্ষর ডালা ও গ্যালি তৈরির কারুশালা এখনও এখানে দেখা যেতে পারে। তা ছাড়া এই বৃন্দাবন বসাক স্ট্রিটের সঙ্গে নিমু গোস্বামী লেন ও গরাণহাটার মেয়ে বউদের দিয়ে বটতলার বইয়ের ফর্মা ভাঁজাইয়ে দফতরির কাজ করানোর এক বড় কেন্দ্র। এ রাস্তার ১৯/এ নম্বরে শোভারাম বসাকের পৌত্রবধূ হরসুন্দরী দাসীর উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে নির্মিত রাধাকান্তের সাবেক মন্দিরটি ভগ্ন হওয়ায়, শিল্পী সুনীল পালের পরিকল্পনায় সেখানে আধুনিক স্থাপত্যের একটি নতুন মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
পরেশনাথের মিছিল
এবারে গরাণহাটায় পৌঁছে যাওয়া গেল। একসময়ে নদীপথে সুন্দরবন থেকে আসতে সরু ও লম্বা ধরনের লালচে রঙের গরানকাঠ—যা সেকালের অল্পবিত্তদের ছিটেবেড়ার দেওয়ালযুক্ত ঘর নির্মাণের কাজে ব্যবহৃত হত। এই মজবুত কাঠের প্রয়োজনে এখানে একটি হাট ও আড়ত গড়ে ওঠার কারণে এলাকার সেই গড়াণহাটা নামটি আজও থেকে গেছে। রবীন্দ্র সরণির বাঁ পাশের ফুটপাত থেকে শুরু হয়েছে গরাণহাটা স্ট্রিট, যা সোজা চলে গেছে দক্ষিণ-পূবে। খানিক এগুলে এ রাস্তার বাঁ পাশের বাঁকে দেখা যাবে দত্ত পরিবারের ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত জোড়া আটচালা শিবমন্দির, যা পুরাকীর্তি হিসাবে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে গরাণহাটা এলাকার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি কিন্তু বহুধাবিস্তৃত। এই এলাকার একটি বিখ্যাত শিল্পকর্মের ট্র্যাডিশন এখনও এখানে অব্যাহত রয়েছে। বটতলার প্রকাশকদের উদ্যোগে বাংলায় সচিত্র গ্রন্থ প্রকাশের তাগিদে যে কাঠখোদাই করা ছবির ব্লক প্রস্তুত করা হত, সে সব শিল্পীদের একটা কেন্দ্রীভূত বসতিও গড়ে উঠেছিল এই এলাকার আশেপাশে। কালীঘাটের পটের ছবি যেমন তুলিতে আঁকা, বটতলার ছাপাই ছবি তেমন কাঠের উপর লোহার বুলি দিয়ে এচিং করে আঁকা। বহু ক্ষেত্রে আবার কালীঘাটের দেশি পাটের ছবির ঢং-এ এখানের শিল্পীরা কাঠে খোদাই করেছেন, এবং তা ছাপার পরে প্রয়োজনীয় রং লাগিয়েছেন সস্তায় বেশি কাটতির আশায়। সেকালের বটতলার বইতে ছাপা এমন অসংখ্য ছবির নমুনা এখানকার ছাপাই ছবির কারিগরদের মুনশিয়ানার স্বাক্ষর বহন করে চলেছে। গরাণহাটা ও জোড়াসাঁকো এলাকার কাঠখোদাই কাজের সে ঐতিহ্য বেশ কিছুটা ম্লান হলেও, পুরোপুরি তা কিন্তু লুপ্ত হয়নি। আজও ছাপাখানার চাহিদা মেটানোর তাগিদে ছোট-বড় কাঠের অক্ষর, ভারতীয় মনীষীদের মূর্তির লাইন ব্লক বা বিশেষ করে স্বাক্ষরের অবিকল প্রতিরূপযুক্ত রবার স্ট্যাম্প তৈরির প্রয়োজনে কাঠের ফ্যাকসিমিলি ছাঁচ বা ডিজাইন অনুযায়ী হরেক রকম কাঠের ব্লক সরবরাহে চিৎপুরের গরাণহাটা ও জোড়াসাঁকোর ছোট-বড় কাঠের ব্লক নির্মাণের দোকান স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত।
ছবি: আনন্দবাজার পত্রিকার আর্কাইভ থেকে
(উপরের নিবন্ধটি তারাপদ সাঁতরা-র ‘কীর্তিবাস কলকাতা’ গ্রন্থের ‘স্মৃতির সরণি: চিৎপুর রোড’ অধ্যায় থেকে নেওয়া। আজ তার চতুর্থ পর্ব। সৌজন্যে আনন্দ পাবলিশার্স)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy