Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

মাতলার ধারে সবুজঘেরা গ্রাম

কলকাতার অনতিদূরে এক গ্রামের পথেরাজপুর-সোনারপুর ছাড়িয়ে পেরিয়ে গেলাম বারুইপুর। তার পরের রাস্তা গুগল ম্যাপ ছাড়া শহুরে চোখে অভ্যস্ত নয়। দক্ষিণ বারাসত পেরিয়ে জয়নগর আসতেই মোয়ার গন্ধে মন আনচান।

তরঙ্গ: মাতলা নদীর বাহার

তরঙ্গ: মাতলা নদীর বাহার

সায়নী ঘটক
শেষ আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০২০ ০০:২৪
Share: Save:

পেন্ডুলাম তখন বলছে, আরও দক্ষিণে... আরও দক্ষিণে। রাজ্যের শেষ প্রান্তটা ছুঁয়ে আসতে মন চাইছিল, তবে চেনা সুন্দরবন নয়। মাথায় ঘুরছিল, একেবারে অন্য রকম কোথাও যেতে হবে, দু’দিনের পড়ে পাওয়া ছুটিটা কাজে লাগিয়ে। এমন কোথাও, যেখানে বড় একটা যায় না কেউ। দু’চাকার পিছনে সওয়ার হয়ে কলকাতা ছাড়লাম শীতের এক শনিবারের সকালে।

রাজপুর-সোনারপুর ছাড়িয়ে পেরিয়ে গেলাম বারুইপুর। তার পরের রাস্তা গুগল ম্যাপ ছাড়া শহুরে চোখে অভ্যস্ত নয়। দক্ষিণ বারাসত পেরিয়ে জয়নগর আসতেই মোয়ার গন্ধে মন আনচান। সে সব ছেড়ে এগিয়ে গেলাম বাঁয়ে, কুলতলির দিকে। কৈখালি কাছারি বাজার পেরোনোর পরে খেয়াল করলাম, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বলতে রাস্তায় চলছে শুধু টোটো আর ট্রেকার। তা-ও সংখ্যায় খুব কম। বাসরাস্তা ছেড়ে এসেছি অনেক আগেই। স্কুলের উঠোন, মসজিদের গেট, পুকুরপাড়ের সামনে দিয়ে আঁকাবাঁকা মসৃণ রাস্তা এগিয়ে যাচ্ছে দক্ষিণে। কোনও বাড়ির দাওয়ায় উপুড় করে শুকোতে দেওয়া হয়েছে মাটির সরা, মালসা। মোড়ের চায়ের দোকানে চলছে শীতের সকালের আড্ডা। কলকাতা ছাড়ানোর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই গ্রাম বাংলার এমন রূপ দেখব, সত্যিই ভাবিনি।

পিচ রাস্তা ছেড়ে দু’চাকা চলতে শুরু করল আল বেয়ে। দু’পাশে ধু ধু ধানখেত। খানিক এগোনোর পরে থামলাম এক মস্ত দরজার সামনে। মাধবীলতা জড়ানো গেটের পাশে। সেটিই আমাদের হোমস্টের ঠিকানা। ভিতরে ঢুকে দেখি, প্রকৃত অর্থেই সবুজে ঘিরে থাকা এক টুকরো থাকার জায়গা। সামনেই পুকুরে ফুটে থাকা শাপলা, বাগান জুড়ে গাছগাছালি আর পাখি। তারই একপাশে থাকার দু’টি মাত্র ঘর। হাঁস চরে বেড়াচ্ছে বাগানের সবুজ চিরে, আশপাশটা একেবারে নিঝুম। প্রকৃতির নৈঃশব্দ্য কাকে বলে, সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম সন্ধে নামার মুখে। বড় রাস্তা থেকে অনেকটাই ভিতরে এই হোমস্টে। তাই হর্নের আওয়াজ তো দূর, আশপাশের গ্রামও আশ্চর্য রকমের শান্ত। চমকের আরও বাকি ছিল। আশপাশটা ঘুরব বলে গেট থেকে বেরিয়ে বাঁ দিকে যেতেই জলের আওয়াজ। গাছপালার আবরণ সরে যেতেই চোখের সামনে বেরিয়ে পড়ল মাতলা নদী। শীতকাল, তাই গর্জন কম। শান্ত স্রোতস্বিনী বয়ে যাচ্ছে কুলকুল করে, চোখেই পড়ছে না ও পার। এখান থেকেই ম্যানগ্রোভের শুরু। সুন্দরবনের ছোঁয়া রয়েছে জায়গাটায়, গহিন অরণ্য শুরু হওয়ার ঠিক মুখটায় দাঁড়িয়ে আছি আমরা। স্থির হল, পরদিন ভোর-ভোর ডিঙি নৌকায় ভেসে পড়ব মাতলায়।

একান্তে: গ্রামের ভিতরে নিবিড় আস্তানা

অ্যালার্ম দিয়ে উঠে পরদিন মাতলার ধারে যেতেই দেখি, ডিঙি তৈরি। দাঁতন করতে করতেই লগি ঠেলতে শুরু করলেন মাঝি। মাছ ধরার জালের উপরে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে যখন মাঝনদীতে পৌঁছলাম, জলে সবে কমলা রং ধরতে শুরু করেছে। ও পারটা ঝড়খালি। টাইগার রেসকিউ সেন্টার ঘুরে আসা যায় ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই। এক পাশে অজস্র খাঁড়ি, তারই একটায় ঢুকে গেলাম আমরা। এখানে সুন্দরী, গরান, গেঁওয়া, হেতালের জঙ্গল খানিক ঘন হতে আরম্ভ করেছে। বার্ড ওয়াচিংয়ের জন্যও যে জায়গাটা আদর্শ, সেটাও মালুম হল নৌকাসফরে গিয়েই।

গোটা গ্রাম জুড়েই কাঁকড়া, চিংড়ির ফার্মিং চলে। হোমস্টে লাগোয়া পুকুর থেকে কাঁকড়া ধরা দেখতে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমরা। কেয়ারটেকারের ষোড়শী কন্যা তরতরিয়ে নেমে পড়ল কাঁকড়াভর্তি পুকুরটায়। তার পরে হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে টোপ আর জাল দিয়ে চলল কাঁকড়া ধরা। বালতি ভরে উঠল ছোট-বড়-মাঝারি সাইজ়ের কাঁকড়ায়। গাছ থেকে ছোট একটা ডাল ভেঙে গুঁজে দেওয়া হল বালতিতে, যাতে একে অন্যের সঙ্গে মারামারি করতে না পারে কাঁকড়াগুলো।

দুপুরে কাঁকড়ার ঝোল আর ভাত খেয়ে বিকেলে ফেরার তোড়জোড় শুরু হল। বনঘেরা নিঝুম গ্রামের মায়া কাটিয়ে শহরের রাস্তা ধরলাম।

অন্য বিষয়গুলি:

travel tourism Sundarbans Matla River
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE