Advertisement
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪
Paris Olympics 2024

ভারতের ১১৩ জনের দলে বাঙালি মাত্র এক! অলিম্পিক্সে বঙ্গের কেন এই হাল? নেপথ্যে ৭ কারণ

প্যারিস অলিম্পিক্সে এখনও পর্যন্ত ভারতের ১১৩ জনের যে দল ঘোষণা করা হয়েছে তাতে মাত্র এক জন বাঙালি রয়েছেন। কেন এ রাজ্য থেকে অলিম্পিক্সে খেলোয়াড়ের সংখ্যা কমে যাচ্ছে?

sports

(বাঁ দিক থেকে) নীরজ চোপড়া, আভা খাটুয়া, পিভি সিন্ধু । —ফাইল চিত্র।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০২৪ ১০:৩৫
Share: Save:

প্রদীপ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, দোলা বন্দ্যোপাধ্যায়, জ্যোতির্ময়ী শিকদার, সুস্মিতা সিংহ রায়, পৌলমী ঘটক, মৌমা দাস— তালিকাটা ছোট নয়। যে সব বাঙালি অলিম্পিক্সে ভারতের হয়ে খেলেছেন তাঁদের মধ্যে এঁরা কয়েক জন। আরও অনেকে রয়েছেন যাঁরা ভারতের নাম উজ্জ্বল করেছেন। বিশ্বমঞ্চে দাপট দেখিয়েছেন। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, সংখ্যাটা কমছে। গত বার টোকিয়ো অলিম্পিক্সে ভারতীয় দলে চার জন বাঙালি ছিলেন। এ বার প্যারিস অলিম্পিক্সে সংখ্যাটা কমে হয়েছে এক। কেন বাঙালির সংখ্যা কমে যাচ্ছে অলিম্পিক্স থেকে? খোঁজ নিল আনন্দবাজার অনলাইন।

টোকিয়ো অলিম্পিক্সে ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন ১২২ জন। ৬৮ জন পুরুষ ও ৫৪ জন মহিলা ক্রীড়াবিদের মধ্যে যে চার জন বাঙালি খেলেছিলেন, তাঁরা হলেন, অতনু দাস (তিরন্দাজি), অনির্বাণ লাহিড়ি (গল্‌ফ), সুতীর্থা মুখোপাধ্যায় (টেবল টেনিস) ও প্রণতি নায়েক (জিমন্যাস্টিক্স)। এই চার জনের মধ্যে অনির্বাণ বেশ কয়েক বছর ধরে আমেরিকায় থাকেন। পিজিএ ট্যুরেও খেলেন তিনি। কিন্তু তিনি জন্মসূত্রে বাঙালি। তাই এই তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন। অতনু বরাহনগরের ছেলে। কিন্তু তিনিও দীর্ঘ দিন জামশেদপুরের টাটা অ্যাকাডেমিতে ছিলেন। ঝাড়খণ্ডের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। প্রণতি কেরিয়ারের একটা সময়ে চলে গিয়েছিলেন ওড়িশায়। সেখানেই অনুশীলন করেন তিনি।

এ বার প্যারিস অলিম্পিক্সে এখনও পর্যন্ত ভারতের হয়ে ১১৩ জন খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৬৬ জন পুরুষ ও ৪৭ জন মহিলা। এখনও বাছাই পর্ব শেষ হয়নি। ট্রায়াল ও র‌্যাঙ্কিং অনুযায়ী আরও কয়েক জন হয়তো ভারতের হয়ে সুযোগ পাবেন। এই ১১৩ জনের মধ্যে বাঙালি মাত্র এক জন। আভা খাটুয়া। শটপাট খেলেন তিনি। বাংলায় জন্ম নেওয়া আরও দু’জন অবশ্য রয়েছেন। তিরন্দাজিতে অঙ্কিতা ভকত ও ইকুয়েস্ট্রিয়ানে অনুষ আগরওয়াল। এই দু’জনের জন্ম কলকাতায় হলেও এঁরা বাঙালি নন। তাই এই তালিকায় নেই তাঁরা।

যে রাজ্য থেকে এক সময় অলিম্পিক্সে এত খেলোয়াড় অংশ নিতেন, সেই রাজ্যে কেন এই খরা? এ বারও নজরে ছিলেন বেশ কয়েক জন বাঙালি। টেবল টেনিসে ঐহিকা মুখোপাধ্যায় ও সুতীর্থা মুখোপাধ্যায়, শুটিংয়ে মেহুলি ঘোষ, জিমন্যাস্টিক্সে প্রণতি ও স্বপ্না বর্মণ। কিন্তু তাঁরা ট্রায়ালের পরে জাতীয় দলে জায়গা করতে পারেননি। বিশ্ব টেবল টেনিস প্রতিযোগিতায় বিশ্বের এক নম্বর তারকা চিনের সুন ইয়েংসাকে হারিয়েছেন ঐহিকা। গত এশিয়ান গেমসে প্রথম ভারতীয় মহিলা জুটি হিসাবে ব্রোঞ্জ জিতেছেন ঐহিকা ও সুতীর্থা। তার পরেও টেবল টেনিস দলে জায়গা হয়নি তাঁদের। ঐহিকাকে স্ট্যান্ড বাই হিসাবে রাখা হয়েছে। অর্থাৎ, দলে থাকা কোনও খেলোয়াড় চোট পেয়ে ছিটকে গেলে তবেই তাঁর জায়গা হবে। গত বার অলিম্পিক্স খেলা সুতীর্থা তো সেই সুযোগও পাননি।

কেন এই সমস্যা হচ্ছে? কোথায় পিছিয়ে পড়ছে এই রাজ্য? কারণ খুঁজতে আনন্দবাজার অনলাইন যোগাযোগ করেছিল আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতের হয়ে খেলা কয়েক জন প্রাক্তন ক্রীড়াবিদ ও প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত কর্তাদের সঙ্গে। কিন্তু তাঁরা কেউ নাম প্রকাশ করতে চাননি। কথায় বুঝিয়ে দিয়েছেন, সরকারের বিরাগভাজন হতে চাইছেন না। তবে তাঁদের প্রত্যেকের কথা থেকে যে সব তথ্য উঠে এল তা থেকে এই রাজ্যের ক্রীড়াবিদ উঠে না আসার কয়েকটি কারণ বোঝা গেল।

১) পরিকাঠামোর অভাব— এ রাজ্য থেকে অলিম্পিক্সে ক্রীড়়াবিদদের সুযোগ না পাওয়ার প্রথম ও প্রধান কারণ পরিকাঠামোর অভাব। অভিযোগ, যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে সিন্থেটিক ট্র্যাক থাকলেও সেখানে অনুশীলনের সুযোগ কম। বিভিন্ন ফুটবল প্রতিযোগিতার জন্য যুবভারতীর ট্র্যাকে অনুশীলন করতে দেওয়া হয় না। ফলে ক্রীড়াবিদদের অপেক্ষা করে থাকতে হয় সাই (স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া)-এর দাক্ষিণ্যের উপর। স্টেডিয়াম তৈরি হচ্ছে। তবে সবই ফুটবল স্টেডিয়াম। অ্যাথলেটিক্সের জন্য আলাদা করে বন্দোবস্ত করা হচ্ছে না। ইন্ডোর স্টেডিয়ামে প্রায়ই নানা অনুষ্ঠান হয়। তাই সেখানকার সুবিধাও ক্রীড়াবিদেরা ভাল ভাবে ব্যবহার করতে পারেন না। ফলে রাজ্যে কাদা, জলের মাঠে অনুশীলন করে জাতীয় স্তরে সিন্থেটিক ট্র্যাকে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলছেন ক্রীড়াবিদেরা।

২) জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় খেলার সুযোগ কম— ভারতের অলিম্পিক্স দলে সুযোগ পাওয়ার প্রধান দু’টি বিষয় হল, ট্রায়াল ও র‌্যাঙ্কিং। যে সব খেলায় ট্রায়াল থেকে ক্রীড়াবিদ বেছে নেওয়া হয় সেখানে পারফরম্যান্সই শেষ কথা। কিন্তু যে সব খেলায় র‌্যাঙ্কিং থেকে খেলোয়াড় বাছা হয় তাতে পিছিয়ে পড়েন বাঙালিরা। তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ ঐহিকা। গত এক বছরে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এত সাফল্যের পরেও তিনি জায়গা পাননি র‌্যাঙ্কিংয়ে পিছিয়ে থাকায়। সাধারণত, বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় খেলার উপর নির্ভর করে তাঁরা পয়েন্ট পান। সেই অনুযায়ী র‌্যাঙ্কিং হয়। ঐহিকা চোট ও ভিসা সমস্যায় বেশ কয়েকটি প্রতিযোগিতায় নামতে পারেননি। তাই র‌্যাঙ্কিংয়ে পিছিয়ে গিয়েছিলেন। খেলোয়াড় নির্বাচনের ক্ষেত্রে চোখ বন্ধ করে র‌্যাঙ্কিং দেখা হল। সাম্প্রতিক সাফল্য দেখা হল না।

৩) স্কুল, কলেজে খেলাধুলোর অভাব— এই একটি ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গকে টেক্কা দিচ্ছে অনেক রাজ্য। উত্তরের হরিয়ানা, পঞ্জাব, পশ্চিমের মহারাষ্ট্র বা দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, কেরলের মতো রাজ্যে স্কুল ও কলেজ স্তরে খেলাধুলোর চল রয়েছে। সারা বছর প্রতিযোগিতা হয়। সেখান থেকে অনেক খেলোয়াড় উঠে আসেন। তাঁরা পরবর্তীতে রাজ্য ও দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন। এ রাজ্যে সেটা অনেক কম। স্কুল ও কলেজের পাঠ্যসূচিতে খেলাধুলোকে আলাদা করে জায়গা দেওয়া হয় না। ফলে সেখান থেকে ক্রীড়াবিদ উঠে আসার সুযোগ কম।

৪) জেলা থেকে খেলোয়াড় উঠে না আসা— জেলা স্তর থেকে খেলোয়াড় উঠে আসছে না পশ্চিমবঙ্গে। অভিযোগ, বিভিন্ন জেলায় প্রতিযোগিতাই হয় না সারা বছর। তার একটা বড় কারণ, ক্ষমতা দখলের লড়াই। কিছু জেলায় ক্রীড়া সংস্থা দখল করার জন্য মামলা পর্যন্ত হয়। সে সব দিকেই নজর থাকে। ফলে খেলাধুলো অনাথ হয়ে যায়। জেলা স্তর থেকে ক্রীড়াবিদ উঠে না আসায় রাজ্য থেকে প্রতিনিধির সংখ্যাও কমে যাচ্ছে।

৫) আর্থিক সাহায্যের অভাব— জেলা সংস্থাগুলি তেমন আর্থিক সাহায্য পায় না বলে জানা গিয়েছে। রাজ্য সরকার থেকে প্রতি বছর তাদের একটি টাকা দেওয়া হত। সেটাও গত তিন বছর ধরে বন্ধ বলে অভিযোগ। আর্থিক সাহায্য না থাকায় পরিকাঠামোর উন্নয়নে সমস্যা হয়। ক্রীড়াবিদেরা অনুশীলনের তেমন সুবিধা পান না। তাতে পিছিয়ে পড়েন তাঁরা।

৬) কাজের লোকের অভাব— অভিযোগ, বিভিন্ন ক্রীড়া সংস্থার পদে অনেক লোক রয়েছেন। কিন্তু কাজের লোকের অভাব হচ্ছে। ঠান্ডা ঘরে বসে না থেকে মাঠে, ময়দানে নেমে কাজ করার লোক কমে যাচ্ছে। তার খেসারত দিতে হচ্ছে রাজ্যের ক্রীড়াবিদদের।

৭) পরিকল্পনার অভাব— কোনও একটি খেলা, বা সার্বিক ভাবে রাজ্যের ক্রীড়াকে তুলে ধরতে হলে প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা। বাস্তবায়ন তো পরের কথা, পরিকল্পনা ঠিক না হলে ফলও ঠিক পাওয়া যাবে না। অলিম্পিক্স বা এশিয়ান গেমসের মতো প্রতিযোগিতার কয়েক মাস আগে পরিশ্রম করলে হবে না, কয়েক বছর ধরে পরিকল্পনা করতে হবে। তবেই তার লাভ পাবেন ক্রীড়াবিদেরা।

এ বার অলিম্পিক্সে একমাত্র বাঙালি আভাও কিন্তু এ রাজ্যের হয়ে সুযোগ পাননি। পেয়েছেন মহারাষ্ট্রের হয়ে। সেখানে কাস্টমসে চাকরি করেন তিনি। এই রাজ্যের হয়ে খেলতে না পারার আক্ষেপ আভার কথায় ফুটে উঠেছে। নিজেও বঙ্গের হয়ে খেলতে চান তিনি। আভা আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেছেন, “এক জন অ্যাথলিট যখন খেলাধুলো শুরু করে তখন তার স্বপ্ন থাকে অলিম্পিক্স। আমারও সেই লক্ষ্য ছিল। আমি মহারাষ্ট্রের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করছি। কিন্তু শুরুটা করেছিলাম পশ্চিমবঙ্গে। ২০০৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের হয়ে খেলেছি।” এর পরই আভার গলায় অভিমান। বলেছেন, “সরকারি চাকরির জন্য অনেক বার চেষ্টা করেছি। কিন্তু স্পোর্টস কোটায় কোনও সুযোগ-সুবিধা পাইনি। বাধ্য হয়ে মহারাষ্ট্রে কাস্টমসে যোগ দিয়েছিলাম ২০১৯ সালে। ওখান থেকে বলা হয়েছিল মহারাষ্ট্রের হয়ে খেলতে হবে। আমার কাছে বিকল্প কোনও পথ ছিল না। তাই মহারাষ্ট্রের হয়েই খেলা শুরু করি। আমি এখনও বাংলায় ফিরতে চাই। মাটির বাড়িতে থাকি। সরকারি বাড়ির জন্য আবেদন করা হয়েছিল। কিন্তু পাইনি।”

আভার বাবা লক্ষ্মীকান্তও চান মেয়ে এ রাজ্যে ফিরে আসুক। তিনি বলেছেন, “বাংলার মেয়ে হয়েও মহারাষ্ট্রের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করতে যাচ্ছে আভা। কারণ, বাংলায় সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে না। বাংলার মেয়ের চাকরির কোনও ব্যবস্থা যদি করে সরকার তা হলে খুব ভাল হয়। তাতে মেয়েটা বাংলা ফিরে আসতে পারবে।”

আভা, লক্ষ্মীকান্তদের কথাতেই স্পষ্ট, কেন এই রাজ্য থেকে অলিম্পিক্সে প্রতিযোগীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। যে রাজ্য এক সময় বিশ্বমঞ্চে ভারতের নাম উজ্জ্বল করত, সেই রাজ্যের প্রতিযোগীকে এখন দূরবীন দিয়ে খুঁজতে হচ্ছে। সমস্যা রয়েছে। সমাধানের উপায়ও রয়েছে। কিন্তু যদি সেই সমাধান দ্রুত না হয় তা হলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আরও সমস্যায় পড়তে পারেন বাঙালি ক্রীড়াবিদেরা। কমতে কমতে সংখ্যাটা শূন্যে না পৌঁছে যায়। সেই ইঙ্গিতই পাওয়া যাচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE