হকিতে পেনাল্টি কর্নার থেকে গোল হওয়ার সংখ্যা কমছে। রক্ষণ ভাগের খেলোয়াড়রা এখন অনেক পরিকল্পনা করে নামছেন। —ফাইল চিত্র
২৬ বার সুযোগ পেয়েছিলেন হরমনপ্রীতরা। গোল করতে পেরেছেন মাত্র ৫টি। হকি বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ভারতের উঠতে না পারার অন্যতম প্রধান কারণ হিসাবে উঠে আসছে পেনাল্টি কর্নার থেকে গোল করতে না পারা। কিন্তু শুধুই কি ভারত এই সমস্যায় পড়েছে? এ বারের বিশ্বকাপের দিকে নজর রাখলে দেখা যাবে, জার্মানি, বেলজিয়ামের মতো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন দলেরও একই হাল। কিন্তু কেন পেনাল্টি কর্নার থেকে গোল আসছে না হকিতে? গোল করার সেরা অস্ত্র কি ভোঁতা হয়ে গিয়েছে?
ভারতে এর আগে সন্দীপ সিংহ, যোগরাজ সিংহ বা পরবর্তী কালে রূপিন্দর পাল সিংহরা পেনাল্টি কর্নার পেলেই জ্বলে উঠতেন। এমনও খেলা হয়েছে, যেখানে শেষ কয়েক মিনিটে পেনাল্টি কর্নার থেকে দুই-তিন গোল করে দলকে ম্যাচ জিতিয়েছেন তাঁরা। একই সারিতে পড়েন পাকিস্তানের সোহেল আব্বাস। পেনাল্টি কর্নার থেকে তাঁর গোল করার ক্ষমতা পড়শি দেশকে অনেক ম্যাচ জিতিয়েছে। গোল না হলে বক্সে ঢুকে প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়ের পায়ে বা গায়ে বল লাগিয়ে পেনাল্টি কর্নার আদায়ের পরিকল্পনা যুগের পর যুগ ধরে চলে আসছে। তা হলে এখন গোল হচ্ছে না কেন? ভারতের বিদায়ে এই প্রশ্ন আরও বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পরিসংখ্যানের দিকে চোখ রাখলেই বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যাবে। বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব ও ক্রসওভার মিলিয়ে চারটি ম্যাচে ভারত ২৬টি পেনাল্টি কর্নার থেকে মাত্র ৫টি গোল করতে পেরেছে। তার মধ্যে ক্রসওভারে নিউ জ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধেই ১০টি পেনাল্টি কর্নার পেয়েছিল ভারত। গোল হয়েছে মাত্র ১টি। অর্থাৎ প্রতি ৫টি শটে ১টি গোল করেছে ভারত। হরমনপ্রীতের মতো পেনাল্টি কর্নার বিশেষজ্ঞ বার বার ব্যর্থ হয়েছেন। সেখানে টোকিয়ো অলিম্পিক্সে ৩১টি পেনাল্টি কর্নার থেকে ১০টি গোল করেছিল ভারত। অর্থাৎ, প্রতি ৩টি শটে এক বার করে বল জালে জড়িয়েছিলেন ভারতীয় ড্র্যাগ ফ্লিকাররা।
এ তো গেল ভারতের কথা। বাকিরা? শুধু মাত্র পেনাল্টি কর্নার থেকে গোল করার দক্ষতা দেখে আর্জেন্টিনার হকি খেলোয়াড় গঞ্জালো পেলাটকে নাগরিকত্ব দিয়ে দলে নিয়ে এসেছিল জার্মানি। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে ৭টি পেনাল্টি কর্নার থেকে মাত্র ১টি গোল করেছে জার্মানি। গোল করতে পারেনি পেলাট। গত বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন বেলজিয়ামের অবস্থা ভারতের থেকেও খারাপ। গ্রুপে ১৮টি পেনাল্টি কর্নার থেকে মাত্র ২টি গোল করেছে তারা। এ বারের হকি বিশ্বকাপের গ্রুপ লিগে মোট ১৯৫টি পেনাল্টি কর্নার হয়েছে। গোল এসেছে ৩২টি। অর্থাৎ, প্রতি ৬টি পেনাল্টি কর্নার থেকে ১টি গোল। এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে, পেনাল্টি কর্নারের ধার কতটা কমেছে।
পেনাল্টি কর্নার থেকে গোলের সংখ্যা কমে যাওয়ার পিছনে প্রধান কারণ হিসাবে উঠে আসছে প্রযুক্তি। এখন প্রতিটি দল প্রতিপক্ষ দলের পেনাল্টি কর্নার বিশ্লেষণ করে পরিকল্পনা করছে। কোন খেলোয়াড় কোন দিকে শট নেন, সেটা ভাল করে খতিয়ে দেখছে সব দল। তার জন্য আলাদা বিশেষজ্ঞ রয়েছে। সেটাই কাজে দিচ্ছে।
দ্বিতীয় আর একটি কারণ, রক্ষণ ভাগের খেলোয়াড়দের গতি। পেনাল্টি কর্নার নেওয়ার সময় অনেক দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছেন তাঁরা। ফলে যিনি শট মারবেন তিনি সময়ই পাচ্ছেন না। অনেক সময় শট মারার আগেই ডিফেন্ডার এসে বল বার করে দিচ্ছেন। পেনাল্টি কর্নার নেওয়ার সময় সাধারণত প্রতি ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে শট মারেন স্ট্রাইকার। বল গায়ে লাগলে আহত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু তার পরেও এগিয়ে আসতে ভয় পাচ্ছেন না ডিফেন্ডাররা। তার পিছনে রয়েছে উন্নত বর্মের ব্যবহার।
প্রাক্তন অলিম্পিয়ান গুরবক্স সিংহ আনন্দবাজার অনলাইনকে জানালেন, প্রযুক্তির উন্নতির কারণেই পেনাল্টি কর্নার থেকে গোল হওয়ার সংখ্যা কমেছে। তিনি বলেছেন, ‘‘আগেকার দিনে আগুয়ান খেলোয়াড়দের শরীরে কোনও বর্ম থাকত না। তাই তারা কিছুটা হলেও ভয় পেত। সেই কারণে শট মারার সময় অনেকটা পাওয়া যেত। কিন্তু এখন ডিফেন্ডারদের মুখ, হাত, হাঁটু ঢাকা থাকে। তাই আহত হওয়ার কোনও আশঙ্কা নেই। দ্রুত ছুটে আসছে তারা। শট মারার সময় পাচ্ছে না স্ট্রাইকাররা। গোলরক্ষকের থেকে বেশি গোল ডিফেন্ডাররা বাঁচিয়ে দিচ্ছে।’’
এখন প্রতিপক্ষকে নিয়ে পরিকল্পনা অনেক বেশি হয়। সেখানে গোল করার থেকে গোল আটকানোর দিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে মনে করেন গুরবক্স। তিনি বলেছেন, ‘‘আগে কোচেরা বলত গোল করার কথা। আক্রমণকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হত। কিন্তু এখন রক্ষণকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সেই কারণে পেনাল্টি কর্নার আটকানোর পরিকল্পনা করছে প্রতিটা দল। তাই গোল হচ্ছে না।’’ তবে এই সময় বেশি দিন চলবে না বলে আশাবাদী ১৯৬৪ সালের টোকিয়ো অলিম্পিক্সে সোনাজয়ী খেলোয়াড়। তাঁর মতে, পেনাল্টি কর্নার থেকে গোল করার নতুন নতুন উপায় খুঁজে বার করবেন কোচেরা। আগামী দিনে সেটা দেখা যাবে।
প্রযুক্তির কথা বলেছেন ভারতের আর এক প্রাক্তন হকি খেলোয়াড় রূপিন্দরও। টোকিয়ো অলিম্পিক্সে ব্রোঞ্জ জিতেছিলেন রূপিন্দর। তার পরে অবসর নেন তিনি। রূপিন্দরের কথায়, ‘‘পেনাল্টি কর্নার আটকানো একটা বিশেষ কৌশল। প্রতিটা দলের সঙ্গে এক জন করে ভিডিয়ো অ্যানালিস্ট থাকেন। তিনি বিশ্লেষণ করে জানিয়ে দেন, কোন স্ট্রাইকার কোন দিকে বেশি শট নেয়। কোন সময় কী ভাবে দৌড়লে শট বাঁচানো যাবে। তবে ভারত যে গোল করতে পারছে না তা নয়, ভারত গোল বাঁচানোর ক্ষেত্রেও দক্ষতা দেখাচ্ছে।’’
তবে এই পরিস্থিতিতেও গোল করা যায় বলে মনে করেন রূপিন্দর। তার জন্য স্ট্রাইকারদের বিশেষ পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ‘‘পেনাল্টি কর্নার নেওয়ার সময় স্ট্রাইকারদের মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে আরও ভুল হচ্ছে। সরাসরি গোল করতে না পারলে অন্য ভাবে গোল করার পরিকল্পনা করতে হবে। পুরোটাই অনুশীলনের বিষয়। টোকিয়ো অলিম্পিক্সেও আমরা মাথা ঠান্ডা রেখে পেনাল্টি কর্নার থেকে সাফল্য পেয়েছিলাম।’’
এ বারের বিশ্বকাপ থেকে তো ছুটি হয়ে গিয়েছে ভারতের। কোচ গ্রাহাম রিডের অধীনে সাফল্য আসেনি। কিন্তু অস্ট্রেলীয় কোচের উপরেই ভরসা দেখাচ্ছে ভারতীয় হকি ফেডারেশন। পেনাল্টি কর্নারের ধাঁধার সমাধান রিডের সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ। পারবেন তো তিনি!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy