রঞ্জি ফাইনালে এই ইতিবাচক মানসিকতাই তফাত গড়ে দিতে পারে বলে মনে করছেন উৎপল চট্টোপাধ্যায়।
ক্রিকেটার হিসেবে জিতেছেন রঞ্জি ট্রফি। এ বার কোচ হিসেবেও দাঁড়িয়ে রঞ্জি ট্রফি জয়ের সামনে। উৎপল চট্টোপাধ্যায় অবশ্য যথারীতি আবেগহীন। সৌরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রঞ্জি ফাইনাল নিয়ে অবধারিত ভাবেই নিরুত্তাপ। তবে আনন্দবাজার ডিজিটালকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তাঁর মধ্যে থেকেও বেরিয়ে এল আবেগের বিস্ফোরণ। যখন মুখ খুললেন অভিমন্যু ঈশ্বরনের দলের মানসিক কাঠিন্য নিয়ে।
সে বার ছিলেন ক্রিকেটার। এখন স্পিন কোচ। দুটো সময়কে কী ভাবে দেখছেন?
উৎপল: একটা ১৯৮৯ সাল। একটা ২০২০ সাল। এর মধ্যে তিরিশ বছরের একটা বার্ধক্য এসে গিয়েছে রঞ্জি ট্রফিতে। বার্ধক্যের পাশাপাশি পরিণত হয়েছে সবকিছু। ফিটনেস লেভেল যেমন। আগে পাঁচ দিনের ক্রিকেট খেলতে গেলে আমাদের ক্রিকেটারদের ক্লান্ত হয়ে পড়ত। অধিকাংশেরই সমস্যা হত ফিটনেসে। এখন ছেলেরা মারাত্মক ফিট। চতুর্থ দিনেও পেসাররা উজাড় করে দিচ্ছে। জোরে বোলাররা চতুর্থ ইনিংসে বিপক্ষের দশটা উইকেটই নিচ্ছে। এ রকম আগে ভাবা যেত না। গ্রিন টপই হোক আর যাই হোক, ফাস্ট বোলাররা শেষ ইনিংসে সবগুলো উইকেট নিচ্ছে, এমন আগে দেখিনি। ফিটনেস লেভেল অনেক বেশি। আবার কিছু ব্যতিক্রমী দিকও রয়েছে। আগেকার দিনে ব্যাটসম্যানদের ধৈর্য অনেক বেশি ছিল। শট বাছাইয়ে অনেক সচেতন থাকত। এখন ব্যাটসম্যানরা অনেক শট খেলছে। ঝুঁকি নেয়। লিফট করা, রিভার্স সুইপ মারা, আরও কত কী! এই মারা, ওই মারা— দ্বিধা করে না। টি-টোয়েন্টি বা একদিনের ক্রিকেটে আমরা যে সব শট দেখি, সেগুলো এখন চার দিনের ক্রিকেটও দেখা যাচ্ছে। যা আগে ছিল না। এগুলো এসেছে। বেড়েও গিয়েছে অনেক।
তার জন্যই কি তিন-সাড়ে তিন দিনেও ম্যাচ শেষ হচ্ছে? ইডেনে কর্নাটকের বিরুদ্ধে বাংলা যেমন চতুর্থ দিন লাঞ্চের আগেই জিতে গেল!
উৎপল: আগে পাটা উইকেটে খেলা হত। তখন চারশো, সাড়ে চারশো-পাঁচশো রান হত। আবার সেই রান তাড়াও করত দলগুলো। কাছাকাছি পৌঁছেও যেত। তেমন হয় না এখন।
তার মানে প্রথম ইনিংসের লিডের চিত্রনাট্য এখন কমছে।
উৎপল: হ্যাঁ। এখন আড়াইশো-তিনশো রানের বেশি উঠছে না। সেটা তুলতেই কালঘাম ছুটে যাচ্ছে ব্যাটসম্যানদের। এখন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ধৈর্যের অভাব অনেক বেশি।
এখন তো উইকেটের চরিত্রও বদলেছে।
উৎপল: হ্যাঁ, এখন তো বোলারদের কথা ভেবেই উইকেট তৈরি হচ্ছে। ব্যাটসম্যানদের কথা ভাবা হয় না। এটা ব্যাটসম্যানদের মাইনাস পয়েন্ট। তবে যতই গ্রিন টপ হোক, চার দিন ধরে তো আর একই রকম থাকবে না। পরের দিকে ব্যাটিং সহায়ক হয়ে পড়ে। কিন্তু, তাতে ব্যাটসম্যানদের চরিত্র বদলায় না। ওরা প্রথম দিনে যেমন খেলছে, চতুর্থ দিনেও একই ভাবে খেলছে। পরে যখন মনে হচ্ছে যে আমি ধরে খেলব, সেই ধৈর্যটা আর থাকছে না। আধ ঘণ্টা-চল্লিশ মিনিট থাকার পরই ধৈর্য হারিয়ে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন: এ বছরই আইপিএলে শেষ বার দেখা যেতে পারে এই মহাতারকাদের
আরও পড়ুন: বৃষ্টিতে পণ্ড সেমিফাইনাল, প্রথম বার টি২০ বিশ্বকাপ ফাইনালে হরমনপ্রীতের ভারত
এ বারের বাংলা উল্টো মেরুর দুই কন্ডিশনেই সফল। জয়পুরে গ্রিন টপে এসেছে জয়। পাটিয়ালার টার্নিং পিচেও জয় ছিনিয়ে নিয়েছে বাংলা। দুই রকমের কন্ডিশনেই বোলারদের সফল হওয়ার রহস্য কী?
উৎপল: বোলাররা ভাল বল করছে। সেটাই কারণ। রহস্য কোথায়?
এটা তো খুব সরলীকরণ হয়ে গেল।
উৎপল: দেখুন, বোলারদের সফল হওয়ার একটাই শর্ত। ভাল বল করতে হবে। জায়গায় বল রাখতে হবে। না হলে কিছুই হবে না। এতে কোনও রহস্য নেই (হাসি)। যে দলের বোলাররা তুলনামূলক ভাবে বেশি শৃঙ্খলা দেখিয়েছে, লাইন-লেংথে অবিচল থেকেছে, তারাই সাফল্য পেয়েছে। এটাই বেসিক। আমাদের বোলাররা অনেক বেশি সফল এই মরসুমে। কারণ হল শৃঙ্খলাবদ্ধ থাকা। সেমিফাইনালে কর্নাটকের বিরুদ্ধে আমাদের বোলাররা তাতেই টেক্কা দিয়েছে। আমাদের বোলিংটা পরিকল্পনা অনুসারে হয়েছে। কোন ব্যাটসম্যানকে কোন লাইনে বল করতে হবে, কী ভাবে আক্রমণ করতে হবে, সেটা মেনে চলেছে ওরা। বলের মুভমেন্টও অনেক বেশি করিয়েছে আমাদের পেসাররা।
মুকেশ কুমাররা শৃঙ্খলা দেখিয়েই টেক্কা দিয়েছেন কর্নাটকের মিঠুনদের, বললেন উৎপল।
ঈশান, মুকেশদের কিছু কিছু বল তো অস্বাভাবিক মুভ করেছে ইডেনে।
উৎপল: হ্যাঁ। আসলে, ইডেনে কর্নাটক প্রথম ইনিংসে শর্ট অফ লেংথ বোলিং করে ফেলেছিল। উইকেট বুঝে বল করতে পারেনি। তাই তেমন মুভমেন্ট পায়নি। ফলে, আমাদের ব্যাটসম্যানদের পক্ষে খেলাটা একটু সহজ হয়ে উঠেছিল। দ্বিতীয় ইনিংসে মিঠুনরা বেটার বল করেছে।
স্পিন বিভাগের কথায় আসি। শাহবাজ আহমেদকে কেমন দেখছেন?
উৎপল: ও এখনও চার দিনের ফরম্যাটের জন্য পুরোপুরি তৈরি হয়নি। ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টিতে ও খুব ভাল। কিন্তু, চারদিনের ক্রিকেটে বোলিং যে একটু আলাদা, সেটা ওকে বুঝতে হবে। তবে ওর মধ্যে লড়াকু ব্যাপারটা আছে। অনেকে একটু নরম-সরম হয়। শাহবাজ একেবারেই তা নয়। নার্ভাসনেস ব্যাপারটা নেই। যে কোনও পরিস্থিতিতে নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার ইচ্ছে রয়েছে। সে জন্য ও সফল পায় বেশি।
ফ্লাইট বা বৈচিত্রে একটু কমতি রয়েছে বলছেন।
উৎপল: ও তো খুব বেশি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেনি। রঞ্জিও বেশি দিন খেলছে না। আস্তে আস্তে তৈরি হবে। স্পিন বোলিং অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে। যার যত অভিজ্ঞতা সে তত মেলে ধরতে পারবে। এটা হতে একটু সময় লাগবে।
পেসারদের দাপটে অর্ণব নন্দী তো খুব বেশি সুযোগ পাচ্ছে না বল করার।
উৎপল: অর্ণব যথেষ্ট ভাল বোলার। ও বুদ্ধিমান বোলার। ওর মাথা রয়েছে। যথেষ্ট জ্ঞান রয়েছে বোলিং নিয়ে। ও মাথা খাটিয়ে বল করে। এখনকার দিনে অফস্পিনারদের সাফল্যের হার যদিও কম। উইকেট পেতে গেলে অর্ণবকে তাই আরও বেশি বল করতে হবে। সুযোগ পেলে ও নিজের বোলিং নিশ্চয়ই মেলে ধরতে পারবে।
আরও পড়ুন: ফাইনালে বাংলার দুই ওপেনারকে কী করতে হবে? টিপস দিলেন দুই রঞ্জিজয়ী বঙ্গসন্তান
আরও পড়ুন: এই দলের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মশলা রয়েছে, বলছেন সম্বরণ
বাংলার পেসারদের দেশের সেরা অ্যাটাক বলছেন কোচ-ক্যাপ্টেন। বোলার স্পিন শক্তি নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
উৎপল: কে বলল যে বাংলার স্পিন অ্যাটাক সেরা নয়? সারা ইনিংসে চার ওভার বল করেছে স্পিনার, সত্তর ওভার বল করছে পেসার, আর তার পর বলে দেওয়া যায় যে স্পিন আক্রমণ ভাল নয়? এ ভাবে তুলনা করা যায় নাকি?
অন্য প্রসঙ্গে আসি। এই যে অভিমন্যু ঈশ্বরনরা বার বার প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে ফিরে আসছে, সেটা এর আগে অন্য কোনও বাংলা দলে দেখেছেন? এটাই কি চ্যাম্পিয়ন দলের লক্ষণ?
উৎপল: অবশ্যই। আমি তো এমন ভাবে প্রতিটা ম্যাচেই কঠিন পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়াতে আগে কোনও বাংলা দলকে দেখিনি। একটা-দুটো ম্যাচে এমন ঘটছে, তা নয়। পর পর ম্যাচে এটা ঘটেছে। এমন মানসিকতা বাংলা দলে কখনও ছিল বলে আমার মনে হয় না। বিভিন্ন আবহাওয়ায়, বিভিন্ন কন্ডিশনে এরা জ্বলে উঠেছে। ফিরে এসেছে ম্যাচে। এটা থেকে একটা দলের মানসিকতা বোঝা যায়।
এটা দলের মধ্যে এল কী করে?
উৎপল: সত্যি বলতে এর পুরো কৃতিত্বই অরুণের। অরুণ লাল এটা নিয়ে খেটেছে। আমি তো শুরুতে দলের সঙ্গে ছিলাম না।
আপনি বলছেন যে বার বার ফিরে আসার এই ক্ষমতা এর আগে বাংলা দলে কখনও দেখেননি?
উৎপল: না, এ রকম কখনও দেখিনি। বার বার কঠিন পরিস্থিতিতে কামব্যাক করা, প্রথম দিন থেকে চতুর্থ দিন পর্যন্ত একই রকম তাগিদ নিয়ে খেলে যাওয়া, সেই আগ্রাসন বজায় রাখা— এগুলোর জন্য অনেক স্ট্রেন্থ-স্ট্যামিনা প্রয়োজন। সেটা এই দলটার মধ্যে রয়েছে।
তিন দশকের খরা এ বার কাটবে বলে মনে হচ্ছে?
উৎপল: (হাসি) সেটাও যদি বলে দিলাম, তা হলে তো টিম যাবেই না খেলতে! খরা কাটবে কি না জানি না। তবে বিপক্ষও তো খেলেই উঠেছে ফাইনালে। ফাইনালে যে দল আক্রমণাত্মক মানসিকতা ধরে রাখতে পারবে সে ই জিতবে।
রাজকোটে সৌরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ফাইনালে প্রত্যাশার চাপ সমস্যা হবে না তো?
উৎপল: প্রত্যেক দলের কাছেই প্রত্যাশা থাকে। আমাদের উপর যেমন রয়েছে, সৌরাষ্ট্রের উপরও তেমনই রয়েছে। এই চাপ সবার উপরই রয়েছে। সেটা নিতে হবে। সবটাই কি আর পাড়ার খেলা হবে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy