ঐতিহ্য: ইয়াঙ্গন শহরের দুর্গাবাড়িতে পুজোর সময় একত্র হয়েছেন বাঙালিরা। বাঁ দিকে, ইয়াঙ্গনের বাঙালিপাড়া
কিতনা হ্যায় বদনসিব জাফর দফ্নে কে লিয়ে/ দো গজ জ়মিন ভি না মিলি কু-এ-ইয়ার মে...
(কী অভাগা এই জাফর, কবরের জন্য/ দু’গজ জমিও জুটল না আপনজনের পথের পাশে)
শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর নির্বাসিত হয়েছিলেন তৎকালীন বর্মার রেঙ্গুনে। মৃত্যুর আগে গভীর যন্ত্রণায় তিনি লিখেছিলেন উপরের শব্দগুলি। ১৮৮৫-র তৃতীয় ইঙ্গ-বর্মা যুদ্ধে ব্রিটিশরা বর্মার সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব দখল করে। বর্মার শেষ রাজা থিবাউকে বন্দি করে ভারতের পশ্চিম উপকূলের পাহাড়ঘেরা শহর রত্নগিরিতে নির্বাসনে পাঠানো হয়। সেখানেই সমাধিস্থ রাজা থিবাউ মিন। দুই দেশের দুই বন্দি সম্রাটের জীবনের শেষ যাত্রা— এক জনের পুব থেকে পশ্চিমে, আর এক জনের পশ্চিম থেকে পুবে। দু’জনেরই আকুল আর্তি ছিল দেশে ফেরার।
উনিশ শতকে ইংল্যান্ডের ‘এশিয়া প্রদর্শনী’তে বর্মার জন্য বরাদ্দ ছিল আলাদা প্যাভিলিয়ন। ইংল্যান্ডের কাগজে ভূয়সী প্রশংসা হয়েছিল বর্মি খাবার, পোশাক, সাজসজ্জার। ব্রিটিশরা কথা দিয়েছিল, বর্মার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কে প্রাধান্য পাবে বর্মি স্বার্থ। বর্মায় তখন থিবাউ-এর রাজত্ব। সুকৌশলে প্রচার করা হল, এই রাজা যোগ্য নন, কেবল স্ত্রীর বুদ্ধিতে চলেন। সেই সময় ব্রিটিশদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ তিন বাণিজ্য বন্দর বোম্বাই, কলকাতা ও রেঙ্গুন। ঔপনিবেশিক আধিপত্য বর্মা অবধি বিস্তৃত করার গুরুত্ব বুঝেছিল তারা।
ঔপনিবেশিক যুগে বর্মা ছিল ভারতীয়দের কাছে ভাগ্যানুসন্ধানের ঠিকানা। ‘পলাতকা’ কাব্যের ‘চিরদিনের দাগা’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘অবশেষে বর্মা থেকে পাত্র গেল জুটি।/ অল্পদিনের ছুটি;/ শুভকর্ম সেরে তাড়াতাড়ি/ মেয়েটিরে সঙ্গে নিয়ে রেঙ্গুনে তার দিতে হবে পাড়ি।’ ব্রিটিশের শ্রমিক প্রকল্পে বহু মানুষ শ্রমিক হয়ে বর্মা গিয়েছেন, সরকারি চাকরি বা ব্যবসার কাজে গিয়েছেন বাবু বাঙালিরাও।
একদা পশ্চিম ভারত থেকে বর্মা এসেছেন, এমন এক ব্যবসায়ী পরিবারের বর্তমান সদস্যের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তাঁর নাম জিজ্ঞেস করতে বললেন, ‘‘কোন নামটা বলব? আমার চারটে নাম। বাড়ির একটা, ছোটবেলায় খ্রিস্টান মিশনারি স্কুল থেকে দেওয়া খ্রিস্টান নাম একটা, এ দেশে ব্যবসা করার জন্য বর্মি নাম একটা, আর পিতৃপরিচয়ের একটা। চারটে নামই দরকারে ব্যবহার করি।’’
বর্মা এখন মায়ানমার, রেঙ্গুন এখন ইয়াঙ্গন। উপনিবেশের ইতিহাস মুছে ফেলে নতুন বর্মা তৈরির প্রয়াসে আর মিলিটারি শাসনে পিষ্ট হতে হতে বাঙালিদের স্মৃতি ধুয়ে গেছে। ইয়াঙ্গনের আর্কাইভ, জাতীয় গ্রন্থাগারও মুছে ফেলেছে ভারত-বর্মার নানা সংযোগসূত্র। থেঁতলে যাওয়া স্মৃতি বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শুধু প্রাচীন কয়েকটি বাড়ি আর রাস্তা।
মায়ানমারের বেশির ভাগ প্রবাসী ভারতীয়ই এখনও সে দেশের নাগরিক নন। জন্ম সেখানে, বাস করছেন ষাট-সত্তর-আশি বছর, এমন মানুষও নাগরিকত্ব পাননি। বর্মার বাংলা সাহিত্যের খোঁজে ইয়াঙ্গনের বাংলাদেশ দূতাবাসে গিয়ে জানা গেল চট্টগ্রামের এক বাঙালির কথা। ভারত স্বাধীন হওয়ার আগেই তাঁর জন্ম, তখন থেকেই বর্মার বাসিন্দা। তাঁকে পাসপোর্ট করাতে হয়েছে বাংলাদেশ থেকে। অশীতিপর বৃদ্ধ প্রতি বছর বাংলাদেশি পাসপোর্টের মেয়াদ বাড়িয়ে মায়ানমারে থাকেন। ভারত, বাংলাদেশ বা মায়ানমার, কোনওটাই তাঁর দেশ নয়।
ইয়াঙ্গনের রাস্তায় চা হাতে কয়েকজন প্রবীণ প্রবাসী ভারতীয়র সঙ্গে আড্ডা হচ্ছিল। ভারতে এনআরসি প্রসঙ্গে ওঁদের এক জন বললেন, ‘‘আমরা জানি কী ভয়ঙ্কর এই প্রকল্প। বর্মি ভাষায় কথা বলে, বর্মিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে, বর্মি খাবার খেয়ে বর্মায় গোটা জীবন কাটিয়ে দিলাম, এখনও আমরা বিদেশি। যাদের এনআরসি হয়েছে তাদেরও হাল আমাদের মতোই, ষাট বছরেও নাগরিকত্ব পায়নি। সরকারি চাকরি বা সুবিধে পাবে না আমাদের কেউ।’’ চলে কী করে? ছোট ব্যবসা, বেসরকারি সংস্থার চাকরিতে সামান্য বেতন। বাড়ি বলতে লম্বা একটা ঘর। সামনের অংশটা বারান্দা, পিছনে রান্নার জায়গা, ডানে স্নানঘর। মাঝখানে যত মানুষ তত খোপ, কাঠ দিয়ে উপর-নীচ ঘর দু’ভাগ করে নেওয়া। লম্বা লম্বা রাস্তার দু’ধারে ছিল বাঙালিদের বাড়িঘর। মিলিটারি শাসন সব কেড়ে নিয়েছে। ষাটের দশকে ইন্দিরা গাঁধীর প্রচেষ্টায় ভারতীয়রা দেশে ফিরেছিলেন। ইরাবতী বেয়ে জাহাজে ভারতে ফেরার সময় প্রায় কিছুই সঙ্গে আনতে পারেননি। ঠাঁই হয়েছিল বিভিন্ন কলোনিতে। পাকিস্তানের সে গরজও ছিল না, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ফিরতে পারেননি সেখানকার বাঙালিরা। থেকে গিয়েছিলেন। বর্মার এই বাঙালিদের অনেকে ’৪৭-এর আগেই ভারত থেকে বর্মা গিয়েছেন। দেশভাগের পরে দলে দলে বাঙালি যেমন ভারতে এসেছেন, তেমনই চট্টগ্রাম-কক্সবাজার থেকে আসা বহু বাঙালির ঠিকানা হয়েছে রেঙ্গুন। বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের রেঙ্গুনও ধরে আছে দেশভাগের যন্ত্রণা।
ইয়াঙ্গনের প্রবাসী বাঙালিরা বলছিলেন, বর্মিরা খুব ভাল মানুষ, অতিথিবৎসল। রাস্তার দু’পাশে অজস্র খাবারের দোকান, রাত বারোটা অবধি মেয়েরা ফুটপাতে দোকান চালান, ছোট পানশালাতেও স্বচ্ছন্দে পানাহার পরিবেশন করেন রাত অবধি। কলকাতা থেকে আকাশপথে দিল্লি যেতে যত ক্ষণ, তার চেয়ে অনেক কম সময়ে পৌঁছনো যায় ইয়াঙ্গন। কলকাতা কেমন লাগে? অনেকেই বললেন, ভাল লাগে না। ছোট্ট ভাঁড়ে চা দেয়, মানুষ মানুষের সঙ্গে কথা বলে না, প্রতিবেশীকে চেনে না!
ইয়াঙ্গনের দুর্গাবাড়ি শুধু ধর্মস্থান নয়, বাঙালি সংস্কৃতিরও কেন্দ্র। ১৯৬০-এর দশকে বর্মা যখন পুরোপুরি মিলিটারিদের দখলে চলে যায়, তখন থেকেই বাঙালিদের জীবনে নেমে আসে সাংস্কৃতিক আঘাত। ‘বেঙ্গল একাডেমি’ ও ‘টেগোর কলেজ’ সেনার দখলে চলে যায়, বাঙালির সাংস্কৃতিক স্মৃতি মুছে ফেলা হয় সেই সব প্রতিষ্ঠান থেকে। ছাড় পায়নি রামকৃষ্ণ মিশনও। ধর্ম, সমাজসেবা, শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে মিশনের সন্ন্যাসীরা দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করছিলেন। রেঙ্গুন-প্রবাসী বাঙালিরা এখনও স্মরণ করেন রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের দুই প্রাক্তন অধ্যক্ষ স্বামী গহনানন্দ ও স্বামী আত্মস্থানন্দকে। এখন মিশন নেই, বাড়িটি পড়ে আছে। কিছু বাঙালি নিয়মিত আসেন, আড্ডা দেন। একটি ট্রাস্ট রয়েছে, রামকৃষ্ণ, সারদা দেবী, বিবেকানন্দের জন্মতিথি ছোট করে উদ্যাপন করেন তাঁরা। বাড়ি থেকে আনা ‘গীতবিতান’ আর ‘সঞ্চয়িতা’ হাতে সভাঘরে পালিত হয় রবীন্দ্রজয়ন্তী, নববর্ষ, বিজয়া সম্মিলনী, জানালেন অন্যতম ট্রাস্টি সদস্য সজল বণিক। আর বাংলা বই? কিছু বছর আগে পর্যন্ত ভারতীয় দূতাবাস থেকে নিয়মিত আসত ‘দেশ’, ‘আনন্দমেলা’। এখন সব অতীত। সেনারা কবেই নষ্ট করে দিয়েছে ‘বেঙ্গল একাডেমি’, রক্ষা পায়নি বাংলা বইপত্রও।
অশীতিপর মুরারীমোহন লোধ উল্টে যাচ্ছিলেন মনসা ভাসান গানের বইয়ের পাতা। টেবিলের এক কোণে তাঁর নিজের হাতে তৈরি বাংলা প্রাইমার, এই প্রজন্মের বাঙালি শিশুদের জন্য। এই শিশুরা বাংলা বুঝতে পারলেও বলতে পারে না। কী হবে বাংলা শিখে! বাংলা বইয়ের লাইব্রেরিও নেই। মুরারীবাবু জানালেন, রেঙ্গুনে কেউ পড়ে না, সুদূর আরাকান থেকে আসা নাপিতদের হাতে তুলে দিতে হবে বাংলা প্রাইমার আর চাটগাঁয়ের মনসার ভাসান গান। শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে প্রতি সন্ধ্যায় ওঁদের ঘরের বৌ-মেয়েরা সুর করে মনসার গান পড়ে। সব-হারানো দেশে এইটুকু বাঙালিয়ানা নিয়ে বেঁচে থাকা।
ইয়াঙ্গনের যে ক’জন বাঙালির মধ্যে এখনও পুরনো রেঙ্গুনের স্মৃতি বেঁচে, তাঁদের এক জন শান্তিলাল চৌধুরী। তাঁকে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কথা জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘‘অপেক্ষা করছিলাম প্রশ্নটার। আমার বাপ-ঠাকুরদা কোনও আর্কাইভ রেখে যাননি। শরৎচন্দ্র কোথায় যাতায়াত করতেন, বলতে পারব। কারণ সেটা কাছেই। এর বেশি কিছু জানি না।’’ নিম্ন মধ্যবিত্ত অনিশ্চিত জীবনে আর্কাইভ তুচ্ছ, গুরুত্বহীন। প্রখ্যাত লেখকও তাঁদের কোনও কাজে আসেননি, কেনই বা মনে থাকবে। শরৎচন্দ্রই বা কতটুকু আগ্রহী ছিলেন রেঙ্গুনবাসী স্বদেশীয়দের নিয়ে? রেঙ্গুন থেকে লেখা অজস্র চিঠিপত্রে তেমন পাওয়া যায় না বর্মিদের কথা। তাঁর উপন্যাসে বর্মা শুধুই পটভূমি। ‘পথের দাবী’ উপন্যাসে ভারতী অপূর্বকে বলেছে তারা এসেছে মৌলামিন থেকে, কখনও বা ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসে নায়ক চাকরিসূত্রে গিয়েছে প্রোম শহরে। বর্মি জীবন সে ভাবে উঠে আসেনি। আসলে, বাঙালি লেখকের জীবনের অন্যতম ট্র্যাজেডি ঘটেছিল এই বর্মায়। প্লেগের কবলে এখানেই মারা যান তাঁর প্রথমা পত্নী ও শিশুপুত্র।
রেঙ্গুন নদীর কোলে সন্ধ্যা নামছে, শান্তিলালবাবু চোখ বুজে বলে যাচ্ছিলেন, ‘‘কলেজ স্ট্রিট, কফি হাউস... প্রেসিডেন্সি তো এখন ইউনিভার্সিটি, না? পাশেই ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি।’’ আপনি গিয়েছেন কলেজ স্ট্রিট? ‘‘আমি ইন্ডিয়া কোনও দিন যাইনি।’’ ওঁর ভাই হরিপদবাবু বললেন, ‘‘এর পর এলে কয়েকটা বাংলা বই আনবেন? আমরা কত দিন বাংলা পড়িনি!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy