আটলেটিকো মাদ্রিদ তিন বছরের মধ্যে দু’বার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ট্রফি অল্পের জন্য হারাতে পারে। কিন্তু ওদের কাছে একটা গুরুত্বপূর্ণ ট্রফিও আছে। যাকে ক্লাবে রেখে দিতে পারলে ভবিষ্যতে বড় সাফল্য আসবে। সঙ্গে হয়তো আর একটা প্রজন্মও তৈরি হবে, যারা এ রকমই লড়াকু মানসিকতা নিয়ে মাঠে সব কিছু উজাড় করে দেবে। হয়তো অধরা চ্যাম্পিয়ন্স লিগও জিতে যেতে পারে।
হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন, সেই ট্রফির নাম দিয়েগো সিমিওনে। আটলেটিকো কোচের সোনার মগজের কথাই বলতে চাইছি।
সিমিওনের দল শনিবার রাতের ফাইনালে হেরে গিয়েছে। ফের স্বপ্নের খুব কাছে এসেও সর্বহারা হয়েছে। অনেকে যুক্তি দিতেই পারেন, যে কোচ বড় ফাইনাল জিততে পারে না, তার দলকে নিয়ে অত লাফালাফির কী আছে? কিন্তু একবার ভেবে দেখুন তো, দলটার নাম আটলেটিকো মাদ্রিদ। উইকিপিডিয়া না ঘেঁটে এক নিঃশ্বাসে যার বেশির ভাগ ফুটবলারের নাম কেউ বলতে পারবে? সে রকম একটা দলকে শুধুমাত্র ইউরোপের সেরা টুর্নামেন্টের ফাইনালেই তোলেনি সিমিওনে। চ্যাম্পিয়নও প্রায় করে দিয়েছিল। তাও আবার রিয়াল মাদ্রিদের বিরুদ্ধে! যে দলে তিন বারের ব্যালন ডি’অর জয়ী ফুটবলার আছে। যে দলে বিশ্বের সবচেয়ে দামি ফুটবলার আছে। যে দলের কোচ নিজেও কিংবদন্তি প্লেয়ার। এ রকম একটা হেভিওয়েট দলের বিরুদ্ধে টাইব্রেকারে হারতে পারে আটলেটিকো, কিন্তু ফুটবলকে জিতে নিয়েছে। কারণ, ফুটবলবিশ্ব এমন একজন কোচ পেয়েছে যাকে এই মুহূর্তে বিশ্বের সেরা তিনের মধ্যে রাখতেই হবে।
সান সিরোয় সিমিওনে এককথায় ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিল বিবিসি-কে। তাদের ভেতর ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর হ্যামস্ট্রিং চোট থাকতে পারে। কিন্তু শনিবার আটলেটিকোর গেমপ্ল্যানের বিরুদ্ধে একশো শতাংশ ফিট রোনাল্ডোও বিশেষ কিছু করতে পারত কি না আমার সন্দেহ আছে! বার্সেলোনা, বায়ার্ন-বধে যে ছকে নেমেছিল সিমিওনে, হুবহু সেই একই জিনিস দেখলাম রিয়ালের বিরুদ্ধেও। সিমিওনে এত গুছিয়ে ডিফেন্স সাজায় যে, বিপক্ষের প্রতিটা ফুটবলারের জন্য দুটো করে মার্কার থাকে। একজন ডিরেক্ট মার্কার। যার কাজ ফাইনাল ট্যাকলে যাওয়া। সঙ্গে একজন সাপোর্টিং মার্কার। যার কাজ, যদি ফাইনাল ট্যাকল মিস হয়ে যায় তা হলে সঙ্গে সঙ্গে কভার করা। যেমন, রোনাল্ডো যখন বল পাচ্ছিল তখন গদিন বা স্যাভিচ সঠিক ট্যাকল করতে না পারলেও, জুয়ানফ্রান বা ফিলিপে লুইস এসে কভার করে ফেলছিল। এ কারণেই তো রিয়াল দ্বিতীয়ার্ধের পরে খুব বেশি কিছু করতে পারেনি।
টিভিতে বারবার দেখলাম সিমিওনেও ফুটবলারদের মতোই সমান ভাবে তেতে ছিল। হাত ছুড়ে-ছুড়ে ফুটবলারদের অর্ডার দিচ্ছে। টাইব্রেকার চলার সময় তো আটলেটিকো গ্যালারিকে উদ্দীপ্ত করতে হাত ছুড়তে ছুড়তে ছুটে যাচ্ছে। যাতে তোরেসদের জন্য সমর্থকদের চিৎকার না বন্ধ হয়। এ রকম মরিয়া প্রচেষ্টা খুব কম কোচের মধ্যেই কিন্তু দেখেছি। মাঝে মাঝে তো সিমিওনেকে ফুটবলারের মতোই লাগছিল। এ রকম কোচের জন্য ফুটবলাররা জান লড়িয়ে দেবে না তো কার জন্য দেবে? দ্বিতীয়ার্ধের গোড়ায় গ্রিজম্যান পেনাল্টি নষ্ট করার পরেও সিমিওনে বারবার টাচলাইন থেকে চিৎকার করে দলকে উৎসাহ দিয়ে গেল। যে দলে দু-একজন বাদে নামী ফুটবলার নেই, যারা আন্ডারডগ তকমা নিয়ে নেমেছে ফাইনালে, সেই ফুটবলারদের কাছে কোচের এমন উদ্দীপনা সত্যিই একটা বড় পাওনা।
সিমিওনের আর একটা বড় গুণ হচ্ছে, ও কোনও পরিস্থিতিকে ভয় পায় না। ওর কাছে মেসি বা রোনাল্ডো নেই। কিন্তু ওর দলের ফুটবলাররা মেসি বা রোনাল্ডোকে অনায়াসে হারিয়ে দিতে পারে। ও এমন সব ফুটবলার রাখে দলে, যারা অক্ষরে অক্ষরে ওর স্ট্র্যাটেজি মেনে খেলবে। ভাববেই না, আমি স্ট্রাইকার অথচ কোচ আমাকে উইডথ্রল খেলাচ্ছে। বরং চোখ বন্ধ করে সব কিছু ছেড়ে দেবে কোচের উপর। এর মানে আবার এই নয় যে, সিমিওনে লোকটা একনায়ক। বরং এটাই মানে, লোকটা ম্যান ম্যানেজমেন্টটাও দুর্দান্ত জানে।
একটাই আক্ষেপ থেকে যাচ্ছে আমার। ইস, গ্রিজম্যান যদি পেনাল্টি গোলটা দিতে পারত! ওই একটা জায়গায় বলব, যদি তোরেসকে পাঠাতো সিমিওনে, তা হলে হয়তো ভালই হত। কারণ ওই রকম সময় তারুণ্যের উপর ভরসা না করে অভিজ্ঞতার রাস্তায় হাঁটা ভাল।
সিমিওনের আটলেটিকোর বিপক্ষ ডাগআউটে থাকা জিনেদিন জিদানকে ভুলে গেলেও অবশ্য চলবে না। ছ’মাসের মধ্যে একটা ক্লাবের মরসুম এ ভাবে পাল্টে দেওয়া মানে বোঝাই যাচ্ছে, জিদানও ভবিষ্যতে বিরাট কোচ হওয়ার ক্ষমতা রাখে। আর সিমিওনে? ফের একটা ফাইনাল হারলেও খুব তাড়াতাড়িই কিন্তু ওর হাতে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ট্রফিটা দেখছি!
ছবি: রয়টার্স, এএফপি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy