ঝর্না, মার্বেল রক, গড়, মন্দির, প্রাচীন গুহাচিত্র— মধ্যপ্রদেশ জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে অনেক কিছুই। তবে এ রাজ্যের পরিচিতি বাঘের জন্যও বটে। সুন্দরবন বললেই যেমন বাঘের কথা মনে পড়ে, তেমনই বাঘ দেখার টানে, ছবি তোলার জন্য মধ্যপ্রদেশের একাধিক জাতীয় উদ্যানে ছুটে আসেন পর্যটকেরা। বান্ধবগড়, কানহা, পেঞ্চের খ্যাতি বিশ্বজোড়া।
এ রাজ্যের ৩১ শতাংশই ঢাকা বনাঞ্চলে। রয়েছে ১১টি জাতীয় উদ্যান। বাঘসুমারির রিপোর্ট বলছে, গত দশকে ক্রমশই এ রাজ্যের বিভিন্ন জঙ্গলে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে। আসলে গ্রামবাসীরাও বুঝেছেন, জঙ্গল থাকলে, বাঘ থাকলে, থাকবে তাঁদের রুটিরুজি। সে কথা বুঝিয়েছে বন দফতর। আর তাই জঙ্গল সংলগ্ন গ্রামাঞ্চলের বাসিন্দাদের জীবন-জীবিকা অনেকটাই আবর্তিত হয় বনভূমি, পর্যটনকে কেন্দ্র করে। জঙ্গল যেমন পর্যটকদের ভ্রমণ পিপাসা মেটায়, তেমনই বদলে দেয় মানুষের ভাবনা। জীবনে নতুন কিছু করার রসদ জোগায়।
ঠিক যেমন জুগিয়েছে মণ্ডলা জেলার মাধুরী ঠাকুরকে। অখ্যাত এক গ্রামের মেয়েই এখন দেশ-বিদেশের পর্যটককে তাঁর এলাকার জঙ্গল ঘুরিয়ে দেখান। হাতে স্টিয়ারিং থাকলে বাঘকেও ডরান না তিনি। বরং স্বপ্ন দেখেন, প্রকৃতিকে গভীর ভাবে চেনার, পড়াশোনা করে পরীক্ষা দিয়ে বন দফতরের উচ্চ পদে আসীন হয়ে জঙ্গল রক্ষা করার।
কানহার গভীর জঙ্গলে বাঘ দেখতে গেলে এখানকার প্রথম মহিলা সাফারি চালক মাধুরীর সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে আপনারও। আর কে-ই বা বলতে পারে মণ্ডলার এই মেয়ের হাতে আপনাকে জঙ্গল ঘুরিয়ে দেখার ভার পড়বে কি না!
কানহার পরিচয়
কানহা জাতীয় উদ্যানের স্বীকৃতি পায় ১৯৫৫ সালে। ১৯৭৩ সালে এই বনভূমি টাইগার রিজ়ার্ভ-এর অন্তর্ভুক্ত হয়। ২০২২-এর বাঘসুমারির তথ্য বলছে, এই জঙ্গলে ১০৫টির মতো বাঘ রয়েছে। যে জঙ্গলে বাঘের অবাধ বিচরণ, সেখানে প্রবেশের নিয়মকানুনে কড়াক়ড়ি থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। কানহার গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করতে গেলে তাই বন দফতরের অনুমতি প্রয়োজন। সচিত্র পরিচয়পত্র এবং সাফারির খরচ দিয়ে আগাম বুকিং করতে হয়।
কোর-বাফারের বিভেদ
গভীর জঙ্গলে পর্যটকদের ঘোরানোর জন্য থাকে সকাল এবং বিকেলে জিপ সাফারির ব্যবস্থা। গহন জঙ্গলকে বলা হয় কোর এরিয়া। অপেক্ষাকৃত কম ঘন জঙ্গল, বনভূমি সংলগ্ন গ্রামাঞ্চল থাকে বাফার এরিয়ার তালিকায়। কোর এরিয়ায় সাফারি হয় সারা দিনে দু’বার ভোরে এবং দুপুরে। সেখানেই পর্যটকদের জিপে করে নিয়ে যান মাধুরী। তাঁর কর্মস্থল মুক্কি জ়োন।
জঙ্গল সাফারির জঙ্গলে রয়েছে কানহা, মুক্কি, কিশলি, সারহি জ়োন। আসলে জঙ্গলে পর্যটকদের ঘোরানোর সমস্ত গাড়ি এক জায়গায় ভিড় করলে, বন্যপ্রাণ শব্দেই পালিয়ে যাবে। বন্যপ্রাণ, জীব বৈচিত্র অনুযায়ী নানা জ়োনের ভাগাভাগি। এতে পর্যটকদের ঘোরাতেও সুবিধা হয়। পর্যটকেরা যান মূলত কানহা বা মুক্কি দিয়ে। সেখানেই ভোর থেকে পর্যটকদের জন্য জিপ নিয়ে খাকি পোশাক পরে প্রস্তুত থাকেন মাধুরী।
কোর এরিয়ায় সাফারির ব্যস্ততা শুরু হয় সূর্য ওঠার আগে থেকে। সাফারির চালকরাও জঙ্গলে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন। চলতে থাকে নথিপত্র, পরিচয়পত্র মিলিয়ে নেওয়ার পালা। অপেক্ষা থাকে, কখন একটু আলোর রেখা ফুটবে। আকাশের গায়ে হালকা রঙের আভাস দেখা দিলেই পর পর জিপ ঢুকতে শুরু করে জঙ্গলে।
মাধুরীর গল্প

কানহার সাফারি চালক মাধুরী ঠাকুর। —ছবি সংগৃহীত।
এখানকার গ্রামের বাসিন্দাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকে অরণ্য। জঙ্গলে কাঠকুটো সংগ্রহ থেকে গবাদি পশু চরানো জীবনযাপনের অঙ্গ। বন দফতরেও বিভিন্ন পদে কাজ করেন গ্রামের বাসিন্দারা। কিন্তু সে তো পুরুষরা। তা বলে মণ্ডলার মতো জেলার প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়ে কিনা জঙ্গলে গাড়ি চালাবে? বাধা দিয়েছিলেন মাধুরী ঠাকুরের আত্মীয়েরা। কানাঘুষো হয়েছিল গ্রামেও। কিন্তু মেয়ের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বাবা-মা।
কী ভাবে এই উত্তরণ? আনন্দবাজার অনলাইনকে গাড়ির চালক হয়ে ওঠার কাহিনি শোনালেন মাধুরী। গ্রামে বড় হলেও ছোট থেকে নিয়ম করেই স্কুলে গিয়েছেন তিনি। বাবা গুলজ়ার সিংহ ঠাকুর বন দফতরের রক্ষী। ফলে জঙ্গল-যোগ ছোট থেকেই ছিল। মাধুরী বলেন, ‘‘দ্বাদশের পাঠ শেষ করার পরে হঠাৎ করে আমার কাছে গাড়ি চালানো শেখার সুযোগ আসে। চাকরির কথা মাথায় আসেনি। গাড়ি চালানোর সুযোগ পাচ্ছি বলেই শিখতে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম।’’ উদ্যোগ ছিল বন দফতরের। জিপ চালানোর প্রশিক্ষণ দিয়ে জঙ্গল সাফারির জন্য দক্ষ চালক তৈরি করতে চেয়েছিল তারা। পাশাপাশি গ্রামবাসীদের স্বনির্ভর করে তোলা, রুজি-রুটির ব্যবস্থা করাও লক্ষ্য ছিল। সেই উদ্যোগেই সামিল হন মাধুরী। চলতে থাকে প্রশিক্ষণ। সে অন্তত বছর সাতেক আগের কথা। আর এখন তিনি দক্ষ চালক। একদম গাড়ির কাছে বাঘ এসে গেলেও এখন আর বুক কাঁপে না তাঁর।
আরও পড়ুন:
ঘুম ভাঙা ভোর
আঁধার থাকতেই এখানকার অন্য সাফারি চালকদের মতো ব্যস্ততা শুরু হয় মাধুরীর। জঙ্গলে গাড়ি প্রবেশের পর ধীরে ধীরে আকাশ ফর্সা হয়। দিনের প্রথম রবিকিরণ যখন গাছের পাতা, ডালপালার ফাঁক দিয়ে জঙ্গলের রাস্তায় এসে পড়ে—সে এক দেখার মতো দৃশ্য বটে। জঙ্গলের ঘুম ভাঙার ছবি চাক্ষুষ করার রোমাঞ্চ কম নয়। আবছা আলো থেকে সব কিছু স্পষ্ট, প্রতীয়মান হয়ে ওঠা, জীবদের আনাগোনা টের পাওয়া সবকিছু নিয়ে ভ্রমণ। তবে রোম্যান্টিকতায় ভেসে যাওয়া চলবে না, প্রতি মুহূর্তে সতর্ক থাকাই জঙ্গলের নিয়ম। বন্যপ্রাণ দেখতে গেলে শ্যেনদৃষ্টি নিক্ষেপ করতে হবে সর্বত্র।
জঙ্গল দিশা দেখাচ্ছে মহিলাদেরও
জঙ্গল ঘুরতে শুধু মাধুরী নন, সাহায্য করতে পারেন সীমা, রেশমারাও। বন দফতরের সাফারি চালক হিসাবে কানহায় মাধুরী ঠাকুর একা হলেও, পর্যটকদের জঙ্গলের আটঘাট বোঝাতে গাইডের কাজ করছেন অনেক মহিলাই। সীমা, রেশমারা সেই দলেই পড়েন। মাধুরী, সীমা প্রত্যেকেরই নিজস্ব গল্প আছে।
মাধুরীর যেমন তাঁর ইচ্ছা ছিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার। হঠাৎ করে একটা সুযোগ বদলে দিল তাঁর জীবন। বললেন, ‘‘ইঞ্জিনিয়ার হতে না পারার কোনও আক্ষেপ নেই, বরং জঙ্গলে পর্যটকদের নিয়ে ঘোরাতেই আনন্দ পাই। কাজটা উপভোগ করি। একদিন ভেবেছিলাম গাড়ি চালানো শিখে নিলে প্রয়োজনে কাউকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া বা বিশেষ প্রয়োজনে সেই শিক্ষা কাজে লাগবে। এই শেখাই আমাকে রুটি-রুজি জোগায়।’’
বছর সাতাশের মাধুরী এখন বিবাহিত। চাকরি করতে করতেই স্নাতক স্তরের পড়়াশোনা শেষ করেছেন। বিয়ের পর ঘর-বার সামলাতে গিয়ে ব্যস্ততা বেড়়েছে। বছর সাতেক আগের একটা প্রশিক্ষণই বদলে দিয়েছিল তাঁর জীবন। সে সময়ে মাধুরীর সঙ্গে বেশ কয়েক জন গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ হলেও, মেয়ে হিসাবে পরীক্ষায় পাশ করেছিলেন শুধু মাধুরী। তার পর থেকে প্রতি মুহূর্তে জীবনে নানা রকম চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছেন তিনি। কাজে যোগ দেওয়ার পরেও পুরুষমহলের কটাক্ষ শুনতে হয়েছে। কখনও পর্যটকেরাও তাঁকে দেখে অনাস্থা পোষণ করেছেন। ভেবেছেন একজন মহিলা বাঘের ডেরায় নিয়ে যাবেন কী করে!

মুক্কি জ়োন কর্মক্ষেত্র মাধুরীর। পর্যটকদের সাফারি করান তিনি। —ছবি: সংগৃহীত।
তবে এখন কাজ নিয়ে বেশ আত্মবিশ্বাসী মাধুরী। কিন্তু সে তো একদিনের ফল নয়। অতীতের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল তাঁর? সে দিনের কথায় এখন অবশ্য তাঁর মুখে হাসি খেলে যায়। বললেন, ‘‘এখনও প্রথম দিন স্মৃতি আমার কাছে স্পষ্ট। প্রশিক্ষণের পর পর্যটকদের নিয়ে জঙ্গলে গিয়েছিলাম। আচমকা সামনে বাঘ দেখে স্টয়ারিংয়ে হাত থমকে গিয়েছিল। কিছু ক্ষণের জন্য গাড়িতে সিঁটিয়ে বসেছিলাম। সম্বিৎ ফেরে অন্য গাড়িতে হইচই করা পর্যটকদের দেখে।’’ তার পর অনেকেই তাঁর দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন করেছেন। পুরুষরা কটাক্ষও করেছেন। তবে এখন আর সে সব গায়ে মাখেন না। বরং চালকের আসনে বসে স্টিয়ারিংয়ে হাত রাখলেই আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়।

জঙ্গলের সদস্যরা। ছবি: সংগৃহীত।
৯৪০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত কানহার গহন অরণ্য। বনানীর পশু-পাখিদের চেনানোর কাজটি করেন ১৫০ জন। তাদের মধ্যে ১৩ জন মহিলা। জঙ্গলপথে ঘোরার সময় গাইডের কাজ বন্যপ্রাণ দেখানোয় সাহায্য করা। কখন বাঘ আসবে বা তেমন পরিবেশ সেই অঞ্চলে রয়েছে কি না তা বোঝা। গাছ, পাখি চিনিয়ে দেওয়া।
কানহার জঙ্গলে অজস্র চিতলের দেখা মেলে। রয়েছে প্রায় ৩০০ প্রজাতির পাখি। তবে বাঘের ডেরায় ঢুকে বাঘ দর্শন হবেই, এমনটা বলা যায় না। বিস্তীর্ণ জঙ্গলে শুধু বাঘ নয়, যে কোনও বন্যপ্রাণ যাতে নিশ্চিন্তে ঘুরতে পারে সেই ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বাঘ, লেপার্ডের যাতায়াতের পথে কদাচিৎ দেখা হয়ে যেতে পারে। কপাল ভাল থাকলে হয়তো দেখলেন আপনার গাড়ির রাস্তার উপরেই বসে যাচ্ছে বাঘ বা বাঘিনি ও তার শাবকেরা।
বারশিঙার টানে
কানহার জঙ্গলের আর এক আকর্ষণ বারশিঙা বা সোয়াম্প ডিয়ার। ভারতের যে কোনও অঞ্চলে চট করে বারশিঙার দেখা মেলে না। বরাত ভাল থাকলে লম্বা আঁকাবাঁকা শিঙের এই প্রাণীটির মুখোমুখি হতে পারেন কানহায়।
সাফারির সময়
কোর এরিয়া বা গভীর জঙ্গলে সকালের সাফারি শুরু হয় সূর্য ওঠার সময় থেকে। মরসুম অনুযায়ী সময় বদল হয়। গ্রীষ্মে সকাল ১০টা , শীতে ১১টা পর্যন্ত জঙ্গলে ঘোরানো হয়। বিকেলের সাফারি দুপুর ২টো থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত হয়। অনলাইনে আগাম বুকিং হয়।
কোর এরিয়ায় সোম থেকে শুক্রবার পর্যন্ত জঙ্গল সাফারির জন্য জিপসি পিছু খরচ ৮০০০ টাকা, শনি এবং রবিবার সেই খরচ হয়ে যায় ৯০০০ টাকা। একটি জিপসিতে ছ’জন বসতে পারেন। বাফার এরিয়ায় সাফারির খরচ জিপসি পিছু ৭০০০ এবং শনি-রবি ৮০০০ টাকা।
কোথায় থাকবেন?
কানহার দু’টি প্রধান প্রবেশদ্বার— খাটিয়া ও মুক্কি, এদের ঘিরে রয়েছে নানা হোটেল, রিসর্ট। কানহাতে থাকার জন্য এমপিএসটিডিসি-র দু’টি ট্যুরিস্ট লজ আছে। খাটিয়া গেটের কাছে বাঘিরা জঙ্গল রিসর্ট, বানজার নদীর ধারে। আর মুক্কিতে কানহা সাফারি লজ।
কী ভাবে যাবেন?
ট্রেনে গেলে কাটনিতে বা জবলপুরে নেমে সড়কপথে যেতে পারেন কানহা। প্লেনে গেলে অবশ্য জবলপুর বা নাগপুর হয়ে সড়কপথে যেতে হবে।