Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

যুক্তিহীন, মাত্রাহীন ‘অ্যাক্সিডেন্টাল’কে ‘সত্য’ বলে চালানোর চেষ্টা

যে কোনও ঘটনাকেই ঘিরে থাকে অসংখ্য প্রেক্ষিত। নানা মাত্রায়।

স্যমন্তক ঘোষ
শেষ আপডেট: ১২ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share: Save:

সত্য কী?— তমসার তীরে উদ্বিগ্ন বাল্মীকি। রামায়ণের কাহিনি ভেবে ফেলেছেন। কিন্তু পাছে সত্যভ্রষ্ট হন, এই ভয় তাড়া করে ফিরছে। এমনই এক সময়ে তাঁর সঙ্গে দেখা হল নারদের। বাল্মীকি-নারদের সেই সাক্ষাৎ দৃশ্যে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘নারদ কহিলা হাসি, ‘‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি, ঘটে যা তা সব সত্য নয়।’’

যে কোনও ঘটনাকেই ঘিরে থাকে অসংখ্য প্রেক্ষিত। নানা মাত্রায়। সেখান থেকে সত্য খুঁজে বার করা সহজ নয়। সে কারণে, একই ঘটনার অসংখ্য ব্যাখ্যা তৈরি হয়। অন্য ব্যাখ্যা খণ্ডন করতে করতে যে ব্যাখ্যা নিজের যুক্তির বুনট সব চেয়ে বেশি শক্ত করতে পারে, জনমানসে তা সত্যের কাছাকাছি পৌঁছয়।

প্রাক নির্বাচনী পর্বে পরিচালক বিজয় গুট্টে যে ছবি বাজারে আনলেন, তাতে না আছে যুক্তি, না আছে মাত্রা। অথচ তাকে ‘সত্য’ বলে চালানোর চেষ্টা হচ্ছে। ‘দি অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার’ ছবিটিকে একমাত্রিক বললেও বাড়িয়ে বলা হয়।

অথচ ঘটনা অসত্য নয়। ২০০৪ থেকে ’১৪ পর্যন্ত দু’পর্বে ইউপিএ সরকারের আমলে নাটকের অভাব ছিল না। সরকার গঠনের সূচনা পর্বেই নাটকীয় ভাবে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন সনিয়া গাঁধী। প্রস্তাব করেছিলেন মনমোহন সিংহর নাম। কেন করেছিলেন? ব্যাখ্যা অনেক। তাতে মনের মাধুরী যেমন আছে, আছে তথ্যও। যে বইয়ের আধারে বিজয় তাঁর ছবি তৈরি করেছেন বলে দাবি, সাংবাদিক ও মনমোহনের প্রাক্তন মিডিয়া উপদেষ্টা সঞ্জয় বরু তাঁর নিজের মতো করে একটি ব্যাখ্যা তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন ‘দি অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার’ বইয়ে। ভারতীয় রাজনীতিতে সেই ব্যাখ্যা বিতর্কিত, তবে ফেলে দেওয়ার নয়। নিজের বক্তব্যের সপক্ষে বরু যুক্তি সাজিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর চোখ দিয়ে সত্যকে বুঝতে গিয়ে বিজয় যা দেখালেন সিনেমায়, তাতে বরুর মতটিকেই একমাত্র বলে ধরে নেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন: ‘মনমোহন-চিত্রে’ দর্শক ডেকেও নিরাশ বিজেপি

দি অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার পরিচালনা: বিজয় গুট্টে অভিনয়: অনুপম, অক্ষয়, সুজান, আহানা, অর্জুন ৩.৫/১০

ছবিতে সেই সত্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বিজয় যে চিত্রনাট্য রচনা করেছেন, তার সঙ্গে সাস-বহুর টেলিসোপের বিশেষ তফাত নেই।

গল্পকারের অধিকার আছে নিজের মতো করে কাহিনির প্রেক্ষাপট তৈরি করার। তা যে সত্য হতেই হবে, এমন কোনও মাথার দিব্যি নেই। পৃথিবী জুড়ে চিত্র পরিচালকেরা গল্পের গরু মহাকাশে পাঠাচ্ছেন। ইউপিএ আমলের প্রেক্ষাপটে বিজয়ও এমন এক গল্প তৈরি করতেই পারতেন। প্রথাগত সতর্কবার্তায় বলে দিতেন— ‘ফিকশন, তবে সত্য ঘটনা অবলম্বনে।’ ল্যাটা চুকে যেত। কিন্তু বিজয়ের তো দাবি, তিনি সত্য বলছেন। ছবিতে নেতা-মন্ত্রীদের নাম পর্যন্ত অপরিবর্তিত। ফলে স্বাভাবিক কারণেই তিনি পক্ষপাতদুষ্ট, এই অভিযোগ উঠছে।

সত্য কী?— একদা এই প্রশ্ন নিয়েই ছবি বানিয়েছিলেন আকিরা কুরোসাওয়া। ‘রশোমন’। একই ঘটনার নানা ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বুঝিয়েছিলেন, সিনেমাকেও বাস্তবের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া যায়। এবং সেই প্রক্রিয়ায় দর্শককে পৌঁছে দেওয়া যায় তাঁর নিজস্ব মতামতের কাছাকাছি।

বিজয়ের ছবিতেও সেই সুযোগ ছিল। সিনেমার প্রেক্ষাপটে যে সময় তিনি বেছে নিয়েছেন, সেখানে একাধিক মাত্রা তৈরির, ব্যাখ্যা খোঁজার সুযোগ ছিল। যে দেশের নেতারা প্রধানমন্ত্রীর সিংহাসন দখল করতে ইঁদুর দৌড়ে সামিল হন, সে দেশে সেই চেয়ার ছেড়ে দিচ্ছেন কেউ, এমন ঘটনা স্বাধীনতোত্তর ভারতে বিরল। পরবর্তী ১০ বছরে ঘটবে আরও অনেক আশ্চর্য ঘটনা। বামেরা সমর্থন করবে কংগ্রেসকে। পরমাণু চুক্তির মতো একটি ‘গিমিকহীন’ বিষয় সরকার ফেলে দেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি করবে। একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ উঠবে। কংগ্রেসের ভিতরে অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রকট হবে। একটি ‘সাধারণ’ অর্ডিন্যান্সকে কেন্দ্র করে সরকার বনাম রাহুল গাঁধী বিতর্ক নাটকীয় মোড় নেবে। বরু এ সব ঘটনাই নিজের মতো করে দেখার চেষ্টা করেছিলেন। কারণ এর অনেক কিছুই প্রধানমন্ত্রীর দফতরে বসে দেখেছিলেন তিনি। কিন্তু সিনেমায় বরুর যুক্তিগুলিকেও দেখানোর চেষ্টা হয়নি। বরুর চরিত্রটিকে কষ্টিপাথর ধরে নিয়ে ছবিতে দু’টি পক্ষ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। যার একদিকে ‘হিরো’ বরু এবং ‘বেচারা’ মনমোহন আর অন্য দিকে ‘ভিলেন’ সনিয়া-রাহুল-আহমেদ পটেল। পর্দায় আরও কিছু নেতা-আমলা ঘোরাঘুরি করলেন বটে, কিন্তু তাঁরা না থাকলেও গল্পের বিশেষ ক্ষতি হতো না। বরং কোথাও কোথাও চেষ্টা হল, বিরোধী বিজেপি নেতাদের গুরুত্ব তৈরির। ‘আহারে’ বলে তাঁরা মনমোহনের পাশে দাঁড়ালেন।

এ ছবিতে হিরো আসলে বরুর চরিত্রে অক্ষয় খন্না। চিত্রনাট্যের দাবি তিনি পালন করেছেন। তবে চরিত্রটি কতটা বাস্তব? প্রধানমন্ত্রীর অফিসের যে নিস্তরঙ্গ একমাত্রিক চেহারা দেখানো হয়েছে, বাস্তবের সঙ্গে তা মেলে তো? আমলাদের ভিতরের রাজনীতি, রাজনীতিকদের সঙ্গে আমলাদের সম্পর্ক— এ সব কিছুর ধারেকাছেও পৌঁছনোর চেষ্টা করেননি পরিচালক। ফলে ঘটনাপ্রবাহে আসল রাজনৈতিক জটিলতাই ধরা পড়েনি। কংগ্রেসের ভিতরের যে দ্বন্দ্ব ছবির মূল প্রতিপাদ্য, তা শেষ পর্যন্ত অন্ধকারেই থেকে গিয়েছে।

লং শটে মনমোহনের চরিত্রে অনুপম খের বেশ। তবে ক্লোজ় শটে মনে হয়েছে, মনমোহনের কিছু ফুটেজ ধরিয়ে দিয়ে অনুকরণের হোমওয়র্ক দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। অনুকরণ অভিনয় নয়। অনুপম ‘মিমিক্রি’ করেছেন।

গল্পে সনিয়ার চরিত্রে সুজান বার্নার্ট দৃশ্যত মানিয়ে গিয়েছেন। তবে তাঁর চরিত্রে হাসি নেই, অভিব্যক্তি নেই, এমনকী, কোনও রাজনীতিও নেই। যেন প্রতিটি শটের আগে নিমপাতার রস খাইয়ে তাঁকে বলে দেওয়া হয়েছিল, কাঠের পুতুলের মতো চিত্রনাট্য উগরে যেতে হবে। আর রাহুলের চরিত্রে অর্জুন মাথুর অতি-অভিনয়ের পুরস্কার পাবেন।

সত্য কী?—‘দি অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার’ কোন সত্যে পৌঁছল তবে? ‘দুষ্টু’লোকেরা বলছেন প্রোপাগান্ডায়। ছবির শেষে রাহুল-মোদীর আসল প্রচারের ফুটেজ সেই বিতর্কেই ধোঁয়া দিল না তো? উত্তর তো জানাই!

অন্য বিষয়গুলি:

The Accidental Prime Minister Anupam Kher
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE