বিধ্বস্ত নাইট বাহিনী। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস
কলকাতা নাইট রাইডার্স: ১৮৩-৫ (২০ ওভার)
রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু: ১৮৬-১ (১৮.৪ ওভার)
কলকাতা নাইট রাইডার্সের বিরুদ্ধে ১৮৩ তাড়া করে জিতলেন বিরাট কোহালি। আট বল বাকি থাকতে, ন’উইকেটে জিতলেন বিরাট কোহালি।
জিতলেন ঠিকই, কিন্তু জিতলেন কোথায়? ইডেনে? না কি তাঁর ঘরের মাঠ চিন্নাস্বামীতে?
আধুনিক ক্রিকেটবিশ্বে বিরাট কোহালি মানে কী, আধুনিক ক্রিকেটে তাঁর জায়গা কোথায়, তিনি কোথায় গিয়ে থামবেন, এ সব আলোচনা নিরর্থক করে দিয়েছেন বিরাট কোহালি নিজেই। ম্যাচের পর ম্যাচ, ইনিংসের পর ইনিংস যা করে যাচ্ছেন, তাতে ব্যাটিংয়ের সঙ্গে বাস্তবের যোগসূত্র ক্রমশ ক্ষীণ দেখাচ্ছে।
সোমবারের ইডেনে যা ঘটে গেল, সেটাও তো বাস্তব কম, রূপকথা বেশি মনে হবে!
সন্ধে সাড়ে ছ’টা নাগাদ প্র্যাকটিসের নেটে দেখা গেল আঠারো নম্বর লাল-কালো জার্সি। ইডেন গ্যালারির গর্জন শুনে তখন মনে হবে, ঘরের টিমের কেউ ম্যাচে চার-ছক্কা মারলেন বুঝি! টসে জিতলেন বিপক্ষ অধিনায়ক, ফেটে পড়ল গৌতম গম্ভীরের ঘরের মাঠ!
এটা যদি পূর্বাভাস হয়, তা হলে আসল ঝড়টা উঠল আরসিবি ইনিংসে। যত বার ক্রিজে স্টান্স নিলেন বেঙ্গালুরু অধিনায়ক, তত বার ইডেন জুড়ে ‘বি-রা-ট, বি-রা-ট’ যুদ্ধমন্ত্রের প্রতিধ্বনি। তিনি হাফসেঞ্চুরির দোরগোড়ায়, তিনি দল আর জয়ের ব্যবধান ক্রমশ কমিয়ে আনছেন, আর ইডেন ঘরের টিমের হার চেয়ে চেঁচাচ্ছে তাঁর নাম ধরে, তাঁর টিমের নাম ধরে!
ক্রিকেট থেকে কি ঘরের মাঠের সমর্থন ব্যাপারটাই লোপাট করে দিচ্ছেন বিরাট কোহালি?
না হলে উইক ডেজের (তা-ও সপ্তাহের প্রথম কাজের দিন) ইডেন কী করে এ বারের আইপিএলের সবচেয়ে বেশি দর্শক দেখছে? না হলে ঘরের ছেলেদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া ক্রিস গেইলের এক-একটা ছক্কায় কী করে এমন দানবীয় উল্লাস সৃষ্টি হচ্ছে? না হলে কী ভাবে শাহরুখ খানের উপস্থিতি উপেক্ষা করে তাঁর টিমের প্রতি এ রকম বৈমাত্রেয়সুলভ আচরণে মেতে উঠছে তাঁরই আদরের ইডেন? না হলে ঘরের টিমের হারের পরেও কী ভাবে মাঠ ভর্তি থাকছে, ঘরের টিমের সংহারককে ম্যাচের সেরার পুরস্কার নিতে দেখবে বলে!
সোমবারের ইডেনে কোনও এগজিট পোল সম্ভব ছিল না। মধ্যরাত পেরিয়ে মনে হচ্ছে, তার ন্যূনতম দরকারও তো নেই। কারণ এ দিন ইডেনে কোনও লড়াই-ই হয়নি। কারণ এ দিন ইডেনে নামার অনেক, অনেক আগে থেকেই তার মন জিতে নিয়েছিলেন সম্রাট বিরাট। মাঠে নেমে সেই সত্যের প্রমাণ দেওয়াটা বাকি ছিল, দিয়ে দিলেন।
আর দিলেন কী ভাবে! ইডেন পিচে ১৮৩ ভাল নয়, বেশ ভাল স্কোর ছিল। তা সে যতই আরসিবির উপর ব্যাটিং দেবতার আশীর্বাদ থাকুক, কেকেআর বোলিংও তো কম যায় না। সুনীল নারিন-পীযূষ চাওলা-মর্নি মর্কেলদের বিরুদ্ধে তাঁদের ঘরের মাঠে নয়ের উপর আস্কিং রেট নিয়ে নামা আরসিবির পক্ষে অসম্ভব না হতে পারে, কিন্তু সহজও ছিল না। তার উপর যোগ করতে হবে বৃষ্টির আশঙ্কা এবং ডাকওয়ার্থ-লুইসের গোলকধাঁধায় পথ হারানোর ভাল রকম সম্ভাবনা। আস্কিং রেট আপনাআপনিই বেড়ে থাকবে।
ইনিংস ব্রেকে এ সব নিয়ে জমাট আলোচনা করেননি, এমন ক্রিকেটভক্ত বোধহয় নেই। কিন্তু সেই আলোচনা দীর্ঘস্থায়ী হতে দেয়নি আরসিবি। বিরাটের সঙ্গে ওপেন করতে নেমে মন দিয়ে নাইট-নিধন মেগা সিরিজের নতুন একটা অধ্যায় লিখতে শুরু করেছিলেন ক্রিস গেইল। কেকেআরের বিরুদ্ধে তাঁর স্ট্রাইক রেট দেড়শোর উপর। এ বারের আইপিএলে এখনও পর্যন্ত ব্যর্থ গেইল বোধহয় ইডেন ম্যাচের জন্যই অ্যালার্ম দিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন! আন্দ্রে রাসেলের এক ওভারে পরপর দুটো ছক্কা মারলেন— একটা হাইকোর্ট এন্ডের সাইটস্ক্রিন টপকে গেল, অন্যটা যেন ‘ডি’ ব্লকের দর্শকদের কুর্নিশ করে পড়ল ঠিক তার সামনে।
নারিনের বলে গেইলের লেগ বিফোর নিয়ে সন্দেহ থাকতে পারে, কিন্তু তার পর যেটা হল, তা নিয়ে সন্দেহ থাকার কথা নয়। কারণ তখন ক্রিজে বিরাটের সঙ্গে ব্যাট করতে নামা ডে’ভিলিয়ার্সের। এবং তখনই শুরু আরও একটা এবি-কোহালি বীরকাব্যের। হাতে বেশ ভাল রকম চোট নিয়ে, আঠা-আঠা উইকেটে বিরাটের ৫১ বলে অপরাজিত ৭৫ তাঁর ক্রিকেট-গরিমার রেকর্ড-বইয়ের উপরের দিকে থাকার কথা। চাওলাকে লং অনের উপর দিয়ে ছক্কা মারা যদি তাঁর প্রতিভার উদ্ধত প্রদর্শন হয়, তা হলে নিয়মিত সিঙ্গলস আর দুই নিয়ে যাওয়াটা তাঁর নীরব পরিশ্রমের প্রতীক। এবি— যে ব্যাটিং-বিস্ময় চার ওভারে একশো তুলে দেন, তাঁর কাছে ৩৯ বলে ৫১ রান করা আর প্র্যাকটিস ম্যাচ খেলাটা বোধহয় সমান।
আর গৌতম গম্ভীর? তাঁকে দোষ দেওয়া যায় না। ব্যাট করতে নেমে তিন ওভারের মধ্যে রবিন উথাপ্পা ফিরে যাওয়ার পর মণীশ পাণ্ডের সঙ্গে নাইট ইনিংসের হালটা তিনিই ধরেছিলেন। পরে আন্দ্রে রাসেল আর সাকিব আল হাসান ২৮ বলে ৫৮ রান জুড়লেন ঠিকই, কিন্তু শুরুর দিকে গম্ভীর-মণীশের ওই ৭৬ রানের পার্টনারশিপটা না থাকলে কেকেআরের স্কোর দেড়শো পেরোতো কি না সন্দেহ।
গম্ভীরকে দোষ দেওয়া যায় না। আরসিবির মেসি-নেইমার-সুয়ারেজের একত্রে ঝলসে ওঠার দিনে পৃথিবীর কোন ক্যাপ্টেনেরই বা কী করার থাকতে পারে? দিনটাকে, ম্যাচটাকে বিপক্ষ মালিকানায় নীরবে চলে যেতে দেখা ছাড়া? হাত থেকে তো একটা ক্যাচও পড়ল। বিরাটেরই পড়ল। কিন্তু বিরাট তার পরেও গম্ভীরকে রেয়াত করেননি। প্লে-অফের নিশ্চয়তা কেড়ে নেওয়ার পাশাপাশি তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছেন আরও বেশি কিছু।
শোনা যায়, জন্মস্থান দিল্লির সঙ্গে গম্ভীরের সম্পর্ক তেমন ভাল নয়। কলকাতা তাঁর দ্বিতীয় ঘর। সোমবার গৌতম গম্ভীরের কাছ থেকে সেটাও কেড়ে নিলেন বিরাট কোহালি!
সংক্ষিপ্ত স্কোর: কলকাতা নাইট রাইডার্স ১৮৩-৫ (গম্ভীর ৫১, মণীশ ৫০), রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু ১৮৬-১ (বিরাট ৭৫ ন.আ., ডে’ভিলিয়ার্স ৫৯ ন.আ. গেইল ৪৯)।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy