পাহাড়পুর, নামেই রয়েছে পাহাড়। আর নামে যা নেই, তা-ও আছে এখানে। উজাড় করা প্রকৃতির রূপ, ঢেউখেলানো মালভূমি, অভ্রের খনি, দ্বারকেশ্বরের বয়ে চলা, চাষের ক্ষেত, গ্রামীণ সাদামাঠা জীবন। বিলাস, বৈভব ছাড়াই এখানে দিব্যি কেটে যায় দিন। মাস ঘোরে, মরসুম বদলায়। বদলে যায় প্রকৃতির সাজসজ্জা।
বসন্তে প্রকৃতির সেই রূপবদলের সাক্ষী হতেই ঘুরে আসতে পারেন পাহাড়পুর। পুরুলিয়ার কাশীপুরেই রয়েছে ছোট্ট জনপদটি। রক্তাভ পলাশের আগুনে রূপের সাক্ষী হতে বেরিয়ে এই মরসুমে বেরিয়ে পড়তে পারেন পুরুলিয়া। এ জেলার আনাচকানাচে ছড়িয়ে ইতিহাস, ঝর্না, রাজবাড়ি, পাহাড়, আরও কত কী! দেখার জায়গা কম কিছু নেই। তবে সম্পূর্ণ একটি জেলার সব জায়গা এক বারে ঘুরে দেখা সময়সাপেক্ষ। তাই যদি খানিক নির্জনতা, বৈভবহীন গ্রামজীবনের স্বাদ পেতে চান, আর চান প্রকৃতির সঙ্গ— তবে বেছে নিতে পারেন পাহাড়পুর। পাহাড়কে বেড় দিয়ে তৈরি হয়েছে রাস্তা। সেই রাস্তা শেষ হয়েছে কাঁকরবিছানো পথে।
পাহাড়পুর আসলে প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্যই। এখানে এলে সকাল-সন্ধ্যা উপভোগ করতে পারেন দ্বারকেশ্বরের রূপ। চড়া রোদে শরীর-মাথা তেতে উঠলে, ডুবও দিতে পারেন নদের বুকে।

দ্বারকেশ্বরের পারেই কেটে যেতে পারে সকাল-সন্ধ্যা। ছবি: সংগৃহীত।
পাহাড়পুর থেকে ১২ কিলোমিটার গেলেই সোনাঝুরির জঙ্গল। সে পথে যাওয়ার সময় নজর পড়তে পারে রোদে ঝকমকিয়ে ওঠা পাথরের টুকরো। গাড়ি থামিয়ে কয়েকটি পাথর হাতে নিলেই বুঝতে পারবেন, তার গায়ে লেগে রয়েছে অভ্র। আসলে এখানে অভ্রের খনি ছিল। তারই নমুনা ছড়িয়ে আশপাশে। খনি অবশ্য বর্ষার পরে জলেই ভরে থাকে। দেখলে মনে হবে, গাছপালা ঘেরা একটা জলাশয় মাত্র।
সেই জায়গা ঘুরে, খানিক জিরিয়ে কিছুটা এগোলেই সোনাঝুরির বন। এ জায়গার সঙ্গে মিল পেতে পারেন শান্তিনিকেতনের সোনাঝুরির জঙ্গলের। দিনভর এ দিক-ও দিক ঘুরে পাহাড়পুরে ফিরে বিকেলবেলা পায়ে হাঁটা পথে চলুন গ্রামেরই মধ্যে থাকা পাহাড়টি চড়তে। তার নীচ পর্যন্ত গাড়ি যায়। সামান্য কিছুটা পথই হাঁটতে হয়। অবশ্য পাহাড় না বলে একে টিলা বলাই ভাল। তার মাথা থেকে দেখা যায় গোটা পাহাড়পুর।পাহাড়ে হাঁটাহাটি করলে চোখে পড়বে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে নির্মিত ইটের তৈরি সেমাফোর টাওয়ারের ধ্বংসাবশেষ। জানা যায়, এই টাওয়ারের সাহায্যেই সাঙ্কেতিক ভাষায় জরুরি বার্তা পাঠানো হত। নির্দিষ্ট দূরত্বে ছিল একাধিক টাওয়ার। প্রতিটি টাওয়ারে লোক থাকত। একটি টাওয়ার থেকে অন্যটিতে, আবার সেই টাওয়ার থেকে আরও এক টাওয়ারে বার্তা পাঠানো হত।
আরও পড়ুন:
রাত হলে গ্রামের রূপ আলাদা। জ্যোৎস্না রাতে গোটা চরাচর ঢাকে চাঁদের আলোয়। দূষণহীন আকাশে জ্বলজ্বল করে ওঠে তারারা।
রাত কাটিয়ে পরের দিন দেখে নিতে পারেন এখানকার ইকো পাহাড় সংলগ্ন ইকো লেক। তালাজুরি মোড়ের কাছে রয়েছে বরুণেশ্বর শিবমন্দির। গাজনের সময় এখানে বড়সড় মেলা বসে।
একটি বা দু’টি রাত এখানে থাকলে ঘুরে নেওয়া যায় আশপাশের জায়গাগুলি। তবে, মরসুমভেদে পাহাড়পুরের রূপই বদলে যায়। বর্ষায় সে শ্যামল, পুজোর সময় গ্রামের আনাচকানাচে ফুটে থাকে কাশফুল। আর বসন্তে এই গ্রামে আসার পথে দেখা পাবেন পলাশের।
হাতে সময় থাকলে, পাহাড়পুর থেকে ঘুরে নিতে পারেন রঞ্জনডি ড্যাম বা যোগমায়া সরোবর। সবুজে ঘেরা জলাধারটিও বেশ মনোরম। আদ্রা থেকে এই জায়গাটি ২০ কিলোমিটার দূরে। পাহাড়পুর এক বা দু’দিন কাটিয়ে গড়পঞ্চকোট, বড়ন্তি-সহ পুরুলিয়ার আরও নানা জায়গাও রাখতে পারেন বেড়ানোর তালিকায়।

পাহাড়পুর থেকে ঘুরে নিতে পারেন রঞ্জনডি ড্যাম বা যোগমায়া সরোবর।
কোথায় থাকবেন: পাহাড়পুরে থাকার জন্য একটি ইকো রিসর্ট রয়েছে। বৈভব নেই, তবে সাধারণ ভাবে যাপনের সব কিছুই রয়েছে এখানে।
কী ভাবে যাবেন?
ট্রেনে গেলে নামতে পারেন ইন্দ্রবিল স্টেশনে। তবে সব ট্রেন এখানে থামে না। সে ক্ষেত্রে আদ্রা স্টেশনে নেমে গাড়িতে ২৭ কিলোমিটার দূরে পাহাড়পুরে পৌঁছতে পারেন। কলকাতা থেকে সরাসরি গাড়িতেও আসতে পারেন পুরুলিয়া। ডানকুনি-আরামবাগ দিয়ে গেলে বরজোড়া, বেলিয়াতোড় হয়ে বাঁকুড়া পৌঁছতে পারেন। বাঁকুড়া থেকে ছাতনা হয়ে তালাজুরির দিক থেকেও আসতে পারেন পাহাড়পুর।