চলছে প্রশিক্ষণ। —নিজস্ব চিত্র।
গোবর গোহের দিন গিয়েছে। ক্রিকেট-ফুটবল-টেনিসের রমরমায় খেলার দুনিয়ায় কুস্তি এখন দুয়োরানি। তবু কলকাতা শহরের বাইরেও জেলার কিছু ছেলেমেয়ে আজও মেতে রয়েছে বীর পালোয়ানের এই খেলায়। মনের টানেই কুস্তি শিখছে নবদ্বীপ, বাগনান, কান্দির মতো রাজ্যের নানা প্রান্তের যুবক-যুবতীরা।
এগিয়ে যাওয়ার পথটা অবশ্য মসৃণ নয়। বেশিরভাগ জেলাতেই কুস্তির আধুনিক প্রশিক্ষণের বন্দোবস্ত নেই। তাই উজিয়ে কলকাতা আসা ছাড়া গতি নেই। সমস্যা সেখানেও। কুস্তি শিখতে আগ্রহীরা বেশিরভাগই মধ্যবিত্ত বা দরিদ্র পরিবারের। ফলে, কলকাতায় যাতায়াত, থাকা-খাওয়ার খরচ জোগাড়ে সমস্যা হয়। আর্থিক সমস্যা ও ভাল খাবারের অভাবে এদের মধ্যে খুব কমজনই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকেন।
মেয়েদের সমস্যা আরও বেশি। একে তো মেয়েদের কুস্তি শেখার পৃথক বন্দোবস্ত বেশিরভাগ আখড়াতেই নেই। তার উপর রয়েছে মেয়েদের কুস্তি শেখা নিয়ে নানা ছুঁতমার্গ। রাজ্য বা জাতীয় স্তরে সাফল্য পাওয়ার পরেও মহিলা পালোয়ানদের তাই শুনতে হয়, মেয়েরা আবার কুস্তি করে নাকি?
এই সব বাধা পেরিয়েই এগিয়ে চলেছে পালোয়ানরা। ২০১৩ সালের নভেম্বরে ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে বসেছিল জাতীয় কুস্তির আসর। ৩৪টি রাজ্যের মধ্যে বাংলার মেয়েরা দলগত ভাবে সপ্তম স্থান পেয়েছিল, ছেলেদের দল হয়েছিল নবম। সাম্প্রতিক কালে এটি বাংলার সেরা ফল। গত মার্চে জোড়াবাগানে পঞ্চানন ব্যায়াম সমিতিতে রাজ্য কুস্তির আসরেও জেলার ছেলেমেয়েদের যোগদান বেড়েছে। চলতি মে মাসের শেষে আবার বসচে চলেছে জাতীয় জুনিয়র কুস্তির আসর।
জেলার ছেলেমেয়েরা মূলত কলকাতার জোড়াবাগানে পঞ্চানন ব্যায়াম সমিতিতেই কুস্তি শিখতে আসে। বড়বাজার ও শিয়ালদহ চত্বরেও কিছু আখড়া রয়েছে। তবে জোড়াবাগান ছাড়া অন্যত্র মেয়েদের কুস্তি শেখার ব্যবস্থা নেই। বর্তমানে এখানে সাব জুনিয়র ও জুনিয়র স্তরে ৩৫ জন মেয়ে কুস্তি শেখে। সিনিয়র পর্যায়ে কুস্তি শেখে ২০ জন মেয়ে। ছেলেদের সংখ্যা আরও বেশি। বেশিরভাগ মেয়েই গ্রামের। জোড়াবাগানের আখড়ার শিক্ষিকা রুনু ঘড়ুইও থাকেন গ্রামীণ হাওড়ার শলপ তেঁতুলকুলিতে। তিনি বাংলার জুনিয়র কুস্তি দলের কোচ। বিবাহিত এই তরুণীর আক্ষেপ, “হাওড়ার অনেক প্রত্যন্ত এলাকা থেকে ছেলেমেয়েরা কুস্তি শিখতে কলকাতায় আসেন। যাঁদের অনেকের বাড়িতেই ভাল করে খাবার জোটে না।”
তাই সাফল্য পেলেও কুস্তির জগতে কতদিন থাকতে পারবেন জানেন না মহিলা পালোয়ানদের অনেকেই। হাওড়ার বাগনানের মেয়ে মিতালি জানা গত নভেম্বরে জাতীয় কুস্তি প্রতিযোগিতার ৪৮ কেজি বিভাগে পঞ্চম স্থান হয়েছিলেন। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস স্মাতকোত্তরের এই ছাত্রী বলেন, “প্রথমে কবাডি খেলতাম। সেখান থেকে কুস্তিতে। কিন্তু বাড়ির লোক আর কয়েকজন বন্ধু ছাড়া কারও সমর্থন পাই না। জানি না এ ভাবে কত দিন টানতে পারব।”
নদিয়ার নবদ্বীপ থেকে সপ্তাহে চার দিন কলকাতায় আসেন বছর পঁচিশের কাকলি দেবনাথ। ২০১২ সালে উত্তরপ্রদেশে হওয়া জাতীয় কুস্তিতে বাংলার হয়ে প্রতিনিধিত্ব করলেও ইংরেজি স্মাতকোত্তর দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা থাকায় গত বছর ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে নামতে পারেনি কাকলি। তাঁর কথায়, “আমার দিদির এক বান্ধবী কুস্তি লড়ত। তার হাত ধরেই উচ্চ মাধ্যমিকের পরে এই খেলাতে আসি। কিন্তু রোজ ৭ ঘণ্টা যাতায়াত করে কলকাতায় এসে কুস্তি শেখা কত দিন সম্ভব হবে জানি না।”
জেলায় ভাল আখড়া না থাকার আক্ষেপ রয়েছে পুরুষ কুস্তিগিরদেরও। মুর্শিদাবাদের কান্দির বাসিন্দা সুদীপ্ত ঘোষের দাদু কুস্তি লড়তেন। এখন কলকাতার এসে কুস্তি শেখে সুদীপ্ত। কান্দি কমার্স কলেজের এই ছাত্র জানায়, জেলায় আধুনিক আখড়া না থাকায় খুবই সমস্যা হয়।
জেলা স্তরে কুস্তির আখড়াগুলিতে প্রশিক্ষণ চলে মাটি অথবা বালিতে। অথচ প্রতিযোগিতায় লড়াই হয় ‘ম্যাটের’ উপর। জেলার কুস্তি কর্তাদের অভিযোগ, ম্যাট-সহ আধুনিক পরিকাঠামো তৈরির সামর্থ তাদের নেই। বর্ধমান জেলা কুস্তি সংস্থার সম্পাদক পাকুন পাল বলেন, “আমাদের জেলায় ৪টি কুস্তির আখড়া রয়েছে। অনেকেই কুস্তিতে আগ্রহী। কিন্তু আধুনিক সরঞ্জাম না থাকায় সমস্যা হচ্ছে।” এর মধ্যে থেকেই গত মার্চে রাজ্য মিটে বর্ধমানের মেয়ে মিতালি সিংহ সোনা পেয়েছেন।”
সমস্যা মানছেন অল ইন্ডিয়া কুস্তি ফেডারেশনের সহ-সভাপতি তথা রাজ্য কুস্তি সংস্থার সম্পাদক অসিতকুমার সাহাও। তাঁর কথায়, “জেলা স্তরে আধুনিক পরিকাঠামো যুক্ত আখড়া গড়ে না তুলতে পারলে কুস্তির জাতীয় স্তরে আমরা সাফল্য ধরে রাখতে পারব না।” ইতিমধ্যে রাজ্য সরকার ও কলকাতা পুলিশের যৌথ উদ্যোগে কলকাতার কয়েকটি মেয়েদের স্কুলে কুস্তি শেখানো শুরু হয়েছে। এমন উদ্যোগ জেলা স্তরেও প্রয়োজন বলে মানছেন অসিতবাবু।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy