মস্কো বিমানবন্দরের বাইরে নাতি আর মেয়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছেন সাওপাওলোর গ্যাব্রিয়েল যোশেফ। হাতে ছ’ছটা টিকিট। সেমিফাইনাল আর ফাইনালের।
ক্রেতা খুঁজছেন বিক্রির জন্য।
মস্কোভা নদীর পাশে বড় একটি বিয়ার পাবের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন জনা পাঁচেক স্বল্প বসনা সাম্বা সুন্দরী। তাদের গালে আর বুকে এখনও হলুদ-সবুজ ব্রাজিল পতাকার রং। চোখের জলেও সেগুলো ওঠেনি এখনও। ওদের হাতেও তো লুঝনিকি স্টেডিয়ামে ঢোকার চারটে টিকিট।
পাব থেকে কোনও ইংল্যান্ড বা ফ্রান্স অথবা বেলজিয়াম সমর্থক বেরোলেই টিকিটগুলো নিয়ে গিয়ে ওরা জানতে চাইছেন, কিনবেন। বিক্রি হয়ে গেলেই ধরবেন রিয়োর বিমান।
কাজ়ান থেকে মস্কো আসার পাঁচটা বিমানের একটাতেও টিকিট নেই। হাজারে হাজারে আসা তিতের দেশের সমর্থকরা যেতে চাইছেন মস্কোয়। সঙ্গে থাকা টিকিট বিক্রি করতে। ব্রাজিল ফাইনালে উঠবে ধরে নিয়েই সবাই টিকিট কেটেছিলেন। সেমিফাইনাল বা ফাইনালের। এখন আসল দামটাই পাচ্ছেন না। ক্রেতা কোথায়? তবে আসতে শুরু করেছেন কিছু ইংল্যান্ড সমর্থক। তা ছাড়া এখানে আসা হ্যারি কেনের দেশের সমর্থকরাও বিমানের টিকিট বদলে ফাইনালের টিকিট কিনছেন।
আরও পড়ুন: জিতে অঁরিকে জবাব দিতে চান জিহুরা
হঠাৎই যেন বদলে গিয়েছে বিশ্বকাপের রং। নীল, সবুজ, হলুদ ছেড়ে সাদা, লাল, গাঢ় নীলের দাপাদাপি। রাশিয়ার রংও যে বদলে গিয়েছে। ক্রোয়েশিয়ার কাছে টাইব্রেকারে হৃদয় বিদারক হারের পরে মাঠে আসা দেশের তিন ‘হার্ট থ্রব’ সুপার মডেলের ছবি ছাপা হয়েছে কাগজে কাগজে। তারাও কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। যে রাশিয়ানদের আবেগ কখনও বাঁধ ভাঙে না বলে জানতাম, সেই দেশের হাজার হাজার ছেলে-মেয়ে শনিবার রাতে দেখলাম রাস্তায় রাস্তায় পতাকা গুটিয়ে হতাশ মুখে দাঁড়িয়ে।
বিয়ারের বোতল ফুটপাত ভর্তি। পাবগুলোর সামনে জমাট ভিড়। পুরো দেশের কাজ কর্মই না কি ক্রোয়েশিয়ার সঙ্গে টাইব্রেকারের সময় বন্ধ ছিল জানাচ্ছে প্রচারমাধ্যম। ওই সময় রাস্তায় গাড়ি চলছিল মাত্র কুড়ি শতাংশ। বিমান দেরিতে উড়েছে। কারণ পাইলট থেকে বিমানসেবিকা সবাই মোবাইলে খেলা দেখতে ব্যস্ত ছিলেন। বিশ্বকাপের প্রভাব রাশিয়ার অর্থনীতির উপর ফেলবে বলে প্রচার চলছে জোর। চের্চেসভের দল কোয়ার্টার ফাইনালে হেরে গেলেও দুর্দান্ত খেলেছে। হাল ছাড়েনি। সব চেয়ে বড় কথা, দেশের আবেগকে নিয়ে এসেছেন মাঠে। এটা লুফে নিয়েছেন দেশের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তার জমানায় প্রথম বার আকিনফেভরা ডাক পেয়েছেন ক্রেমলিনে। পুতিন তাঁদের সংবর্ধনা দেবেন।
পুতিন যখন ডেকে পাঠাচ্ছেন দেশের ফুটবলারদের তখন ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট কলিন্দা গ্রাবার-কিতারোভিচ নিজেই ম্যাচ জেতার পরে চলে গিয়েছিলেন লুকা মদ্রিচদের ড্রেসিংরুমে। কুড়ি বছর পর শেষ চারে উঠেছে ক্রোয়েশিয়া। এ বার বিশ্বকাপে ইউরোপের দলগুলির দাপাদাপি। লাতিন আমেরিকার ফুটবলকে বৃত্তের বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে শেষ চারে উঠছে যাঁরা তাদের মধ্যে দু’দল কোনও দিন বিশ্বকাপ জেতেনি। ইংল্যান্ড যখন জিতেছে তখন হ্যারি কেনের টিমের এক জনেরও জন্মই হয়নি। কিলিয়ান এমবাপে, পল পোগবাদেরও একই অবস্থা। জিনেদিন জিদানরা যখন আটানব্বইতে ফ্রান্সকে ট্রফি জেতান ওরা তখন অনেকেই জন্মাননি। কেউ বা পড়তেন নার্সারি স্কুলে।
ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে খেলতে নামার আগে ঠিকই বলেছেন হ্যারি কেন, ‘‘এখন বিশ্বকাপে ফেভারিট দেশ বলে কিছু হয় না। যে কেউ যে কাউকে হারিয়ে দিতে পারে। আমরা সতর্ক। সব দলকে গুরুত্ব দিচ্ছি।’’ একই রকম কথা শোনা গিয়েছে ক্রোয়েশিয়ার অধিনায়ক লুকা মদ্রিচের গলাতেও। দল শেষ চারে ওঠার পর রিয়াল মাদ্রিদের মিডিও বলেছেন, ‘‘ইংল্যান্ডকে হারানো কঠিন তবে অসম্ভব নয়। বিশ্বকাপে কোনও দলই অপরাজেয় নয়।’’
আরও পড়ুন: তিতের কোচিংয়েই আবার ঘুরে দাঁড়াবেন কুটিনহোরা
স্পেন ম্যাচের মতোই অঘটন ঘটতে পারে এই আশা নিয়েই ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে মাঠে গিয়েছিলেন রাশিয়ার দর্শকরাও। টাইব্রেকারে পেনাল্টি মারতে যাওয়ার সময় একটা ব্যানার উড়ছিল চের্চেসভের রিজার্ভ বেঞ্চের পিছনে। রাশিয়ান ভাষায় তাতে লেখা। যার অর্থ, ‘‘তোমরা অন্তত এই শটটা মারার সময় রোনাল্ডো হও।’’ কিন্তু তাতেও জিততে পারেননি আকিনফেভরা। রাশিয়া দলে ছিলেন একজন ব্রাজিল-জাত ফুটবলার মারিয়ো ফিগুয়েরা ফের্নান্দেস। ব্রাজিল জাতীয় দলের হয়ে জাপানের বিরুদ্ধে একটি প্রীতি ম্যাচ খেলেছিলেন তিনি। চার বছর আগে রিয়ো ছেড়ে আসার পরে যোগ দেন সিএসকেএ মস্কোতে। নাগরিকত্ব নেন রাশিয়ার। ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে ১১০ মিনিট পর্যন্ত নায়ক থেকেও শেষ পর্যন্ত খলনায়ক হয়ে যান তিনি। পেনাল্টি নষ্ট করে। অথচ ২-১ পিছিয়ে পড়া থেকে অতিরিক্ত সময়ে ২-২ করেছিলেন মারিয়ো। রাশিয়ার হারের পর তিনি ব্রাজিলের নেমার দা সিলভা স্যান্টোস (জুনিয়র)-এর হাত ধরে ব্রাজিলের দিকে হাঁটছেন, এ রকম একটা কার্টুন বেরিয়েছে একটি রাশিয়ান ট্যাবলয়েডে।
বিশ্বকাপের শেষ চারের যুদ্ধ শুরুর দু’দিন আগে কোনও দলই অবশ্য সুথে নেই। অঘটনের বিশ্বকাপে সবই অনিশ্চিয়তার মুখে দাঁড়িয়ে। ব্রাজিলের সাম্বা সুন্দরীর টিকিট বিক্রি না হওয়ার উদ্বেগের সঙ্গে কোনও ফারক নেই হ্যারি কেন বা কিলিয়ান এমবাপে বা এডেন অ্যাজারদের। ফুটবলের মহাযজ্ঞের শেষ পর্বে সবাই টাইব্রেকার মারার আগের মুহূর্তের মতো উত্তেজনায় ডুবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy