২০২০-র খেলা গুলোতেও ছিল বিষণ্ণতার ছাপ। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
বিখ্যাত এবং তুলনায় কম বিখ্যাত দু’জনের দু’টি বক্তব্য এবং অনুভূতি যাবতীয় ধারণার ভিতটাই নড়িয়ে দিয়েছিল।
প্যারা ব্যাডমিন্টন অ্যাথলিট মানসী জোশির গত ৩০ আগস্টের টুইট, ‘দৌড়তে ভুলেই গিয়েছিলাম। আবার নতুন করে শিখছি। এটা ভেবে হয়ত অবাক হচ্ছেন, দৌড়তে আবার কেউ ভুলে যায় নাকি! কিন্তু পায়ে দৌড়নোর সঙ্গে ব্লেড দিয়ে দৌড়নোর কোনও সম্পর্ক নেই। এটা একটা কঠিন টেকনিক, যা রপ্ত করতে হয়’।
এবং আইপিএল শুরুর আগে দুবাইয়ে প্রথম নেট করতে নেমে বিরাট কোহালির অনুভূতি, ‘প্র্যাকটিস সেশনে নামার আগে বুকটা একটু ধুকপুক করছিল। একটা ভয় কাজ করছিল। পারব তো!’
আরও পড়ুন: বলি থেকে টলি, ২০২০ সালে ‘ভুল’ কারণে খবরে যাঁরা
করোনার থাবায় জর্জরিত ক্রীড়াজগতে ২০২০–র এটাই নির্যাস। সে মানসীকে দৌড় ভুলিয়ে দিয়েছে। নেটে ব্যাট করতে নেমে তার কোপে স্বয়ং কোহালিকেও কেঁপে যেতে হয়েছে।
গভীরে ঢুকলে ২০২০-র প্রায় স্থবির ক্রীড়াজগতকে তত বেশি তাৎপর্যপূর্ণ আর সক্রিয় মনে হবে। ২০০–র ওপর বড় বা মাঝারি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা বাতিল বা স্থগিত। এর মধ্যে রয়েছে একাধিক খেলার বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ এবং অলিম্পিক। অন্তত খেলাধুলোর নিরিখে ২০২০ একমাত্র তুলনীয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে। কিন্তু চারের দশকে খেলা যেখানে ছিল শুধুই বিনোদন, ২০২০–তে সেটা তো গ্লোবাল ইন্ডাস্ট্রি! যার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে অর্থনীতি এবং রাজনীতি।
পিছিয়ে গেল অলিম্পিক। ছবি: রয়টার্স
কোভিডের প্রভাব পড়েছে দর্শক–ভক্তদের উপরেও। যেহেতু খেলাধুলো প্রায় হয়ইনি, যেটুকু হয়েছে, সেখানেও দর্শকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। তাই ভক্তদের খিদে বেড়েছে। লকডাউনে কোহালি–সুনীল ছেত্রিদের হেঁশেল কি অনুষ্কা–সোনমরা সামলেছেন, প্র্যাকটিস থেকে শত যোজন দূরে তারকা–মহাতারকারা কী করে দিন কাটিয়েছেন— এসব জানার স্পৃহা কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে। খেলোয়াড়–সহ ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে জড়িতরা এই খিদে কাজে লাগাচ্ছেন। এখন ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুকে কোহালিদের ঘনঘন লাইভ সেশনে আসাটাই নিউ নর্মাল। ভারত অধিনায়ক কী বললেন বা তাঁকে দিয়ে সাংবাদিকরা কী বলালেন, তা জানতে এখন আর পরদিন ভোরের খবরের কাগজের জন্য হা পিত্যেশ করে বসে থাকতে হয় না। এখন আমজনতাই প্রশ্নকর্তা।
আরও পড়ুন: ‘অর্থহীন’ ২০২০! ‘অনর্থ’ হবে না কোভিডোত্তর বিশ্বে, আশায় একুশে পা
দর্শকশূন্য গ্যালারিতে খেলা নিয়ে মাঠের তারকাদের নেতিবাচক মতামত আছে। ম্যাঞ্চেস্টার সিটির কোচ পেপ গুয়ার্দিওলার যেমন বক্তব্য, ফাঁকা গ্যালারিতে খেলার চেয়ে না খেলা ভাল। তিনি বলেছেন, ‘‘আমরা তো আমাদের কাজটা করি সাধারণ মানুষের জন্য। তাঁরাই যদি আমাদের দেখতে না আসেন, কাজটা করে লাভ কী?’’ এ ব্যাপারে কোহলিরও দর্শন হল, ‘‘মাঠভর্তি দর্শকদের ওই এনার্জিটা আমাদেরও দরকার হয়। ওই চিৎকার, উন্মাদনা আমাদেরও অন্য উচ্চতায় তুলে দেয়। ভেবেছি এটা নিয়ে। ভাল খেলার খিদেটা হয়ত থাকবে। কিন্তু কোনও সন্দেহ নেই, আমরা সবাই ওই পরিবেশটা মিস করছি।’’
দর্শকশূন্য মাঠে বুন্দেসলিগার ম্যাচ। ছবি: এএফপি
করোনার জন্য অনেক কিছু মিস হয়েছে। হচ্ছে। ভবিষ্যতেও হবে। কোনও কোনও খেলা তুলনায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যেহেতু ভারতের মতো ক্রিকেট–অর্থনীতিতে শক্তিশালী দেশ রয়েছে, তাই এই খেলায় ক্ষতি তুলনায় কম। বিভিন্ন ক্রীড়া সংস্থার লাভের অধিকাংশই আসে টেলিভিশন স্বত্ব বিক্রি করে। যেহেতু এবার খেলাধুলো প্রায় হয়ইনি, আর্থিক ক্ষতি অবশ্যম্ভাবী। ২০২০ সালে যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে খেলাধুলো—
ক্রিকেট
দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে মার্চের মাঝামাঝি ভারতের একদিনের সিরিজ বাতিল। এরপর বিভিন্ন দলের একাধিক সিরিজ বাতিল হয়েছে। জুলাইয়ের শুরুতে ইংল্যান্ডের মাঠে ক্রিকেট ফিরেছে। এরপর প্রবল অনিশ্চয়তার মধ্যেও আইপিএল হয়েছে। ২০১৫ সালে ভারতের জিডিপি–তে যেখানে আইপিএলের অবদান ছিল ১,১৫০ কোটি টাকা, সেখানে এই বছর আইপিএল সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে হওয়ায় এই সংখ্যাটা শূন্য। উল্টে আইপিএল আয়োজন করার জন্য আমিরশাহিকে ১০০ কোটি টাকা দিয়েছে ভারতীয় বোর্ড। বিদেশে আইপিএল আয়োজন করতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই বোর্ডের ভাঁড়ারেও টান পড়েছে। দেশে এই প্রতিযোগিতা না হওয়ায় বিভিন্ন হোটেল, লজিস্টিক সংস্থা, এয়ারলাইন্স সংস্থারও প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। শুধু আইপিএলের জন্য ভারতে প্রতি বছর কর্মসংস্থান হয় ১০ কোটি টাকার। এবার তা হয়নি। ফলে ভারতীয় অর্থনীতি কতটা ধাক্কা খেয়েছে, সহজেই অনুমেয়। আইপিএলে লাভের গুড় এতটাই বেশি, শোনা যাচ্ছে এই টি২০ লিগ সম্ভব করার জন্য অস্ট্রেলিয়া বোর্ডের মদতেই সে দেশে টি২০ বিশ্বকাপ বাতিল হয়েছে।
ফুটবল
১৪ মার্চ দর্শকশূন্য গ্যালারিতে আইএসএল ফাইনাল হয়েছিল। পরদিন নেরোকা বনাম চেন্নাই সিটি ম্যাচ হওয়ার পর আই লিগ বন্ধ হয়ে যায়। মোহনবাগানকে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হয়। তবে লকডাউনে বিভিন্ন ক্লাবগুলো পরের মরশুমের জন্য দল গোছানোর কাজ অনেকটাই সেরে ফেলে। ভারতে মেয়েদের অনূর্ধ্ব ১৭ বিশ্বকাপও ২০২০ সাল পর্যন্ত স্থগিত রাখা হয়েছে। ফলে অনেকের বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্নটাই শেষ হয়ে যাবে। বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন পর্বেও সুনীল ছেত্রিদের ম্যাচ বারবার পিছিয়ে গিয়েছে। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ইউরোপা লিগ, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ, লা লিগা, সিরি আ, বুন্দেশলিগা, ফ্রেঞ্চ লিগ চালু হলেও ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, মো সালাদের করোনা আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। স্থগিত হয়ে গেছে কোপা আমেরিকা এবং ইউরো।
সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে দর্শকশূন্য আইপিএল। ছবি: বিসিসিআই
টেনিস
ইন্টারন্যাশনাল টেনিস ফেডারেশন জানিয়েছে, কোভিডের জন্য তারা বিভিন্ন সার্কিট মিলিয়ে ৯০০টি প্রতিযোগিতা বাতিল করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম বাতিল করতে হয়েছে উইম্বলডন। এর ফলে র্যাঙ্কিংয়ে প্রথম ১০০ জনের মধ্যে না থাকা খেলোয়াড়রা সবথেকে বেশি বিপদে পড়েছেন।
অন্যান্য খেলা
বিশ্ব ব্যাডমিন্টন সংস্থা অতিমারির মধ্যেও কিছু প্রতিযোগিতা আয়োজনের চেষ্টা করেছিল। তার জন্য তাদের ব্যাপক সমালোচনা শুনতে হয়। শেষ পর্যন্ত তারা পিছিয়ে আসে। অল ইংল্যান্ড চ্যাম্পিয়নশিপের পর আর কোনও প্রতিযোগিতা হয়নি। বাতিল হয়েছে বিশ্ব অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপ। অলিম্পিকের বছরে যোগ্যতা অর্জনের জন্য তিরন্দাজি, বক্সিং, শুটিং, টেবিল টেনিস, কুস্তি, ভারোত্তোলন, হকির একাধিক প্রতিযোগিতা ছিল। সেগুলো একের পর এক পিছিয়ে দিতে হয়েছে। যেখানে আগামী বছর জাপানে অলিম্পিক হওয়াটাই অনিশ্চিত, সেখানে এই প্রতিযোগিতাগুলোর ভবিষ্যতও অথৈ জলে।
অলিম্পিকের অন্তর্ভূক্ত প্রতিটি আন্তর্জাতিক ক্রীড়া সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটির থেকে বার্ষিক অনুদান পায়। টাকার অঙ্ক নির্ভর করে সেই খেলার জনপ্রিয়তা এবং ব্যাপ্তির ওপর। অনুদানের পরিমাণ ৪ কোটি ডলার থেকে ৭০ লক্ষ ডলারের মধ্যে। এই বছর অলিম্পিক না হওয়ায় আইওসি সেই টাকা দেবে না বলেই ধরে নেওয়া যায়।
যাঁরা ছেড়ে চলে গিয়েছেন এই বছর। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
‘কিছুই হল না’–র বছরে প্রাপ্তি অবশ্য কিছু আছে। তার মধ্যে ভারতীয় খেলাধুলোর নিরিখে সবথেকে বড় ঘটনাটা গটেছে মাঠের বাইরে। মোহনবাগান এবং ইস্টবেঙ্গলের আইএসএলে খেলা। এটিকে–র সঙ্গে মোহনবাগানের সংযুক্ত হওয়াটা অনেকটা নির্বিঘ্নে হলেও ইস্টবেঙ্গলকে অনেক কাঠ–খড় পোড়াতে হয়েছে। দীর্ঘ টালবাহানার পর শেষ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হস্তক্ষেপে শ্রী সিমেন্টকে ইনভেস্টার হিসেবে পেয়ে আইএসএলে খেলার ছাড়পত্র পেয়েছে লাল–হলুদ।
বছরের শুরুটা হয়েছিল নক্ষত্রপতন দিয়ে। ২৬ জানুয়ারি সাদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ায় হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান কিংবদন্তি বাস্কেটবল খেলোয়াড় কোবে ব্রায়ান্ট। পরপর দু’মাসে শেষ হয়ে গিয়েছে বাংলা তথা ভারতীয় ফুটবলের একটি যুগ। ২০ মার্চ প্রয়াত হন পি কে বন্দ্যোপাধ্যায়। ৩০ এপ্রিল শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন চুনী গোস্বামী। ক্রিকেটও হারিয়েছে তার অন্যতম নক্ষত্রকে। ২৪ সেপ্টেম্বর আচমকা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হন অস্ট্রেলিয়ার ডিন জোন্স। ক্রীড়াজগত চমকে উঠেছিল স্বাধীনতা দিবসে মহেন্দ্র সিং ধোনির হঠাৎ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার সিদ্ধান্তে। কাউকে কিছু অনুমান করতে না দিয়ে একেবারে স্বভাবসিদ্ধ তাক লাগিয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে ধোনি নিজের সিদ্ধান্তের কথা ইনস্টাগ্রামে দু’লাইনের পোস্টে জানিয়ে দেন।
কিন্তু গোটা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছে ২৫ নভেম্বর মারাদোনার আকস্মিক মৃত্যু। বাঙালি তো বটেই, সারা দুনিয়া মূহ্যমান ফুটবলের রাজপুত্রের আকস্মিক বিদায়ে। মারাদোনা সর্বকালের সেরা ফুটবলার ছিলেন কি না, তা নিয়ে ফুটবলপ্রেমীদের মধ্যে তর্ক চলতেই থাকবে। কিন্তু যা নিয়ে কোনও তর্ক নেই— মারাদোনা একটি চরিত্র। যে চরিত্র বিশ্ব ফুটবল কেন, অন্য কোনও খেলাতেই খুব বেশি আসেনি। সম্ভবত আসবেও না। ক্রীড়াজগতে ২০২০ সালের শেষতম বিদায়টাই সম্ভবত নিষ্ঠুরতম হয়ে রইল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy