পদক নিয়ে কার্লে। ছবি রয়টার্স
এক বছর আগে টোকিয়োয় অল্পের জন্য স্বপ্ন ছোঁয়া হয়নি। সোনা এবং তাঁর রুপোর মাঝে তফাৎ গড়ে দিয়েছিল মাত্র ০.০৪ সেকেন্ড। ওরেগনে সেই ভুলটা আর করলেন না ফ্রেড কার্লে। নিজের দেশেরই দুই প্রতিদ্বন্দ্বীকে পিছনে ফেলে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে জিতে নিলেন সোনা। বার্তা দিয়ে রাখলেন, উসেইন বোল্টের পরবর্তী প্রজন্ম তৈরি রয়েছে।
রবিবার ৯.৮৬ সেকেন্ড সময়ে ১০০ মিটার দৌড়ে সোনা জিতেছেন কার্লে। বোল্টের বিশ্বরেকর্ড ৯.৫৮ সেকেন্ডের ধারেকাছে নেই সেই সময়। তবে কার্লে স্বপ্ন দেখেন, এক দিন ঠিক বিশ্বের দ্রুততম মানব হবেন। ছাপিয়ে যাবেন বোল্টকে। বিশ্বের দ্রুততম মানুষ হওয়ার স্বপ্নই তো তাঁকে টেনে এনেছে ৪০০ মিটার থেকে ১০০ মিটারে। জীবনের শুরুটা হয়েছিল ৪০০ মিটার দৌড় এবং ৪x৪০০ মিটার রিলে দিয়ে। বছর কয়েক আগে থেকে ১০০ এবং ২০০ মিটারে দৌড় শুরু করেন। টোকিয়ো অলিম্পিক্সে দ্বিতীয় হয়েছিলেন। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে গলায় ঝুলল সোনার পদক।
ওরেগনের হেওয়ার্ড ফিল্ডে দৌড় শেষ হওয়ার পর বুকে বেশ কয়েক বার চাপড় মারলেন। গোটা স্টেডিয়াম জুড়ে তখন তাঁরই নাম। সঙ্গে ‘ইউএসএ’, ‘ইউএসএ’ চিৎকার। হওয়াই স্বাভাবিক। আমেরিকার বুকে সে দেশেরই তিন দৌড়বিদ ১০০ মিটারে সোনা, রুপো, ব্রোঞ্জ জিতলেন! দেশবাসীর গর্ব হবে না? কার্লেও প্রতিটি মুহূর্ত শুষে নিচ্ছিলেন। কখনও আমেরিকার পতাকা গায়ে ট্র্যাকের উপর দিয়ে দৌড়চ্ছেন, কখনও নাগাড়ে হাত মেলাচ্ছেন দর্শকদের সঙ্গে। তবে কার্লেকে যাঁরা কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁরাই জানেন কতটা কষ্ট, কতটা পরিশ্রম জড়িয়ে রয়েছেন তাঁর সাফল্যের পিছনে?
ওরেগনের স্টেডিয়ামে কি তাঁর কাকি ভার্জিনিয়াও উপস্থিত ছিলেন? জানা যায়নি। তবে স্টেডিয়ামেই থাকুন বা টিভির সামনে, কার্লের সাফল্য দেখে তাঁর আবেগের বহিঃপ্রকাশ হতই। জন্মের দু’বছরের মধ্যেই জীবনটা ওলট-পালট হয়ে গিয়েছিল কার্লের। বাবা-মায়ের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় ভাইবোনেদের। গুরুতর অপরাধ করে বাবা জেলে যান। মা-ও অপরাধমূলক কাজকর্মে জড়িয়ে পড়েন। ছোট্ট কার্ল এবং তাঁর চার ভাইবোনের দেখাশোনার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন ভার্জিনিয়াই। তাঁর নিজের ছেলেমেয়েও ছিলেন। সব মিলিয়ে, একই ছাদের তলায় বেড়ে উঠেছিলেন ১৩ জন।
এক ওয়েবসাইটের কলামে কার্লে লিখেছেন, ‘কাকিকে আমি মিম বলে ডাকি। অসাধারণ একজন মহিলা, যে ব্যক্তিত্ব আজ পর্যন্ত কারওর মধ্যে আমি দেখিনি। যত্ন যেমন নিতে পারে, তেমন প্রয়োজনে শাসনও করতে পারে। ছেলেমেয়েদের খুব ভালবাসে। একই সঙ্গে প্রচণ্ড শৃঙ্খলাপরায়ণ।’ ছোটবেলা থেকে পাঁচ ভাইবোনকেই খেলাধুলোয় মদত দিয়েছেন। ফলও মিলেছে। কার্লের ছোটভাই ৪০০ মিটারে দৌড়ন। কলেজে পড়ার সময় ভাইয়ের সঙ্গে রিলে দৌড়ে পদকও জিতেছেন কার্লে। বড় ভাই ডেমারিয়া স্প্রিন্ট এবং হাই জাম্পে পারদর্শী। বোন ভার্জিনিয়া লং জাম্প এবং হাই জাম্পে অংশ নেন। কাকির সঙ্গে কার্লের এতটাই ভাল সম্পর্ক যে, বিশ্বের যেখানেই থাকুন এক বার অন্তত কাকির সঙ্গে কথা হবেই।
কার্লের জন্ম ১৯৯৫-এর ৭ মে। আমেরিকার টেক্সাসের ছোট শহর টেলরে বেড়ে উঠেছেন কার্লে। পড়াশোনাও শুরু টেলর হাই স্কুলে। প্রথম থেকেই দৌড়ের প্রতি ভালবাসা জন্মেছিল, এমন নয়। ছয় ফুট তিন ইঞ্চি উচ্চতার কার্লে প্রথম দিকে চুটিয়ে বাস্কেটবল, আমেরিকার ফুটবল খেলেছেন। হাইস্কুলের হয়েও ফুটবল প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। হঠাৎই সেই খেলা খেলতে গিয়ে কলার বোন ভাঙে। তার পর থেকে দৌড়েই মনোনিবেশ করেন।
প্রথমে ২০০ মিটার এবং ৪x১০০ মিটার রিলে-তে দৌড় শুরু করেন। কলেজে পড়ার সময় ৪০০ মিটারে দৌড়নো শুরু। আমেরিকার জাতীয় কলেজ চ্যাম্পিয়নশিপে অসাধারণ পারফরম্যান্স করে শুরুতেই নজর কেড়ে নেন সকলের। স্কুল এবং কলেজ স্তরে চুটিয়ে খেলেছেন। ২০১৬ অলিম্পিক্সের আগে আমেরিকার অ্যাথলেটিক্স দলের ট্রায়ালে নাম লেখালেও সুযোগ পাননি। ২০১৭-য় প্রথম বার বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে নামা। ৪০০ মিটারে সপ্তম হলেও ৪x৪০০ মিটার রিলে দলের হয়ে রুপো পান। পরের বছরই ডায়মন্ড লিগে সোনা।
এর পর থেকে ধীরে ধীরে স্প্রিন্টে আসতে থাকেন। দৌড় শুরু করেন ১০০ এবং ২০০ মিটারে। ধীরে ধীরে দৌড়ের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিই বদলে যায় তাঁর। এখন কার্লে চান বোল্টের রেকর্ড ভেঙে বিশ্বের দ্রুততম মানুষ হতে। টোকিয়োয় রুপো জেতার পরই নিজের পরবর্তী লক্ষ্য স্থির করে নিয়েছেন। ৯ সেকেন্ডে ১০০ মিটার, ১৮ সেকেন্ডে ২০০ মিটার এবং ৪২ সেকেন্ডে ৪০০ মিটার দৌড় শেষ করবেন। অলিম্পিক্সের পরেই এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “সত্যি করে আমি চাই বিশ্বের দ্রুততম মানুষ হতে। ১০০, ২০০ এবং ৪০০ — তিনটি বিভাগেই আগের সব রেকর্ড ভেঙে দিতে চাই।” ঘটনাচক্রে, টোকিয়োয় যে সময়ে ১০০ মিটারে রুপো পেয়েছিলেন (৯.৮৪), তার থেকে ০.০২ সেকেন্ড বেশি সময় নিয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জিতেছেন কার্লে।
জীবনের শুরু থেকেই এত ঘটনা দেখেছেন, যা জীবন সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দিয়েছে। নিজের পরিবারের ভাঙন দেখেছেন। হারিয়েছেন ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের। স্বীকার করেছেন, স্কুলে খেলাধুলো করার সময় বহু প্রতিভাবান সতীর্থ ছিল তাঁর। হঠাৎ করেই স্কুল শেষ হওয়ার পর তাঁদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। কার্লের কথায়, “বাকিদের থেকে আমায় আলাদা করে দিয়েছিল মানসিকতা। ছোট থেকেই ঠিক করে নিয়েছিলাম, ওদের মতো হতে চাই না। নিজেকে কোনও দিন একটা গণ্ডির মধ্যে আটকে রাখতে চাইনি। ভাল করে পড়াশুনো যেমন করেছি, তেমনই খেলাধুলোর সাহায্যে গোটা বিশ্বে ঘুরে বেড়ানোর স্বপ্ন দেখেছি।”
Heard you couldn’t market greatness. pic.twitter.com/4grXuLr4gI
— Fred Kerley (@fkerley99) April 21, 2022
আত্মবিশ্বাস এতটাই যে সোনা জেতার পর নিজের মুখেই বলেছেন, “আমি যা করেছি তা ৪০০ মিটারের খুব বেশি দৌড়বিদ করতে পারেনি। আমার সামনে অনেকগুলো দরজা খুলে গেল। মনে হচ্ছে আমার ভবিষ্যৎ বেশ উজ্জ্বল।” শুধু তাই নয়, বিভিন্ন সময় তাঁর কিছু টুইটও নজর কেড়ে নিয়েছে। গত বছর ২৫ সেপ্টেম্বর লেখেন, ‘এক দিন আমি কোটি কোটি ডলারের মালিক হব।’ তার আগেই লিখেছিলেন, ‘সমস্যা হল, আমি কোনও কিছুতেই ভেঙে পড়ব না।’ ইঙ্গিত খুব স্পষ্ট, যে সুযোগ তাঁর সামনে এসেছে তা কোনও ভাবেই হারাতে চান না কার্লে।
খেলাধুলোয় বাইরে আর একটি বিষয় খুবই পছন্দ করেন কার্লে। সারা শরীরে ট্যাটু করানো। ১২ বছর বয়সে জীবনের প্রথম ট্যাটু করান। নিজের কাকির নাম লিখেছিলেন, যাতে যেখানেই যান কাকি যেন সঙ্গে থাকেন। এখন তাঁর শরীরে রয়েছে ১০টি ট্যাটু। তার কোনওটিতে বাইবেলের বাণী, কোনওটিতে ভার্জিন মেরি, কোনওটিতে গোলাপের তোড়া।
নিজের ট্যাটুপ্রেম নিয়ে কার্লে লিখেছেন, ‘ট্যাটু হল আমার কাছে একটা বার্তা, যা আমাকে রোজ প্রেরণা দেয় এগিয়ে যেতে এবং কোনও কিছু হালকা ভাবে না নিতে। এটা আমার কাছে একটা স্ট্যাম্প, একটা পাসপোর্টের মতো, যা প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দেয় যে আমি জীবনে কী কী অর্জন করেছি, আমি কোন দিকে এগিয়ে চলেছি।”
আত্মবিশ্বাস না থাকলে এমন লেখা সম্ভব? বোল্টের রেকর্ড যদি কোনও দিন কার্লে ভেঙেও দেন, তাতে কেউ খুব একটা আপত্তি করবেন বলে মনে হয় না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy