অসহায় দর্শক বোরহা আর অর্ণব। গোল করার পথে সনি নর্ডি।
মুম্বই ৩ (সনি ২, সুনীল পেনাল্টি)
আটলেটিকো ২ (হিউম পেনাল্টি, আরাতা)
সনি নর্ডির নাম শুরুতে সাউন্ড সিস্টেমে ঘোষণা হতেই যুবভারতীর কিছু গ্যালারিতে উচ্ছ্বাসের ঢেউ আছড়ে পড়েছিল।
জোড়া গোলের নায়ক হাইতি স্ট্রাইকার যখন উচ্ছ্বাসে স্টেডিয়াম চক্কর মারতে গেলেন, তখন এক এটিকে সমর্থক ফেন্সিংয়ের সামনে এসে তাঁর দিকে ছুড়ে দিলেন সবুজ-মেরুন পতাকা। সোনালি চুলের সনি সেটা দ্রুত ঢুকিয়ে নিলেন তাঁর নীল জার্সির ভিতর। মুম্বইয়ের পাট চুকিয়ে সামনের সপ্তাহেই তাঁকে আবার কলকাতায় ফিরে আসতে হবে। ফিরে আসতে হবে সঞ্জয় সেনের ডেরায়। তারই আবাহন হয়ে গেল শুক্রবার আইএসএলে মঞ্চে! সনি বলেও গেলেন, ‘‘আই লিগে মোহনবাগানেই খেলব।’’
ঠিক তার আগের মুহূর্তেই অন্য এক ছবি দেখা গেল মাঠের অন্য দিকে। আটলেটিকো কলকাতার বেঞ্চে।
সাদা জামার উপর পরে থাকা হলুদ বিব রাগে ছুড়ে দিয়ে ড্রেসিংরুমে ফিরে গেলেন আন্তোনিও লোপেজ হাবাস। সবার আগে। কারও সঙ্গে হাত না মিলিয়ে।
লিগ টেবলের লাস্ট বয়ের কাছে তিন গোল খাওয়ার যন্ত্রণা না, সনি নর্ডি নামক এক আগুনে গতির কাছে হেরে জয়ের হাইওয়ে থেকে হঠাৎ-ই ছিটকে যাওয়া— কোনটা চ্যাম্পিয়ন কোচের গটগট করে বেরিয়ে যাওয়ার কারণ, বোঝা গেল না। তবে এটা মালুম হল, এই হারে শেষ চারে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ না হলেও অশনি সঙ্কেত দেখছেন কলকাতা দলের স্প্যানিশ কোচ। গোল দিয়ে গোল খাওয়ার পুরনো রোগ যে আবার টিমে বাসা বাঁধল। শেষ মিনিট পর্যন্ত লড়াই করার সেই জেদটাও যে হারিয়ে গিয়েছে! না হলে, ইনজুরি টাইমের গোলে চ্যাম্পিয়নরা কখনও হারে?
হারটা অবশ্য দেখে গেলেন না আর এক সাদা শার্টের দেব। অপর্ণা সেনের নতুন ছবির প্রচারে ফুটবল মাঠে গান গাইতে এসে যখন গ্যালারিতে বসলেন অভিনেতা-সাংসদ, তখনই কলকাতার গোলে বল ঢোকালেন সনি। আর দেব যখন বেরিয়ে গেলেন, তখন হিউমের পেনাল্টিতে কলকাতা ১-১ করে ফেলেছে।
টুর্নামেন্ট সংগঠকদের এক প্রধান কর্তা ম্যাচ চলাকালীন বলছিলেন, আইএসএলে এখনও পর্যন্ত কোনও দল পরপর চারটে ম্যাচ জেতেনি। কলকাতা পারবে তো? তাঁর আশঙ্কাই ঠিক— রেকর্ড অক্ষত থেকে গেল!
কলকাতার সঙ্গে প্লে-অফ সেমিফাইনালে কোন দলের দেখা হবে তা এ দিনের পরেও পরিষ্কার নয়। কোচের সঙ্গে ইদানীং দূরত্ব তৈরি হওয়া মার্কি ফুটবলার হেলডার পস্টিগা গ্যালারি থেকে নামার সময় বলছিলেন, ‘‘বাকি যে টিমগুলো সেমিফাইনালে আছে তাদের মধ্যে চেন্নাইয়ান টিমটা সবচেয়ে ব্যালান্সড। ওরাও আমাদের মতো ঠিক সময়ে পিক ফর্মে উঠেছে। ওদের সঙ্গে না পড়লেই ভাল।’’ ম্যাচের শুরু থেকে এটিকে কর্তাদের মুখেও একই কথা শোনা যাচ্ছিল। মাতেরাজ্জির টিম ছাড়া যে দলই পড়ুক সমস্যা নেই। ফুটবলারদের মধ্যেও কি ম্যাচের আগে এটা আত্মতুষ্টির কাজ করেছিল। না হলে, আগুনে একটা টিম, জয়ের হ্যাটট্রিক করে আসা একটা টিম হঠাৎ এ ভাবে আছাড় খাবে কেন? হাবাস অবশ্য হেরে গিয়ে বলে গেলেন, ‘‘আমার কোনও পছন্দ নেই। যার সঙ্গে পড়বে খেলব।’’ সেটা হয়তো বলার জন্য বলা!
কিন্তু মুম্বই দলের মতো বন্যা, দুর্যোগ পেরিয়ে আশা, অনুশীলন-হীন, শহরে পৌঁছনোর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ম্যাচে নেমে পড়া একটা দলের কাছে হারের পর হাবাসের টিম কি নক আউটে এড়াতে পারবে মাতেরাজ্জির চেন্নাইকে? হেরেও অবশ্য এখনও লিগ শীর্ষে কলকাতা। শনি এবং রবিবার দু’টো ম্যাচ আছে দিল্লি আর পুণেতে। সেখানেই ঠিক হবে অর্ণব-হিউমরা সেমিফাইনালে কাদের পাচ্ছেন। রবিবার দিল্লি বনাম গোয়া ম্যাচে যে-ই জিতুক, তারা এক নম্বর হয়ে যাবে কলকাতাকে টপকে। ওই ম্যাচটা আবার ড্র হলে কলকাতা এক নম্বরে থেকে গেলেও যেতে পারে।
যার সঙ্গেই সেমিফাইনাল হোক, মুম্বইয়ের কাছে এ দিনের হারটা কিন্তু মনে হচ্ছে অশনি সঙ্কেত। লক্ষ্যহীন এবং ছত্রিশ ঘণ্টা প্রায় নিদ্রাহীন আনেলকার টিমের কাছে যে ভাবে হাবাসের টিম হারল তা প্রত্যাশিত ছিল না কারও কাছেই। ১-০, ১-১, ২-১, ২-২, ৩-২। টেনিস সেটের মতো স্কোরলাইন দেখালেও গত বারের চ্যাম্পিয়নরা কিন্তু এগিয়ে যেতে পারেনি এক বারের জন্যও। প্রতি বারই পিছিয়ে থেকে সমতায় ফিরেছে। শেষমেষ ইনজুরি টাইমের গোলে হেরে আশঙ্কা তৈরি করেছে, টিমটা শেষ পর্যন্ত লড়াই করতে পারছে না। সেমিফাইনাল-ফাইনাল তো নক-আউট। সেখানে শেষ পর্যন্ত লড়তে হবে। টাইব্রেকার, সাডেন ডেথ— কত কিছু হতে পারে।
সংগঠকদের সূত্রে খবর, মুম্বই ম্যানেজার ওয়াটসন শুক্রবার সকালে রেফারিদের সঙ্গে নির্ধারিত সভার সময় ঝিমোচ্ছিলেন। এতটাই ক্লান্ত! বিধ্বস্ত। যা দেখে কলকাতার কর্তারা হয়তো ভেবে নিয়েছিলেন, মাঠে সুব্রত-সনিদের হালও একই রকম হবে। ভোর চারটেয় বিমান ধরে শহরে পৌঁছে হোটেলের সুইমিং পুলে সাঁতার কাটতে দেখা গিয়েছিল সুনীল ছেত্রীকে। কিন্তু বাদবাকিরা ছিলেন বিশ্রামে। কিন্তু তাঁরাই যে এ ভাবে ম্যাচ ছিনিয়ে নিয়ে যাবেন কে ভেবেছিল? এই টিমটার যিনি হেডমাস্টার সেই ফরাসি মহাতারকা ফুটবলার নিকোলাস আনেলকাকে মুম্বই শিবিরের লোকজনেরাই নাম দিয়েছেন ‘ঝগড়ুটে কোচ’। ফ্রান্সের জাতীয় কোচকে কুৎসিত গালাগাল দিয়ে আনেলকা বাদ পড়েছিলেন বিশ্বকাপ দল থেকে। এখানেও সেই ধারা অব্যহত রেখেছেন তিনি। সহকারী কোচ সরিয়েছেন, ফুটবলার তাড়িয়েছেন, সুনীল-সহ নিজের দলের ফুটবলারদের সমালোচনাতে বারবার মুখর হয়েছেন। কেন তাঁকে পছন্দ করবে টিম? জেতার পরেও তাই কোনও সতীর্থকে মুম্বই কোচের সঙ্গে হাত মেলাতে দেখা গেল না।
যদিও আনেলকার দল চমকে দেওয়ার মতো ফুটবল খেলল। শেষ চারে যাওয়ার সুযোগ নেই। লিগের লাস্ট বয়। শরীর জুড়ে ক্লান্তি। তা সত্ত্বেও! কলকাতা তিনটে পরিবর্তন করেছিল। গোলে মরসুমে মোটে দ্বিতীয় বার স্প্যানিশ কিপার জুয়ান। জঘন্য খেললেন তিনি। লেফট ব্যাক মোহনরাজ আর মহম্মদ রফিক। তাঁরাও চূড়ান্ত ব্যর্থ।
মোহনরাজের সঙ্গে রিনো অ্যান্টো— দুই সাইডব্যাককেই ‘খনি’ করে গতিতে বারবার ছিটকে দিলেন সনি। সঙ্গে যুগলবন্দির কাজ করলেন সুনীল ছেত্রী। প্রচুর গোলের সুযোগ তৈরি করলেন তাঁরা। কলকাতা যে সুযোগ পায়নি তা নয়। সুনীলদের মতো হিউম এবং দ্যুতিও দু’টো সুযোগ নষ্ট করলেন।
অথচ হিউমের গোল আর দ্যুতির সমারসল্ট দেখতে এ দিন মাঠে এসেছিলেন প্রায় ষাট হাজার দর্শক। চব্বিশ ঘণ্টা আগেও খেলা নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকা সত্ত্বেও। বিদেশে থাকায় গ্যালারিতে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন না। তবে দেব, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, প্রসেনজিৎ-জায়া অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়, অগ্নিমিত্রা পালরা এসেছিলেন এটিকে-কে সমর্থন দিতে।
শহরের অন্য পেশার সেলিব্রিটিরাও এটিকে কোচের মতোই চিন্তায়— ফাইনালে টিমটা যাবে তো!
আটলেটিকো: জুয়ান, রিনো, অর্ণব, তিরি, মোহনরাজ, গাভিলান (লেকিচ), বোরহা, দ্যুতি (ভালডো), আরাতা, রফিক (জুয়েল) হিউম।
ছবি: উৎপল সরকার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy