ফিফা মহানাটকে আর কত মশলা, কত ঝাঁঝ বাকি আছে, ঈশ্বর জানে!
চব্বিশ ঘণ্টা আগে ফিফার ঘোষিত ‘মহাশত্রু’ হিসেবে আবির্ভাব হয়েছিল এফবিআই এবং সুইৎজারল্যান্ড পুলিশের। এ বার ফিফার শত্রু তালিকায় ঢুকে পড়লেন মিশেল প্লাতিনিও।
বুধবারের ‘কলঙ্কিত’ দিনের পরে ফিফা প্রেসিডেন্ট সেপ ব্লাটারের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন প্লাতিনি। বন্ধুত্বের কারণে ফিফা প্রেসিডেন্টকে বুঝিয়েছিলেন যে, এখন পরিস্থিতি যা তাতে প্রেসিডেন্টের চেয়ার খালি করে দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। ব্লাটার নাকি যে প্রস্তাবে রাজি হননি। বলেও দেন, নির্বাচনে না লড়ার কোনও প্রশ্নই নেই। যা শুনে এত চটেছেন প্লাতিনি যে, পরিষ্কার বলে দিয়েছেন ফিফা নির্বাচনে কী হয় দেখবেন। যদি দেখা যায় ব্লাটারই প্রেসিডেন্ট পদে থেকে যাচ্ছেন, রাশিয়া বিশ্বকাপে ইউরোপ অংশগ্রহণ করবে না!
যার অর্থ মারাত্মক। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন জার্মানি বিশ্বকাপে খেলবে না! রোনাল্ডোর পতুর্গাল, দাভিদ সিলভার স্পেন, রবেনের নেদারল্যান্ডস, রুনির ইংল্যান্ড, বেঞ্জিমার ফ্রান্স—কেউ বিশ্বকাপ খেলবে না! এমনকী রাশিয়া পর্যন্ত পারবে না যেহেতু তারাও ইউরোপের অংশ।
ফরাসি কিংবদন্তি ফুটবলার যে কতটা ক্ষেপেছেন, তা তাঁর সাংবাদিক সম্মেলন থেকেই পরিষ্কার। সোজা বলে দিয়েছেন, ‘‘ফিফা নির্বাচনের পরে বার্লিনে একটা বৈঠক ডাকছি। অনেক সহ্য করেছি। আর না। যদি দেখি ব্লাটারই থাকছে, আমি দেখব যাতে রাশিয়া বিশ্বকাপে ইউরোপ না খেলে!’’
যা শেষ পর্যন্ত ঘটলে মারাত্মক ব্যাপার হবে। আজ পর্যন্ত একুশ বিশ্বকাপের একটাতেও ইউরোপ অংশগ্রহণ করেনি, এমন হয়নি। ব্লাটারকে যদিও সে সব নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখায়নি। বৃহস্পতিবার রাতের ফিফা কংগ্রেসে নিশ্চিন্তে বক্তৃতা দিয়েছেন। নাচ-গান হয়েছে। বিশেষ কোনও হেলদোল দেখা যানি। শুধু বলেছেন, ‘‘দু’এক জন খারাপ লোকের জন্য পুরো ফিফাই দুর্নীতিগ্রস্ত, এটা ভাবাটা ঠিক নয়। আমার উপর ভরসা রাখুন।’’
ব্লাটার বলতে পারেন। কিন্তু প্লাতিনি শুনছেন না। সোজা বলে দিচ্ছেন, ‘‘ও কী বলল না বলল, তাতে কিছু যায় আসে না। এটুকু বলতে চাই যে, শুক্রবার ভোট পড়ুক প্রিন্স আলি বিন আল হুসেনের জন্য। ইউরোপের প্রতিটা দেশকে বলব, প্রিন্স আলির পাশে দাঁড়াতে। তিপান্ন উয়েফা সদস্যের মধ্যে পঁয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশ জনের ভোট পেলেই চলবে। ব্লাটার তা হলে আর থাকবে না।’’
যে ক্ষোভের কারণে আগামী শনিবার বার্সেলোনা বনাম জুভেন্তাস চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালের একটা টিকিটও জুটবে না ফিফার কপালে। প্রত্যেক বছর চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে ফিফা কর্তাদের জন্য বরাদ্দ থাকে পঞ্চাশটা টিকিট। কিন্তু এ বার প্লাতিনি কড়া নির্দেশ দিয়েছেন যে, একটা টিকিটও দেওয়া হবে না। টিকিট কেটে খেলা দেখলে দেখবেন ফিফা কর্তারা!
ফিফার কলঙ্কিত প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে শুধু প্লাতিনি নন। দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনাও নেমে পড়েছেন। ফিফার সঙ্গে তাঁর গভীর ‘সুসম্পর্ক’ বহু দিনের। এত দিন বারবার ফিফার বিরুদ্ধে গর্জন তুললেও কেউ শোনেনি। ‘‘আমাকে তো লোকে ভাবছিল, পাগল। এখন তো এফবিআই দেখিয়ে দিল সত্যিটা কী? দারুণ হয়েছে এই কুকীর্তি ফাঁস হয়ে যাওয়ায়। এ বার ক্ষমতা থাকলে ফিফা দিক উত্তর। বলুক কী হয়েছে,’’ হুঙ্কার দিয়েছেন মারাদোনা। এখানেই থেমে যাননি ’৮৬ বিশ্বকাপের নায়ক। ব্লাটারকে তীব্র আক্রমণ করে মারাদোনা যোগ করেছেন, ‘‘এ বার দেখতে চাই ব্লাটার ফিফার প্রেসিডেন্ট থাকে কিনা। কোনও ফুটবলের সঙ্গে যুক্ত থাকা লোককে প্রেসিডেন্ট হতে দেখতে চাই। ফিফা যে টাকা কুকীর্তি করে রোজগার করেছে, সেটা দিয়ে অনায়াসে আফ্রিকায় ফুটবলের উন্নতি করা যেত।’’
ফুটবল পৃথিবীর বেশ কয়েকটা দেশও ব্লাটারের বিরুদ্ধে সরব আওয়াজ তুলেছে। অস্ট্রেলীয় ফুটবল সংস্থা এত দিন ব্লাটারকে চোখ বন্ধ করে সমর্থন করত, এখন ঘুরে গেল। তারা বলে দিল, ব্লাটারের এ বার যাওয়া উচিত। ইংল্যান্ড ভাবছে, ফিফা থেকে সরে যাবে। এফএ ভাইস চেয়ারম্যান ডেভিড গিল বলেছেন, ‘‘ব্লাটার প্রেসিডেন্ট থাকলে আমি ফিফায় থাকব না।’’ যার মানে এক ঝাঁক বিরোধী। প্লাতিনি। মারাদোনা। কয়েকটা ফুটবল সংস্থা। দু’টো গুরুত্বপূর্ণ স্পনসরও এখন সরে যেতে চাইছে।
ফিফা প্রেসিডেন্ট যখন পরের পর আক্রমণে প্রবল বিপর্যস্ত, পাশে পেয়ে গেলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে। পুরো ঘটনাতেই অন্য আঙ্গিক দিয়ে দিয়েছেন তিনি। যা রাজনৈতিক। পুরোটাই রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন তিনি। পুতিন বুঝে পাচ্ছেন না, এফবিআই কেন এটার মধ্যে ঢুকে পড়ল। যেখানে গোটা ঘটনার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কোনও সম্পর্ক নেই। শুধু তাই নয়, পুতিন ইঙ্গিত ছেড়ে রেখেছেন যে এটা রাশিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিনদের পুরনো ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’-কে টেনে নিয়ে যাওয়া।
‘‘রাশিয়ার কোনও হাত নেই এর মধ্যে। যুক্তরাষ্ট্রর সব সময় একটা স্বভাব আছে অন্য দেশের লোকেদের অবৈধ ভাবে নির্যাতন করা। ফিফার ক্ষেত্রেও এই জিনিসটাই হয়েছে,’’ বলে দিয়েছেন পুতিন। সঙ্গে তিনি যোগ করেন, ‘‘ব্লাটারকে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরানোর জন্য এটা করা হচ্ছে।’’
রুশ প্রেসিডেন্ট বলছেন ঠিকই। কিন্তু লোকে তাতে পাত্তা আর দিচ্ছে কোথায়? বরং বলছে, পুতিন কেন এগুলো বলছেন, সেটা তো সবাই জানে!
এরই মাঝে রাষ্ট্রসঙ্ঘ জানিয়ে দিয়েছে, ফিফার দুর্নীতি নিয়ে সাম্প্রতিক ঘটনার উপর তারা সতর্ক নজর রাখছেন। একই সঙ্গে গোটা দুনিয়ার উৎকণ্ঠা বাড়িয়ে ব্লাটারও এ দিন জানিয়েছেন, আগামী কয়েক মাসে আরও কিছু ‘খারাপ খবর’ অপেক্ষা করছে ফিফার সামনে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy