চমক: ব্রাজিলের অন্যতম ভরসা কুটিনহো। ফাইল চিত্র
কোস্টা রিকাকে হারালেও ব্রাজিলকে কিন্তু কষ্ট করে এই জয় আদায় করতে হয়েছে। তবে একটা কথা স্বীকার করতেই হবে যে, আমাদের ব্রাজিলীয়দের দিক থেকে এটা খুবই স্বস্তি এনে দেওয়া জয়।
আমার প্রথম কলামেই লিখেছিলাম, ব্রাজিলকে অতিরিক্ত নেমার-নির্ভরতা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হবে। সেটা যে একেবারে বাজে কথা নয়, শুক্রবারের ম্যাচটাতেও বোঝা গিয়েছে। আমার মতে, কোস্টা রিকা ম্যাচে ব্রাজিলের সেরা ফুটবলারের নাম নেমার নয়, ফিলিপে কুটিনহো। যদি এ রকম খেলে যেতে পারে কুটিনহো, তা হলে কিন্তু প্রতিপক্ষ যারাই থাকুক না কেন, ব্রাজিলকে ঠেকানো কঠিন হবে।
নেমার আমাদের প্রধান অস্ত্র হোক। কিন্তু ওকে ঘিরে যে নাটকীয়তা আর বিতর্ক চলছে, সেটা কমাতে পারলে দলের মঙ্গল হবে। কোস্টা রিকার সেরা অস্ত্র ছিল ওদের গোলকিপার কেলর নাভাস। দুর্দান্ত কিছু ‘সেভ’ করেছে ও। নেমারের প্রচেষ্টাকে একাধিকবার রুখে দিয়েছে। দুই অর্ধে অন্তত দু’বার একের বিরুদ্ধে এক পরিস্থিতিতে নেমার পেয়ে গিয়েছিল গোলকিপারকে। দু’বারই কিন্তু নাভাস প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছে। নেমার একটা দুর্দান্ত সোয়ার্ভিং ভলি নিয়েছিল। অল্পের জন্য যা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। কিন্তু সেক্ষেত্রেও নাভাসের উপস্থিত বুদ্ধিকে কৃতিত্ব দিতে হবে। গোলের মুখটা ছোট করে দিয়েছিল ও। যে কারণে দুরূহ কোণ বেছে নিতে বাধ্য হয় নেমার।
সুইৎজারল্যান্ডের বিরুদ্ধে সাধারণ মানের পারফরম্যান্সের পরে এই ম্যাচটাতেই নেমারকে ফিরে আসতে হত। সেন্ট্রাল পজিশনে শুরু করে পুরো দলটাকে সুন্দর ভাবে খেলাচ্ছিল নেমার। শুরুতে বেশ ক্ষিপ্র দেখাচ্ছিল ওকে। কিন্তু যত সময় যেতে থাকল, ততই গোল না পেয়ে যেন হতাশা গ্রাস করতে শুরু করল ওকে। কুটিনহোর একটা দারুণ পাস থেকে গোল করার সুযোগ পেয়েও ব্যর্থ হল।
কোস্টা রিকা এর পরেই বুদ্ধি করে খেলাটাকে মন্থর করে দিল। ওরা জানত, ব্রাজিলকে তাদের গতিতে খেলতে দিলে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। এই বিশ্বকাপে অনেক ছোট দলই শক্তিশালী দলগুলির বিরুদ্ধে এই রণনীতি নিচ্ছে। কোস্টা রিকাও একই রক্ষণাত্মক রণকৌশল নিয়ে ব্রাজিলকে অনেকক্ষণ আটকে রাখতে সফল হয়েছিল। বিশেষ করে নেমারের প্রভাব কমিয়ে আনার ব্যাপারে সফল হচ্ছিল তারা। প্রথম ম্যাচে সুইৎজারল্যান্ডের মতো কোস্টা রিকাও নেমারের উপর শারীরিক শক্তি প্রয়োগ করতে ছাড়েনি।
আর এখানেই কুটিনহো উঠে এল ব্রাজিলের নতুন রক্ষাকর্তা হিসেবে। গোলের অভাবে ওর দলকে যখন অধৈর্য দেখাতে শুরু করেছে, তখন মাথা ঠাণ্ডা রেখে কুটিনহো চাপটা রেখে গেল কোস্টা রিকার উপর। নেমারের মতো চাকচিক্য হয়তো নেই ওর। তাই প্রচারের আলো সে ভাবে না-ও পড়তে পারে ছেলেটার উপর। কিন্তু প্রকৃত ফুটবল বোদ্ধারা নিশ্চয়ই একমত হবেন যে, এই বিশ্বকাপে হিরে আবিষ্কার করেছে ব্রাজিল। আর সেই হিরের নাম ফিলিপে কুটিনহো। এত অসাধারণ বল ‘ডিস্ট্রিবিউশন’ আমি অনেক দিন কোনও ব্রাজিলীয় ফুটবলারের মধ্যে দেখিনি। কোস্টা রিকা ম্যাচে উইঙ্গার আর স্ট্রাইকারদের একের পর এক অবিশ্বাস্য বল সরবরাহ করে গেল কুটিনহো।
আরও এক জনকে নিয়ে আমি খুব আশাবাদী। ম্যাঞ্চেস্টার সিটির হয়ে খুব ভাল খেলতে থাকা গ্যাব্রিয়েল জেসুস। শুক্রবার ভাল খেলতে পারেনি, ওর একটা বল পোস্টে লেগে ফিরেও এল। আর এক বার অতিরিক্ত উত্তেজনায় দারুণ সুযোগ হাতছাড়া করল। জেসুসকে বুঝতে হবে, বিশ্বকাপ আর ইপিএল এক নয়। ওকে উত্তেজনা প্রশমিত করে আরও মনঃসংযোগ করার প্রক্রিয়া শিখতে হবে। রণনীতির দিক থেকে একটা কথা বলতে চাই। আমার মনে হয়েছে, বল নিজেদের দখলে রাখতে গিয়ে ব্রাজিল বড্ড বেশি টাচ খেলছে।
ফুটবলে একটা সোজা কথা মাথায় রাখা দরকার। বলটাকে নিজের দখলে রাখলেই শুধু হবে না, বলটা নিয়ে প্রতিপক্ষ অর্ধের দিকে হানাও দিতে হবে। আক্রমণটাকে প্রতিপক্ষ দলের দিকে নিয়ে যেতে হবে। জানাই ছিল যে, কোস্টা রিকার মতো অপেক্ষাকৃত ছোট দল ব্রাজিলের ছন্দ নষ্ট করার চেষ্টা করবে। ওদের সেই কৌশলকে ব্যর্থ করতে হলে ব্রাজিলকে বল বেশি পায়ে না রেখে খেলতে হত। কিন্তু ওরা আরও বেশি করে যেন বলকে আঁকড়ে ধরতে গেল। তাতে কোস্টা রিকারই সুবিধে হল।
অনেক সময়ই দেখা গেল, ব্রাজিলের দখলে বল থাকা সত্ত্বেও ঘুরেফিরে সেই নিজেদের অর্ধেই থেকে গিয়েছে তারা। তিতের দলকে কিন্তু এই দুর্বলতাটা কাটিয়ে উঠতেই হবে। বল নিয়ে সামনের দিকে এগনোর রাস্তা খুঁজে বার করতেই হবে ব্রাজিলকে। যদি প্রতিপক্ষ গোলে হানা দেওয়ার চ্যানেল না বার করা যায়, তা হলে কিন্তু গোলের জন্য হাহাকার চলবেই। শুক্রবারের ম্যাচে যেমন জেসুস একদম ভাল বলই পায়নি। বিশেষ করে প্রথমার্ধে ওকে বল দেওয়ার মতো কেউ ছিলই না। হাফটাইমের আগে ব্রাজিল মাত্র একটি শট নিতে পেরেছিল প্রতিপক্ষ গোলে। আমার মনে হয় ফিরমিনোকে নামানোর পরে ম্যাচের রং বদলে যায়। ফিরমিনোর দৌড়গুলো কুটিনহোর আক্রমণাত্মক ফুটবলের দরজা খুলে দিয়ে গেল। এর পরেই নেমার, ফিরমিনো, মার্সেলোর সঙ্গে দুর্দান্ত টাচ-প্লে শুরু করল কুটিনহো। আর তাতেই কোস্টা রিকার রক্ষণের প্রাচীরে ফাটল ধরতে শুরু করল।
নেমারকে নিয়ে পেনাল্টি বাতিলের বিতর্কে আসি। নিরপেক্ষ ভাবে বলতে গেলে, ভিডিয়ো দেখে রেফারি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেটা একদম ঠিক। নেমারকে কার্ড দেখালেও কিছু বলার থাকত না। অগ্রজ হিসেবে নেমারের প্রতি আমার উপদেশ— ছেলেমানুষি ছেড়ে এ বার বড় হও। তুমি ব্রাজিলের দশ নম্বর। দুনিয়ার নজর থাকবে তোমার উপর। তাই অন্য সব ছেড়ে শুধু ফুটবলটাতেই মন দাও। গোটা বিশ্বের কাছে ব্রাজিল মানে তার সুন্দর ফুটবল। অন্য কোনও নাটকীয়তা নয়।
এখান থেকে ব্রাজিল কত দূর যেতে পারবে, সেটাই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন। সুইৎজারল্যান্ড শুক্রবার রাতে জিতে যাওয়ায় সার্বিয়া ম্যাচটাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল ব্রাজিলের। নক-আউট পর্বে যেতে গেলে গ্রুপের শেষ ম্যাচে হারলে চলবে না। ভুল গেলে চলবে না যে, সার্বিয়াও ৩ পয়েন্ট নিয়ে বসে আছে। ব্রাজিল যদি বিশ্বকাপে অনেক দূর যেতে চায়, তা হলে অনেক উন্নতি করতে হবে।
দুনিয়া জুড়ে অসংখ্য ব্রাজিল ভক্তদের উদ্দেশে পরিষ্কার করে একটা কথা বলতে চাই। আমার মতে, ব্যক্তি-নির্ভরতা ছেড়ে তারা দল হয়ে উঠতে পারলে তবেই বিশ্বকাপে ভাল কিছু করে দেখাতে পারবে ব্রাজিল। আমাদের ফুটবলারদের বুঝতে হবে, বিশ্বকাপটা বল জাগলিং দেখানোর জায়গা নয়। বল নিয়ে কারিকুরি বা স্কিল প্রদর্শনী করার হলে না হয় বিশ্বকাপের পরে একটা ‘শো’-এর ব্যবস্থা করা যাবে। আপাতত মাঠে নেমে বল নিয়ে একটাই কাজ করার। এগিয়ে যেতে হবে প্রতিপক্ষ অর্ধের দিকে আর গোল করতে হবে।
আশা করব, আমাদের ১০ নম্বর এবং অন্যরা শুনছে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy