Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪

সিনেমা কাবেরীকে ভালবেসেছিল, কিন্তু সিনেমা তাঁর সয়নি

এসেছিলেন হিল্লোল তুলে। গৌরবর্ণা নায়িকাদের রাজত্বে একটা শ্যামলা বিদ্যুৎ যেন ঝলসে উঠল! তাঁর অভিনয় ছিল সাবলীল। যদিও তার পরে তিনি উধাও। সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে ফিরে এলেন, কিন্তু টেনে নিয়ে গেল খাদ। কাবেরী বসুকে নিয়ে লিখছেন সোমেশ ভট্টাচার্য হইহই করে দিন কাটছিল। উত্তম-সুপ্রিয়া আসতেন, শ্যামল মিত্র এসে গাইতেন। ললিতা পিয়ানো বাজাচ্ছেন, অমলাশঙ্কর গাইছেন, কাবেরী নাচছেন

শেষ আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

ঝিরঝির করে বৃষ্টি হচ্ছিল। জিপটা গড়িয়ে যাচ্ছিল।

জুনের প্রায় মাঝামাঝি। গড়ানে রাস্তা, পাশে ছোট ছোট কাঠের বাড়ি, খাদের গা ঘেঁষা ঘাসের মাথা, ঝুরো ফুল সব ভিজে স্যাঁতসেঁতে।

খুব তাড়াহুড়ো করছিলেন অজিত। ফ্লাইটের গোলমালে টুপসি আর টুম্বুর আগেই কলকাতায় ফিরে এসেছে। তাই বাগডোগরা থেকে কলকাতার বিমানের সময় পাল্টে নিয়েছেন তিনি, বিকেলের বদলে সকালে। কিন্তু এত সকালে দার্জিলিং কেভেন্টার্সের সামনে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে কোনও ড্রাইভারের পাত্তা নেই! অনেক চেষ্টা করে ডাম্বো নামে এক ছোকরাকে পাওয়া গেল, যে মোটে মাস তিনেক হল লাইসেন্স পেয়েছে।

স্ত্রী আর তিন বছরের টিনাকে নিয়ে অজিত জিপে চড়ছেন, সুব্রত সরকার নামে এক কলেজ-পড়ুয়া এসে ধরল, ‘স্যর, আমি কি আপনাদের সঙ্গে যেতে পারি?’ অজিত বললেন, ‘নো প্রবলেম!’

হিল কার্ট রোড ধরে সেই জিপটাই এখন গড়িয়ে চলেছে। গড়িয়ে না, আসলে হড়কে।

ঘুম, সোনাদা পেরিয়ে আরও কিছুটা নামলে গোরাবাড়ি। সেখানেই একটা বাঁকের কাছে গাড়িটা হুহু করে নেমে যাচ্ছে খাদের দিকে। রোজ ওঠা-নামা করা সব ড্রাইভারই জানে, ভিজে গড়ানে রাস্তায় আচমকা ব্রেক কষতে নেই, চাকা হড়কে যায়। চাকা গড়িয়ে যেতে দেখে ডাম্বো সেটাই করেছে। খাদের মুখে একটা বড় পাথর। সেটা ধাঁ-ধাঁ করে এগিয়ে আসছে। বিপদ বুঝে জিপের হেল্পার পিছনে লাফ দিয়ে বেরিয়ে গেল। ডান দিকের দরজা খুলে লাফ দিল ডাম্বো। অজিত সামনে, মেয়ে নিয়ে পিছনে তাঁর স্ত্রী কাবেরী। তিনি মেয়েকে ছুড়ে দিলেন স্বামীর দিকে, যদি গাড়ি খাদে পড়ার আগেই বাঁ দিকের দরজা খুলে বেরিয়ে যেতে পারেন। অজিত লাফালেনও, কিন্তু মেয়ে কোলে আছড়ে পড়লেন পাথরে। মাথা ফেটে চৌচির। কাবেরী আর সুব্রতকে নিয়ে সাড়ে আটশো ফুট গভীর খাদে ছিটকে পড়ল গাড়ি।

বিয়ের দিন অজিত ও কাবেরী

রাই জাগো, রাই জাগো

নিউ থিয়েটার্সের সুবোধ মিত্র একটি কমবয়সি মেয়ে খুঁজছিলেন, যে নাচ জানে। পাহাড়ী সান্যালের খুব যাতায়াত ‘বসুমিত্র’ প্রযোজনা সংস্থার অন্যতম কর্ণধার গৌরাঙ্গপ্রসাদ বসুর বাড়িতে। তিনিই সন্ধান দিলেন, গৌরাঙ্গের বোন কাবেরী ভাল নাচে।

অনাদিপ্রসাদের ছাত্রী কাবেরী। তার রকমসকম দেখে ভুরু কুঁচকে বাবা বলেন, “এই মাইয়াডা খালি বাঁইক্যা থাকে ক্যান?” কাবেরীর কথায়, “শ্যামা নৃত্যনাট্য করছিলাম। সুবোধ মিত্র দেখতে এসেছিলেন। তিনি অফার দিলেন।”

১৯৫৫ সাল।

তিন বছর আগেই বাংলা ছবিতে তিনকন্যা-র আবির্ভাব ঘটে গিয়েছে। রেঙ্গুন ছেড়ে আসা সুপ্রিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়, আদতে তাঁরা ফরিদপুরের লোক। বরিশালের অরুন্ধতী মুখোপাধ্যায়। আর পাবনার রমা দাশগুপ্ত ওরফে সুচিত্রা সেন। কুমিল্লার সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ও এসে গিয়েছেন। এ বার হাজির ফরিদপুরিয়া কাবেরী বসু, যাকে বলে পুরো ইস্টবেঙ্গল টিম!

২৬ অগস্ট বীণা, বসুশ্রী ও শ্রী প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাবে সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’। তার আগেই, ৮ মার্চ দর্পণা ও পূর্ণ সিনেমায় রিলিজ় করল অরোরা ফিল্মসের ‘রাইকমল’। তারাশঙ্করের গল্প, পঙ্কজ মল্লিকের সুর। সঙ্গে উত্তমকুমার, সাবিত্রী আর নামজাদা চন্দ্রাবতী দেবী, নীতিশ মুখোপাধ্যায়। কিন্তু ছবিটা আসলে কাবেরীর। ফর্সা নায়িকাদের রাজত্বে একটা শ্যামলা বিদ্যুৎ যেন ঝলসে উঠল! বৃন্দাবন বিলাসিনী রাই আমাদের....

রাইকমল কাবেরী

ষোড়শী এক নবাগতা, যে প্রায় একাই একটা ছবি টেনে নিয়ে যেতে পারে, ছেয়ে ফেলতে পারে দর্শককে, বিশ্বাস করা কঠিন। সহজাত বলে হয়তো, পেশাদার রঙ্গমঞ্চের ছোঁয়া-লাগা নয় বলেই বুঝি বা তাঁর অভিনয় এত অ-নাটকীয়, সাবলীল, অন্যদের চেয়ে এত আলাদা।

সে কালের নামী চলচ্চিত্র পত্রিকা ‘রূপমঞ্চ’ লিখল— ‘রাইকমলের ভূমিকায় তিনি যে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন, তাতেই চিত্রজগতে তাঁর স্থায়ী আসন নির্দিষ্ট হয়ে গেছে। সৌন্দর্যে-অভিনয়ে তিনি অনেককেই ছাড়িয়ে যাবেন অতি সহজে।’

খালের ধারে নৌকা বাঁধা

দু’বছরের মধ্যে পরপর আরও সাতটি ছবি— ‘দেবী মালিনী’, ‘দৃষ্টি’, ‘অসমাপ্ত’, ‘পরাধীন’, ‘শ্যামলী’, ‘শঙ্করনারায়ণ ব্যাঙ্ক’, ‘মধুমালতী’। চিত্ত বসুর ‘দৃষ্টি’ আর মধু বসুর ‘পরাধীন’ ছবিতে নায়ক নির্মলকুমার। সদ্য বিরানব্বই ছোঁয়া নায়কের মনে আছে, “কাবেরী ছিল একটু সেন্টিমেন্টাল। আর ভীষণ আবেগপ্রবণ। একেবারে একাত্ম হয়ে যেত চরিত্রের সঙ্গে।” তাঁর মনে পড়ে এক দিনের কথা। ‘‘সে দিন আমার শুটিং ছিল না। হঠাৎ চিত্তদার ভাই, ছবির প্রোডাকশন ম্যানেজার, গাড়ি নিয়ে এসে হাজির। দাদা এক্ষুনি ডাকছেন। গড়িয়ার দিকটা তখন একটু জঙ্গল মতো, ছোট একটা খালে নৌকা বাঁধা। যেতেই চিত্তদা বললেন, ‘কাবেরী বলেছে, নির্মল না এলে শুটিং করব না।’ সে কী! কাবেরী বলল, আরে, আর কোনও আর্টিস্ট নেই, আমি একা। খুব বোরিং লাগছিল,” হাসতে-হাসতে বলেন নির্মলকুমার।

আসলে খুব সহজেই অনেকের আপন হয়ে উঠছিল ছটফটে মেয়েটি। ছবি বিশ্বাস ডাকতেন ‘ছোট্ট গিন্নি’ বলে। যখন-তখন খ্যাপাতেন আর কাবেরী গিয়ে তাঁর পিঠে দু’চারটে কিল মেরে আসত!

১৯৫৩ সালে স্টার থিয়েটারে ‘শ্যামলী’ নাটকে বোবা-কালা মেয়ের চরিত্রে মাত করে দিয়েছিলেন সাবিত্রী, বিপরীতে উত্তম। বছর দুই পরে সেই নাটক থেকে ছবি করলেন অজয় কর। সাবিত্রীর কথায়, “সিনেমা হওয়ার সময়ে টাকাপয়সা নিয়ে আমার সঙ্গে বনল না।” তাঁর জায়গা নিলেন কাবেরী। একটিও স‌ংলাপ নেই, বাঙ্ময় এক জোড়া চোখই কাজ করে দিল।

মেয়ের নাম ভুতু

মধ্যবিত্ত বাঙালি ঘরের মেয়ের তখন সিনেমায় নামা সহজ ছিল না। বাবা যাদবেন্দ্র বসু ছিলেন উকিল, পরে নানা কারবারেও জড়ান। তাঁর স্ত্রী প্রীতিময়ী সম্পন্ন ঘরের মেয়ে। বড় শ্যালক সতীকান্ত গুহ সাউথ পয়েন্ট স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁদের পাঁচ মেয়ের নাম নদীর নামে — যমুনা, জাহ্নবী, সরস্বতী, কাবেরী, কৃষ্ণা। দুই ছেলে গৌরাঙ্গপ্রসাদ, ভবানীপ্রসাদ। ১৯৩৮ সালের ২৮ নভেম্বর কালচেপানা চতুর্থ কন্যাটি ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরে যাদবেন্দ্র নাকি বলেন, ‘‘এডা কে আইসে ভূতের মতো?” সেই থেকে মেয়ের ডাকনাম হয়ে গেল ‘ভুতু’।

এক সময়ে যাদবেন্দ্র আর্থিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। বড় ছেলে গৌরাঙ্গ সংসারের হাল ধরেন, হয়ে ওঠেন প্রকৃত অভিভাবক। তিনি সুলেখক, সম্পাদনা থেকে প্রকাশনায় দক্ষ। পরবর্তী জীবনে আনন্দবাজার গোষ্ঠী ছাড়াও নানা পত্রপত্রিকায় দায়িত্ব সামলেছেন। সে সূত্রে প্রায় পারিবারিক বন্ধু হয়ে ওঠা শিবরাম চক্রবর্তী হামেশাই রাবড়ির ভাঁড় হাতে এসে উদয় হতেন বাড়িতে। কিন্তু গোড়ার দিকে বাল্যবন্ধু শিশির মিত্রের সঙ্গে ‘বসুমিত্র’ প্রযোজনা সংস্থা খুলেছিলেন গৌরাঙ্গ। ১৯৪৮ সালে তাঁদের প্রথম ছবি ‘কালো ছায়া’ বিরাট হিট। দু’জনকেই খুব স্নেহ করতেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, তিনিই ছিলেন এই ছবির পরিচালক।

বাড়িতে সিনেমার আবহাওয়াটা ছিলই। কিন্তু কড়া অনুশাসনও ছিল। বেলতলা গার্লস থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে নায়িকা হয়ে ওঠা কাবেরী বিয়ের আগে পর্যন্ত হলে গিয়ে ‘রাইকমল’ দেখার অনুমতি পাননি!

নায়িকা বিদায়

তখন কাবেরীরা ভাড়া থাকতেন ম্যাডক্স স্কোয়ারের কাছে কুপার স্ট্রিটে। কাছেই ঘোষাল স্ট্রিটে চাটুজ্জেদের বাসা। সে বাড়ির ছোট মেয়ে ললিতা কাবেরীর খুব বন্ধু।

তখন একের পর এক ছবির অফার আসছে। ললিতার ছোড়দা বিদেশ থেকে প্রিন্টিং টেকনোলজি পড়ে এসে আইটিসি-র চাকরি নেওয়া অজিত চট্টোপাধ্যায় ওরফে রানার প্রেমে পড়ে গেলেন কাবেরী। পাত্র ভাল শুধু নয়, পরিবারটি অভিজাত। আদতে হাওড়া জেলার বালির বাসিন্দা তাঁরা। তবে অজিতের বাবা কালীচরণ মিলিটারি অ্যাকাউন্টসে উচ্চ পদে যোগ দিয়ে রাওয়ালপিন্ডি-পঞ্জাব ঘুরে কলকাতায় এসে থিতু হন। তাঁর তিন ছেলে, চার মেয়ে। সকলেই বিদেশে শিক্ষিত, সুদর্শন।

১৯৫৬ সালের জুনে বিয়ে হয়ে গেল। স্বামীর সঙ্গে মুঙ্গের চলে গেলেন কাবেরী। বড় বড় বাংলো, ছড়ানো লন। পুরোপুরি বিলিতি পরিবেশ। কাবেরী নিজের চেষ্টায় রপ্ত করে ফেললেন ইংরেজি। সেই সঙ্গে কুকিং, নিটিং, এমব্রয়ডারি, গার্ডেনিং। সেখানেই জন্ম বড় মেয়ে অনিন্দিতা ওরফে টুপসির। মাদ্রাজের (এখন চেন্নাই) কাছে তিরুভত্তিউরে বদলি হওয়ার পরে জন্মাল ছেলে অনিন্দ্য, ডাকনাম টুম্বুর। পরে ছোট মেয়ে টিনা, নাম রাখা হল কৃষ্ণকলি। সুখের সে সংসারে ছায়াছবির ছায়াটুকু নেই।

কলকাতা কলকাতা

বন্ডেল রোডের ছিমছাম ফ্ল্যাটে বসে টুপসি বলেন— “মা যে বার্নার্ড শ’ থেকে শেক্সপিয়র পড়ে ফেলেছিল, শুধু তা-ই নয়, আমাদের জামাকাপড় সব নিজে বানাত। এনিড ব্লাইটনের নডির ভক্ত ছিলাম আমি। কাপড় সেলাই করে তুলো ঠেসে কত নডি পুতুল বানিয়ে দিয়েছিল আমায়!”

চেন্নাইয়ে সমুদ্রের ধার ঘেঁষা সেই বাংলোর সামনের বাগানে নোনা জল-হাওয়াতেও ৫৫ রকমের গোলাপ ফুটিয়েছিলেন কাবেরী আর ৬২ রকমের ক্যাকটাস। “মাদ্রাজের ওই বাড়িতে অনেকে এসেছেন। রাজেশ খন্না, প্রাণ, ফিরোজ় খান এবং কে জানে কেন, গ্যারি সোবার্স,” টুপসির মনে আছে। ’৬৬-তে যখন অন্য চাকরি নিয়ে দিল্লির কাছে ফরিদাবাদে চলে যাচ্ছেন অজিত, কাবেরী ছোটদের মেলা করে সব গাছ বিলিয়ে দিয়ে গেলেন।

কিন্তু শহর-স্বজন ছেড়ে বাইরে-বাইরে ঘোরা আর পোষাচ্ছিল না অজিতের। ফের চাকরি পাল্টে ’৬৮ সালে চলে এলেন কলকাতায়।

রাসবিহারী অ্যাভিনিউ আর শরৎ বোস রোডের (তখন ল্যান্সডাউন রোড) মোড়েই থাকতেন অজিতের ছোট বোন, অভিনেত্রী ললিতা চট্টোপাধ্যায়। সেখানেই বাঁধা হল বাসা। হইহই করে দিন কাটছিল। সপ্তাহান্তে আড্ডা, নাচ-গান। উত্তম-সুপ্রিয়া আসতেন, শ্যামল মিত্র এসে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান ধরতেন। গাইতেন উত্তমও। কোনও দিন বা ললিতা পিয়ানো বাজাচ্ছেন, অমলাশঙ্কর গাইছেন, কাবেরী নাচছেন। অমলা-কন্যা মমতাশঙ্কর বলেন, “তখন আমি ছোট। কিন্তু পরে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ছবিতে কাবেরী মাসির আশ্চর্য স্বাভাবিক অভিনয় আমার চোখে লেগে আছে।”

অরণ্যের দিনরাত্রি

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস নিয়ে ছবি করছেন সত্যজিৎ রায়। তাঁর কাছ থেকে প্রস্তাব এল অভিনয়ের। বেশির ভাগ শুটিং পলামুর জঙ্গলে। তিন ছেলেমেয়েকে রেখে কাবেরী যান কী করে? অজিত বললেন, ‘‘মানিকদা এত করে বলছেন, করেই ফেলো। ছেলেমেয়ে আমি সামলে নেব।”

‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ছবিতে শুভেন্দু ও কাবেরী

পাক্কা বারো বছর পরে ক্যামেরার সামনে ফেরা। ‘রাইকমল’ বা ‘শ্যামলী’র সেই ছিপছিপে মেয়েটি আর নেই। ছবির চিত্রগ্রাহক সৌম্যেন্দু রায়ের স্মৃতি বলছে, “একটু ভারী হয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু সেটা চরিত্রের সঙ্গে মানানসই। কোনও আড়ষ্টতা ছিল না। ভীষণ স্বাভাবিক অভিনয়।” গোটা ছবিতে মাত্র দু’টি দৃশ্য, ইন্দ্রপুরী স্টুডিয়োর সেটে তোলা ভাটিখানা আর কাবেরীর বাড়িতে শুভেন্দুর কফি খেতে আসা। এই দ্বিতীয় দৃশ্যটি কে ভুলবে, যেখানে আপাতলঘু এক অকালবিধবা হঠাৎই লাল শাড়ি (পর্দায় দেখায় কালো) আর গয়নাগাঁটিতে সেজে নার্ভাস তরুণের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়!

ছবির অন্যতম প্রযোজক অসীম দত্তের স্ত্রী পূর্ণিমা দত্ত বলেন, “ওই সময় থেকেই কাবেরীর সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। ভীষণ শান্ত সুন্দর স্বভাবের একটা মেয়ে ছিল ও।”

অরণ্য থেকে পর্বতে

‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ মুক্তি পেল ১৯৭০ সালের ১৬ জানুয়ারি। ছবির প্রিমিয়ারে বারো বছরের টুপসিকে নিয়ে গিয়েছিলেন কাবেরী। ছবি দেখে সে হতাশ— “কিছুই তো অ্যাক্টিং দেখলাম না মা! তুমি তো এ রকমই!” সত্যজিৎ বললেন, “দ্যাখো, মেয়ের কাছ থেকে সবচেয়ে বড় কমপ্লিমেন্টটা পেয়ে গেলে, যে দেখে অ্যাক্টিং বলে মনেই হচ্ছে না!”

দেখতে-দেখতে জুন।

পূর্ণিমা বলেন, “সে বার দার্জিলিং গিয়েছিলাম ছুটি কাটাতে। আমরাই কাবেরীদের ফোন করে বলি, চলে এসো, দারুণ ওয়েদার।”

সকলেরই যাওয়ার কথা। কিন্তু মাদ্রাজের পড়শি আন্টি ডেকেছেন টুপসি-টুম্বুরকে। অজিত দমদম থেকে তাদের ফকার ফ্রেন্ডশিপ প্লেনে তুলে দিলেন। ফেরার সময়ে আন্টি আবার তুলে দেবেন, কাবেরীরা একই সময়ে বাগডোগরা থেকে উড়ে আসবেন দমদমে, এই রইল কথা।

পূর্ণিমা বলেন, “কয়েকটা দিন খুব মজায় কেটেছিল দার্জিলিঙে। আমরা আগে নেমে যাই। ওরা আর ক’টা দিন কাটিয়ে আসবে।”

১২ জুন ১৯৭০

পরিচিত এক জ্যোতিষী কাবেরীকে বলেছিলেন, উঁচুতে ফাঁড়া। ফরিদাবাদে থাকার সময়ে উইকএন্ডে দিল্লি ড্রাইভ ছিল বাঁধা। সে কালে কুতুব মিনারে উঠতে দেওয়া হত। বাকিরা উঠলেও কাবেরী ওঠেননি। দার্জিলিং পাহাড়ও যে উঁচু, তা বুঝি তাঁর মাথায় আসেনি!

পাথরে আছড়ে পড়েও বেঁচে ছিল বাবার কোল আঁকড়ে থাকা টিনা। দার্জিলিঙের ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে মারা যান অজিত। বয়স তখন মোটে বিয়াল্লিশ, কাবেরী বত্রিশ। টিনা মারা গেল পর দিন। ছোট্ট শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল না। ডাক্তারেরা বললেন, ‘শক’।

পাহাড়ি গাঁয়ের লোকজন অচেতন কাবেরী আর সুব্রতকে গাড়ি থেকে বার করে এনেছিলেন। হাড়গোড় চুরমার। ভিক্টোরিয়ায় শুরু হল দীর্ঘ লড়াই। শুধু মুখেই পড়ল ৩৭টা স্টিচ। মাস তিনেক পরে পিজি হাসপাতালের উডবার্ন ওয়ার্ড, সেখানেও তিন মাস।

শেষে ছুটি পেয়ে যোধপুর পার্কে ভাড়া করা নতুন বাসায় এসে উঠলেন কাবেরী। প্রায় শয্যাশায়ী। কী করে ছেলেমেয়ে মানুষ করবেন? টুপসিকে লোরেটোয় আর টুম্বুরকে সেন্ট পলসে বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে দিলেন, সেই দার্জিলিঙেই!

যেখান থেকে গাড়িটা পড়েছিল, এলাকার লোকে পরে সেখানে একটা ছোট্ট মন্দির করে দেয়। কিন্তু এত বড় আঘাতও কাবেরীকে দমাতে পারেনি। তিনি মরিয়া জেদে জীবনে ফিরতে শুরু করলেন।

১৯৭১ সালে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র জন্য কাবেরীকে পার্শ্বচরিত্রে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার দিল বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্টস অ্যাসোসিয়েশন। আর তপন সিংহের ‘সাগিনা মাহাতো’র জন্য সেরা অভিনেতার পুরস্কার নিতে এলেন দিলীপকুমার। কাবেরী তাঁকে দুপুরে বাড়িতে ডেকে খাওয়ালেন।

সে বছর জুনেই গরমের ছুটিতে ছেলেমেয়েকে দেখতে আবার দার্জিলিং চলে গেলেন কাবেরী। প্রায় হাঁটতে পারেন না তখনও। সেন্ট্রাল হোটেলে গিয়ে উঠতেন। ছেলেমেয়েরা চলে আসত। তারা যখন ঘুরতে যেত, ডাক্তার আসতেন, ইঞ্জেকশন দিয়ে যেতেন। এ ভাবেই চলেছে বছর দুই। ’৭৩-’৭৪ সাল থেকে একটু-একটু বেরোতে পারতেন, গ্লেনারিজ়ে যেতেন বা হাঁটতেন ম্যাল পর্যন্ত।

ঘরেও না, বাইরেও না

দুর্ঘটনার পরে ছ’বছরে মোট ২২টি অস্ত্রোপচার! শারীরিক যন্ত্রণা, স্মৃতির ভার আর ভয়ঙ্কর একাকিত্ব। ঘরে-বাইরে শান্তি পাচ্ছেন না কিছুতেই। বাড়িতে আড্ডা দিতে আসার লোকও বেশি নেই। উত্তম-সুপ্রিয়া নিয়মিত আসেন। মাঝেমধ্যে শমিত ভঞ্জ। বাড়ছিল টাকার প্রয়োজন। বসে খেলে যখের ধনও শেষ হয়। তার উপর চিকিৎসার খরচ।

এরই মধ্যে ‘অগ্রগামী’র সরোজ দে এসে জানালেন, রমাপদ চৌধুরীর গল্প নিয়ে করছেন ‘যে যে‌খানে দাঁড়িয়ে’। কাবেরীকে নায়িকা চান, বিপরীতে দীপঙ্কর দে। বিহারের গোমিয়ায় শুটিং। দীপঙ্করের মনে আছে, “তখনও পুরো সুস্থ নন কাবেরী। হাঁটতেও অসুবিধে হত।” ছবিতে ছোট্ট এক টিলার উপরে তাঁদের একটি চুম্বন দৃশ্য ছিল, যা জলের প্রতিবিম্বে দেখা যাবে। “গ্রীষ্মের চাঁদিফাটা রোদ আর অজস্র ছোট ছোট পোকা। ওই দৃশ্যের পরে কাবেরী অজ্ঞান মতো হয়ে যান। ধরাধরি করে নামিয়ে গেস্ট হাউসে নিয়ে যাওয়া হয়,” বললেন দীপঙ্কর।

সেই ছবির মুক্তি ’৭৪ সালে। কিন্তু ১৯৭৩-এই আর একটি ঘটনা ঘটে যায়। কাবেরীর আত্মীয়বর্গের একটি সূত্রের খবর, ‘সাগিনা মাহাতো’র প্রযোজক হেমেন গঙ্গোপাধ্যায় সন্দীপ, নিখিলেশ ও বিমলার চরিত্রে উত্তম, সৌমিত্র আর কাবেরীকে নিয়ে ‘ঘরে বাইরে’ করার তোড়জোড় করছিলেন। এক রাতে যোধপুর পার্কের বাড়িতে এসে তিনি জানান, সত্যজিৎ রায় রাজি হয়েছেন। গৌরাঙ্গ আর শিশিরও তখন সেখানে হাজির। কয়েক দিন পরেই, ’৭৩ সালের ১৯ মার্চ রাঁচির বাড়িতে এক কুয়োয় হেমেনের মৃতদেহ মেলে। তবে সত্যজিৎ-পুত্র সন্দীপ রায় বলেন, “উত্তমবাবু এবং সৌমিত্রকাকুকে নিয়ে একটা কথা হয়েছিল বটে, সেটা বেশি দূর গড়ায়নি। কিন্তু কাবেরীদির কথা আমার মনে পড়ছে না। বাবার কোনও খাতাতে এমন কিছু পাইনি।”

কান্না-হাসির দোলা

‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ছবিতে যে চরিত্রে কাবেরী অভিনয় করেছিলেন, সে-ই যেন জীবন্ত হয়ে উঠল। নিঃসঙ্গ এক তরুণ বিধবা, যে জীবনের কাছে, তার ধুকপুকে আহ্লাদের কাছে আর এক বার ফিরে আসতে চায়। বিজন ঘরে কাবেরী তখন টুকটাক কবিতা লিখছেন, বাংলায়, ইংরেজিতে। তাঁর আকুতি স্পষ্ট সে সব কবিতায়। লিখছেন— ‘Every soul has its private sorrow,/ Every bird has its own distance to fly...’ লিখছেন— ‘I have learnt, there is a fire in my heart’

শিশির মিত্রের ছেলে সজল থাকতেন গড়িয়াহাট রোডে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পাশের বাড়িতেই। কাবেরী এক দিন বললেন, “সুনীলকে একদিন নিয়ে আয়।” সুনীল রাজি। ৮বি বাস ধরে দু’জনে চলে গেলেন যোধপুর পার্ক। অনেক আড্ডা হল, কবিতা পড়া হল।

সিনেমাও আসছিল ফিরে-ফিরে। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের গল্প নিয়ে ’৭৫ সালে ‘আমি, সে ও সখা’। উত্তম আর অনিল চট্টোপাধ্যায়ের পাশে কাবেরী। তিনি তখন অনেকটা চাঙ্গা। ছবি হিট! (পরে এই গল্পে অমিতাভ বচ্চন, বিনোদ মেহরা, রাখিকে নিয়ে ‘বেমিসাল’ করেন হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়)। ওই বছর ‘যাত্রিক’-এর হয়ে দিলীপ মুখোপাধ্যায় করলেন ‘নগরদর্পণে’। উত্তম, কাবেরী, সাবিত্রী, দিলীপ নিজে।

সে-ই শেষ। পরের বছর পাকস্থলীর ক্যানসার ধরা পড়ল।

ডার্বি ডার্বি ডাবি

১৯৭৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। সে দিন ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান খেলা। কাবেরীর গা যেন জ্বলে-পুড়ে যাচ্ছে। বরফ চিবোচ্ছেন। টুপসি গায়ে বরফ ঘষে দিচ্ছেন। ইস্টবেঙ্গল জিতেছে। টেন্টে বিরাট হইচই। তারই মধ্যে টুপসির ফোন ধরে ক্লাবের সেক্রেটারি ডা. নৃপেন দাস বললেন, “ক্লাব হাউস থেকে বেরোতে পারছি না, তুমি শিগগির হাসপাতালে ভর্তি করো।”

রবিনসন স্ট্রিটে নিউ ইউনিয়ন নার্সিংহোমে ভর্তি করা হল। সারাটা রাত টুপসি বসে মায়ের কাছে। ভোর চারটে পর্যন্ত টানা কথা বলে চলেছেন কাবেরী— ভাল থাকবে, সিনেমায় একদম নামবে না, ভাইকে দেখে রেখো... শেষ দিকে কথাবার্তা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। ভোরে কোমায় চলে গেলেন। ১৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ সব শেষ।

জীবন যে রকম...

বছর দুই আগে সাউথ পয়েন্ট স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপ্যালের পদ থেকে অবসর নিয়েছেন টুপসি, এখন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় যুক্ত। টুম্বুর গত হয়েছেন চার বছর হল। কাবেরীর বড়দি যমুনা গুহ আর পিঠোপিঠি ছোট বোন কৃষ্ণা সেনগুপ্ত রয়েছেন।

টুপসির দুই মেয়ের নামও নদীর নামে— মেঘনা আর তিস্তা। তিস্তাকে অনেকটা কাবেরীর মতোই দেখতে।

এখনও বাক্স-প্যাঁটরায় রাখা আছে ছেঁড়া কিছু ডায়েরির পাতা। তার কোনওটায় লেখা— ‘বলিল কতজনে আমারে ভালবাসে ... সে শুধু বলিল না রহিল সে বিমুখ!’ কোনওটায়— ‘My dearest God/ For a change, do give me a little time,/ And listen...’

সিনেমা কাবেরীকে ভালবেসেছিল খুব, কিন্তু সিনেমা কাবেরীর সয়নি।

ঋণ: অভিজিৎ গোস্বামী, সজল মিত্র, মিমি ভট্টাচার্য, প্রণব ও কৌশিক চট্টোপাধ্যায়, কিরণকুমার রায় (আনন্দলোক), Bengali Film Directory (Ed. Ansu Sur)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy