মাত্রই শেষ হওয়া অনূর্ধ্ব উনিশ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে হেরে গেল বাংলাদেশ। অপ্রত্যাশিত হার। আফশোসে ভেঙে পড়ল গোটা দেশ। সেই আফশোসের মধ্যে কিন্তু ধাঁধা ছিল একটা। ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না ফাইনালে উঠতে না পারা, নাকি ভারতকে হারানোর সুযোগ হাতছাড়া হওয়া কোনটার জন্য বাংলাদেশের দুঃখটা বেশি।
সে দিন সন্ধেয় দুঃখে ভেঙে পড়া একজনের সঙ্গে কথোপকথনটা তুলে দিলে বিষয়টা আরও স্পষ্ট হবে। হতাশ গলায় বললেন, ‘‘স্বপ্নটা শেষ হয়ে গেল।’’
‘‘ঠিক। ফাইনালের এত কাছে গিয়ে...’’
‘‘ফাইনালের কাছে নয়, বলো ভারতকে হারানোর এত কাছে...’’
ফাইনালে ভারত-বধ হল। ওয়েস্ট ইন্ডিজ হারিয়ে দিল তাদের। এ বার এক হিসেবে আফশোস কমার কথা, আমরা পারিনি কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজ তো পেরেছে। আবার দেখা হল সেমিফাইনালের দিনে স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় ভেঙে পড়া মানুষটির সঙ্গে। কণ্ঠে আর্তনাদ, ‘‘ইস ফাইনালে যেতে পারলেই...ওয়েস্ট ইন্ডিজ সে দিন গোলমালটা না করলেই...’’
‘‘কিন্তু কাজ তো হয়েছে। ভারত হেরে গিয়েছে।’’
‘‘সে জন্যই তো দুঃখটা বেশি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ যখন পেরেছে তখন আমরাও ভারতকে হারাতে পারতাম। এমন সুযোগ! উফ!’’
এর পর আর খুব কিছু বলার থাকে না। বোঝার থাকে শুধু। সেই বোঝাটা হল বাংলাদেশ তার ক্রিকেট উন্মাদনার চূড়ান্ত প্রকাশের মঞ্চ হিসেবে নির্ধারণ করে ফেলেছে ভারত ম্যাচকে। ভারতের সঙ্গে ম্যাচ এবং তাদের হারানোই বাংলাদেশের ক্রিকেট-স্বপ্নের সীমান্ত। আর তাই আজ যখন আবার বাংলাদেশ-ভারত মুখোমুখি, মাঠের ক্রিকেটের অঙ্ক ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছে দু’দেশের আধুনিক ক্রিকেট সম্পর্ক। আজকের ম্যাচটা তাই সেই ঝাঁঝালো ক্রিকেট সম্পর্কের আর একটা অধ্যায়ের মঞ্চায়ন। আর তাই মাহমুদউল্লাহ-র বিশ্বকাপ আউট বিতর্ক, ধোনির মুস্তাফিজুর রহমানকে ধাক্কা জাতীয় ঘটনাগুলো স্মৃতির দেওয়াল ভেঙে উঠে আসে। চোখ রাঙায় বিরোধের নতুন ডালপালা। কোনও নতুন তিক্ততার স্রোত যেন ঝাপটা দেয় আগাম।
যদিও সাধারণ ধারণা যে, গত বিশ্বকাপের বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচ নিয়ে উত্তেজনার শুরু। কিন্তু সেই ম্যাচে আসলে প্রকাশটা ঘটেছিল প্রথম। তলে-তলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে উত্তেজনা অনেক দিনের। আগের দিনগুলোতে ক্রিকেটীয় শক্তিতে ঠিক পাল্লা দেওয়া যাচ্ছিল না বলে অতটা উত্তেজনা ভেতরেই রয়ে যাচ্ছিল। বিশ্বকাপ বা তার পরের সিরিজে যখন দেখা গেল শক্তিতেও বাংলাদেশ পাল্লা দিতে সক্ষম, তখনই খুলে গেল উন্মাদনার বন্ধ দরজাটা। আর সেই দরজা দিয়ে রাজনীতি-সংস্কৃতি, বড় প্রতিবেশী-ছোট প্রতিবেশীর অঙ্কও ঢুকে পড়ে দিব্যি। পৃথিবীর সব জায়গায় ছোট প্রতিবেশীরা সব সময় নিজেদের বঞ্চিত মনে করে। অন্য ক্ষেত্রে সেই বঞ্চনার জবাব দেওয়ার খুব সুযোগ থাকে না বলে ওরা অপেক্ষা করে থাকে খেলার মাঠের। আর এ ভাবেই নানান বঞ্চনাবোধ ক্রিকেটের পিঠে এমন সওয়ার হয়ে যায় যে ম্যাচটা যেন প্রায় ‘যুদ্ধ’।
একটা সময় বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নিয়ে বাংলাদেশের অভিযোগের শেষ ছিল না। ইদানিং তিস্তার জল বন্টন প্রশ্নেও অনেক আফশোস। মাটি ফুঁড়ে বেরনো মুস্তাফিজুর হাতে যেন সেই আফশোস মিটিয়ে দেওয়ার টিকিট, যেন আধুনিক ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের জন্য দুর্ভেদ্য কাঁটাতারের বেড়া। আর বিরাট কোহলি সেটা মানলেনও। মঙ্গলবার সাংবাদিক সম্মেলনে এসে ভারতীয় টেস্ট অধিনায়ক মুস্তাফিজুরের গুরুত্বটাকে শুধু এই ম্যাচ বা বাংলাদেশে সীমাবদ্ধ না রেখে বৃহত্তর ক্ষেত্রে ছড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘‘ওর মতো বোলার ক্রিকেটের জন্যই রোমাঞ্চকর। ওর সঙ্গে খেলতে গেলে হোমওয়ার্ক করতে হয়। নিজেদের উন্নতির চেষ্টা করতে হয়।’’ শুনে বাংলাদেশ অধিনায়ক মাশরফি মর্তুজার যেন প্রায় হাসি পায়। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে যা বললেন, এর অর্থ মুস্তাফিজুর এমনই এক ধাঁধার নাম যার জবাব পেতে কোহলি বা ভারতের বিশ্বসেরা ব্যাটিংয়েরও সময় লাগবে। তপস্যা লাগবে। গত বছর জেতা ওয়ান ডে সিরিজে ভারতকে দুঃস্বপ্ন উপহার দেওয়া মুস্তাফিজুর তাই আজও বাংলাদেশের শক্তি আর সম্ভাবনার লাটাই হাতে। আর মুস্তাফিজেই অনভিজ্ঞতা, শক্তিগত ঘাটতি ঘুচিয়ে বাংলাদেশও সমান-সমান ম্যাচের স্বপ্নে তৈরি।
বাংলাদেশ-ভারত ক্রিকেট সম্পর্কের মতো বুধবারের এই ম্যাচটা আর একটা সম্পর্কেরও সূচক। এই নিয়ে টানা তৃতীয় বার বাংলাদেশে হচ্ছে এশিয়া কাপ। কোনও মহাদেশীয় প্রতিযোগিতা কোনও একটা দেশে টানা তৃতীয় বার হওয়া প্রায় হাস্যকর একটা ব্যাপার। কিন্তু এটাও তো ঠিক বাংলাদেশ আয়োজন করছে বলেই না এশিয়া কাপটা নিয়মিত হচ্ছে। আর এশিয়া কাপটাকে বাংলাদেশ এমন ভাবে নিজেদের করে নিয়েছে যে কারও কারও-র কাছে এটার নাম এখন হওয়া উচিত ‘বাংলাদেশ কাপ।’
সেই ‘বাংলাদেশ কাপে’ প্রথম ম্যাচেই বাংলাদেশ-ভারত মুখোমুখি। অ্যাসেজ ঐতিহ্য নিয়ে এখন গুদামে ঢুকেছে, ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেটটা অনিয়মিত হয়ে-হয়ে প্রায় জলে ডুবতে বসেছে। আর সেই সময়ই বাংলাদেশ-ভারত এসেছে উত্তেজনার নতুন আগুন নিয়ে। নতুন এক ঝাঁঝালো ক্রিকেট-সম্পর্ক। বিরোধ আর ভ্রাতৃত্বের মধ্যে রাজনীতি সংস্কৃতি ঢুকে গিয়ে ক্রিকেটের আধুনিক ‘যুদ্ধ’।
ক্রিকেট-পৃথিবীতে এখন বড় বেশি শান্তি বিরাজ করছে। আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটসূত্রে খেলোয়াড়দের এমন বন্ধুত্ব যে মাঝেমধ্যে মনে হয় এরা বোধহয় বন্ধুসভা বানাতে মাঠে এসেছে। এক-আধটা জায়গায় এ রকম উত্তেজনা থাকুক না! হোক না একটা ‘যুদ্ধ’।
মীরপুর স্টেডিয়ামে আজকের সন্ধেয় ধোনি-মাশরফিদের হাতের ব্যাট-বলকে ঢাল-তলোয়ার মনে হওয়াতে তাই দোষের কিছু নেই। (লেখক দৈনিক কালের কণ্ঠ-র উপ সম্পাদক)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy