যুযুধান: বিশ্বকাপ জয়ের মাঠে সোমবার নেটে আক্রমণাত্মক মেজাজে কোহালি। (বাঁ দিকে) অনুশীলনে মগ্ন স্টিভ স্মিথও।—ছবি পিটিআই ও এপি
বিরাট কোহালি বনাম প্যাট কামিন্স।
রোহিত শর্মা বনাম মিচেল স্টার্ক।
কে এল রাহুল বনাম জশ হেজ্লউড।
ডেভিড ওয়ার্নার বনাম যশপ্রীত বুমরা।
স্টিভ স্মিথ বনাম মহম্মদ শামি।
সব ক’টাই এমন জিভে জল এনে দেওয়া লড়াই যে, মনে হতে পারে মঙ্গলবার বুঝি আরব সাগরের পাড়ে তারকাদের দ্বৈরথের হাট বসছে। হালফিলে ঘরের মাঠে কোহালিদের আর কোনও সিরিজকে ঘিরে এতটা আন্দোলিত হতে দেখা যায়নি ক্রিকেট মহলকে। প্রবীণ আমরের সঙ্গে দেখা হল। সকাল থেকে ঘুরে ঘুরে নানা পরিচিতের থেকে টিকিট কালেক্ট করে যাচ্ছেন। মুম্বইয়ের ক্রিকেট মন্দির যেখানে অবস্থিত, সেই শিবাজি পার্ক থেকে মেরিন ড্রাইভ— শহরের নানা জায়গায় অনেকে বসে আছেন রমাকান্ত আচরেকরের ছাত্র এবং সচিন তেন্ডুলকর-বিনোদ কাম্বলিদের সারদাশ্রম স্কুলের ছাত্র আমরের থেকে টিকিট পাওয়ার আশায়। মুম্বই ক্রিকেট সংস্থার ক্যান্টিনেও সকাল থেকে অনেকের ভিড়। আরও কয়েক জন প্রাক্তন ক্রিকেটারকে দেখা গেল। কারও কারও মতে, সত্যিকারের দু’টো সেরা দলের মুখোমুখি সাক্ষাৎ ঘটছে অনেক দিন পরে। হালফিলে যা ম্যাচ হয়েছে, সবই তো হয় বাংলাদেশ, নয় শ্রীলঙ্কা, অথবা ধুঁকতে থাকা ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে। মহাসংঘর্ষের সেই ঝনঝনানিটাই তো দেখা যাচ্ছিল না।
বিশ্বের দুই সেরা ব্যাটসম্যানকে দেখা যাবে সম্মুখ সমরে। কে বেশি ভাল? কোহালি না স্মিথ? অস্ট্রেলীয় ব্যাটসম্যানকে লাল বলে এগিয়ে রাখেন অনেকে। তেমনই সাদা বলে সেরা মনে করা হয় কোহালিকে। সব মিলিয়ে পরিসংখ্যান দেখলে ভারত অধিনায়ক অনেকের ধরাছোঁয়ার বাইরে। তিন ধরনের ক্রিকেটেই পঞ্চাশের উপর গড় থাকা একমাত্র ব্যাটসম্যান তিনি।
আর ম্যাচের আগের দিনের মহড়াতেই যা সব ছবি দেখা গেল, কে বলবে শুধুই নেট প্র্যাক্টিস চলছে! আসল দ্বৈরথের চব্বিশ ঘণ্টা আগেই কোহালিকে দেখে মনে হচ্ছিল, ম্যাচ শুরু হয়ে গিয়েছে। আউট হলে আবার ব্যাট করা যাবে। তার উপরে তিনি যে দলের অধিনায়ক। কার ঘাড়ে ক’টা মাথা আছে যে, বার করে দেবে! কোনও আম্পায়ারও নেই যে, ডব্লিউ জি গ্রেসের ঢংয়ে স্টাম্পের উপরে বেল সাজাতে সাজাতে বলতে হবে— ওরে, মাঠে এতগুলো লোক এসেছে তোর আম্পায়ারিং নয়, আমার ব্যাটিং দেখতে! বোল্ড হয়েও সোজা আবার ব্যাট করতে দাঁড়িয়ে গেলেই হয়। নেট মানে তো ‘ক্রিকেট এক বলের খেলা’, এই ধুকপুকানিটাই থাকে না!
এই কারণেই কি ওয়াংখেড়েতে সর্বকালের অন্যতম সেরা পারফরম্যান্স করা ইয়ান বোথাম বলেছিলেন, ‘‘নেট মানে আমি বুঝি মাছ ধরার জাল!’’ কে জানে! তবে বিরাট কোহালি— ক্রিকেট মাঠে যাঁর মাচো ভঙ্গি একই সঙ্গে ভিভ রিচার্ডস আর ইয়ান বোথামকে মনে করিয়ে দেয়, তিনি যে নেট বলতে মাছ ধরার জাল বোঝেন না, সোমবার সকালেই দেখে নেওয়া গেল। প্রথমে রুটিনমাফিক পেস ও স্পিনারদের নেটে আলাদা করে ব্যাট করলেন। কোহালিসুলভ প্রস্তুতি দেখা গেল একেবারে শেষের দিকে।
উল্টো দিকে তখন বল হাতে যশপ্রীত বুমরা। মুহূর্তে ওয়াংখেড়ের পরিবেশটাই যেন পাল্টে গেল। মনে হচ্ছিল, অদৃশ্য কোনও আম্পায়ার বলে দিয়েছেন ‘প্লে’। আর এ যুগের অন্যতম সেরা ফাস্ট বোলার ছুটছেন বর্তমান প্রজন্মের সেরা ব্যাটিং আকর্ষণকে বল করতে! এতক্ষণ নেট প্র্যাক্টিস চলছিল। এ বার ‘ম্যাচ’ শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রত্যেকটা বলে মৃত্যুপরোয়ানা লেখা। ব্যাটসম্যানদের জীবন যে রকম হয়! এতক্ষণ গাছ, ডালপালা, আকাশ-বাতাস নানা ছবি ছিল। এ বার লক্ষ্যভেদী শুধুই পাখির চোখ দেখছেন! এত দিন বুমরাকে নেটে খেলার সময় অতি সাবধানী দেখিয়েছে বিরাটকে। এ দিন দেখাল অতি আগ্রাসী। তখনও অস্ট্রেলিয়া দল মাঠে আসেনি। বুমরার বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক বিরাটকে দেখলে নিশ্চয়ই তাদের বোলারদের রাতের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারত।
এমনিতে বুমরা যে রকম নীরব, প্রতিক্রিয়াহীন ভঙ্গিতে বল হাতে ধ্বংসাত্মক হয়ে ওঠেন, অনায়াসে তাঁর নামকরণ করা যেতে পারে ‘নিঃশব্দ ঘাতক’। তিনি একদম বোলারদের ধোনি। বল হাতে ‘মিস্টার কুল’। স্লেজিং করেন না। কারও দিকে তেড়ে যান না। খুব একটা সরব উৎসবের ভঙ্গি দেখা যায় না। এমন ‘জেন্টলম্যান’ পেসারের হাত থেকেই একের পর এক মিসাইল ধেয়ে আসে ব্যাটসম্যানদের জন্য।
কোহালি নিজেই পরে সাংবাদিক সম্মেলনে এসে বলছিলেন, নিজের দলের বোলারদের মাথায় বা পাঁজরে আঘাত করতেও দ্বিধা বোধ করেন না বুম বুম বুমরা। সতীর্থ বলে বিশেষ কোনও দয়ামায়া নেই। ‘‘চার বছর ধরে বুমরা দেশের হয়ে খেলছে। এটা সম্ভবত দ্বিতীয় বার, যখন নেটে আমি ওর বলে আউট হইনি। এর আগে ২০১৮-তে অ্যাডিলেডে টেস্টের আগে নেটে ওর বলে আউট হইনি,’’ বলার সময় কোহালির গলায় যেন যুদ্ধ জয়ের তৃপ্তি। ওয়াংখেড়ের মূল বাইশ গজের ঠিক পাশেই নেটের মধ্যে ব্যাট করছিলেন কোহালি। উপরে আচ্ছাদন নেই। বুমরার শেষ বলটা পাঁজরের দিকে ধেয়ে আসা মিসাইল। কোহালি চকিতে পিছনের পায়ে এলেন। ঠিক যে ভাবে কোনও বক্সার ‘পোজিশন’ নেয়। তার পর সপাটে পুল আছড়ে পড়ল গ্যালারিতে। একেবারে নক-আউট পাঞ্চ। মেরেই দু’হাত তুলে উৎসবের ভঙ্গিতে উল্লাস করতে করতে নেট থেকে বেরিয়ে গেলেন কোহালি। দেখে মনে হবে যেন জয়সূচক স্ট্রোক মেরে দলকে জিতিয়ে বেরোচ্ছেন। পরে সাংবাদিক সম্মেলনে এসে ভাঙলেন, ‘‘শটটা মারার পরেই কী হবে, আমি জানতাম। বুমরা পরের বলে আমাকে নক-আউট করে দেবে। ওকে তাই আর বোলিং মার্কে ফিরে যাওয়ার সুযোগটাই দিলাম না। ওয়াংখেড়েতে তো অন্তত আমি জিতে বেরোই!’’
সত্যিই কে বলবে নেট প্র্যাক্টিস! মহড়াতেই যেন ম্যাচের আবহ। একটু পরে স্টিভ স্মিথ নামক এ যুগের আর এক ব্যাটিং মহারথীকে দেখা গেল, মাঠে এসে ভারতীয় বোলারদের নেটে গিয়ে পড়ে থাকতে। সুনীল গাওস্কর চিরকাল এ ভাবে তৈরি হয়েছেন। সানি বিশ্বাস করতেন, যে দেশে যাবে সেখানকার স্থানীয় বোলারদের বিরুদ্ধে খেললে তবেই সঠিক প্রস্তুতি হয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজে এক বার নেট প্র্যাক্টিসে খালি পায়ে এক স্থানীয় বোলার চলে এলেন। এঁকেবেঁকে দৌড়ে এসে গোলার মতো বল করছেন। গাওস্কর বিরক্ত হয়ে বেরিয়ে গেলেন না। ধৈর্য ধরে সেই বোলারকে খেললেন। পরে ব্যাখ্যা করেছিলেন, ‘‘ম্যাচে পুরো আবহটাই তো অচেনা থাকবে। প্র্যাক্টিসে অচেনা, অজানা বোলারকে খেললে একই সঙ্গে টেকনিক, মানসিকতা, ধৈর্য, মনঃসংযোগ, সব কিছুর অনুশীলনটা হয়ে যাবে।’’ স্মিথকেও যাঁরা বল করতে এলেন, তাঁদের কেউ এলেবেলে লেগস্পিন করেন। কেউ সুন্দর ফ্লাইট থাকা অফস্পিনার। কেউ আবার বাঁ-হাতি স্পিনার। সঙ্গে জোরে বোলার তো ছিলই। সব রকমই থাকতে পারে মঙ্গলবারের মেনুতে। আর সানির মতো একাগ্রতা নিয়েই ব্যাটিং অনুশীলনে ডুবে থাকতে দেখা গেল স্মিথকে। ভারত অধিনায়কের মতো আগ্রাসী না দেখালেও সেই মূর্তিমান মনঃসংযোগ। প্রত্যেকটা বল খেললেন ম্যাচের মতো সম্মান দেখিয়ে। পুরনো সেই মন্ত্র। মঞ্চে ওস্তাদ হতে গেলে যে রেওয়াজে ফাঁক রাখা চলবে না।
রাতের ওয়াংখেড়েতে বসে মনে হচ্ছে, সকালে মাঠে ঢোকার সময়ে ভুল ভাবছিলাম। ম্যাচটা কোহালি বনাম স্মিথের নয়। ওয়াংখেড়েতে মঙ্গলবারের দ্বৈরথ আসলে সাধনা বনাম অধ্যবসায়ের!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy