ক্যারোলিনা মুকোভা। ছবি: রয়টার্স।
টেনিস দুনিয়া অপেক্ষা করেছিল ক্যারোলিনা মুকোভার সুস্থ হয়ে ওঠার। এ বার সামনে ইগা শিয়নটেক। সেই বাধা টপকালেই গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়ের হাতছানি।
মেয়েদের টেনিসে সমসাময়িক এবং প্রাক্তন খেলোয়াড়েরা মুগ্ধ মুকোভায়। তাঁর সাবলীল স্ট্রোক, হঠাৎ করে মারা জোরালো শট, শরীরের ভারসাম্য রাখার ক্ষমতা, পাথরের মতো শক্তিশালী চেহারা এবং অক্লেশে দৌড়নোর ক্ষমতা দেখলে মনে হবে, তিনি হয়তো দেশের হয়ে বাস্কেটবল বা ফুটবল খেলেন।
ওঁরা বলেন মুকোভা যদি কোনও দিন সুস্থ থাকেন, তা হলে খেলা দেখো তাঁর। তিনি খেলা দেখালেন। চেক প্রজাতন্ত্রের ২৬ বছরের টেনিস খেলোয়াড় বিশ্বের এক নম্বর ইগা শিয়নটেকের বিরুদ্ধে খেলবেন ফরাসি ওপেনের ফাইনালে। সেমিফাইনালে বেলারুশের এরিনা সাবালেঙ্কার বিরুদ্ধে বৃহস্পতিবার মুকোভা জেতেন ৭-৬, ৬-৭, ৭-৫ সেটে।
বৃহস্পতিবারের দুপুরে গরমের মধ্যে প্রতি মুহূর্তে লড়াই করেছেন মুকোভা। বেসলাইন থেকে ভেসে আসা রিটার্ন, ফোরহ্যান্ডে ড্রপ শট অবাক করেছেন সকলকে। সাবালেঙ্কার ফোরহ্যান্ড শটের জবাব দেওয়া কখনই সহজ নয়। মুকোভা সেই সবই করেছেন। ভলি মেরেছেন। সাবালেঙ্কাকে হারাতে এগুলো দরকার ছিল। সেই সঙ্গে প্রয়োজন ছিল একটু সাহস।
তৃতীয় সেটে এক সময় মুকোভা ২-৫ ব্যবধানে পিছিয়ে ছিলেন। একটি ম্যাচ পয়েন্ট হারালেই ফাইনালে ওঠা হত না তাঁর। সেখান থেকে মুকোভা প্রতিযোগিতায় টিকে রইলেন। শেষ ২৪ পয়েন্টের মধ্যে ২০টি পয়েন্ট জিতে নেন তিনি। সাবালেঙ্কা একের পর এক ভুল করতে থাকেন। ম্যাচের পর সাবালেঙ্কা বলেন, “মুকোভা সব সময়ই ভাল খেলে। কিন্তু ও কিছু দিন লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গিয়েছিল। ওর বিরুদ্ধে পয়েন্ট কেড়ে নেওয়া বেশ কঠিন। ম্যাচ পয়েন্ট হারানোর পর আমার ছন্দ নষ্ট হয়ে যায়।”
অনেকেই মনে করেন মুকোভার অনেক আগেই গ্র্যান্ড স্ল্যামের ফাইনাল খেলার ক্ষমতা ছিল। যে সুযোগ অনেক দেরি করে পেলেন তিনি। চেক প্রজাতন্ত্রের ১০৫ লক্ষ মানুষের মধ্যে অনেকেই টেনিস উৎসাহী। বেশ কিছু ভাল প্রতিভাও রয়েছে সে দেশে। তাঁদের সঙ্গে লড়াইয়ে মুকোভা পিছিয়ে পড়ছিলেন শুধু মাত্র চোটের কারণে। পাঁচ ফুট ১১ ইঞ্চির এই মহিলা খেলোয়াড়ের যে সময় নিজের প্রতিভা মেলে ধরার কথা ছিল, সেই সময়ই বার বার চোট পেতে থাকেন তিনি। কোমর এবং হাঁটুতে সমস্যা হয় বার বার।
সেই সব পার করে ২০১৯ সালে উইম্বলডনের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছিলেন মুকোভা। ২০২১ সালে অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের সেমিফাইনালে ওঠেন। কোয়ার্টার ফাইনালে তিনি হারিয়ে দেন শীর্ষ বাছাই অ্যাশলে বার্টিকে। যিনি নিজেই জানিয়েছিলেন যে, তিনি মুকোভার ভক্ত। কিন্তু একের পর এক চোট মুকোভাকে সফল হতে দেয়নি। ২০২১ সালে ১৯ নম্বরে থাকা মুকোভা এক সময় ক্রমতালিকায় ২৩৫ নম্বরে নেমে গিয়েছিলেন।
মুকোভা নিজেও চোট নিয়ে চিন্তিত। তিনি বলেন, “বার বার পিছিয়ে পড়তে হয়েছে চোটের কারণে। কিছু চিকিৎসক তো আমাকে বলেছিলেন যে, আমি কখনও খেলতেই পারব না।” একের পর এক রিহ্যাব কাটিয়ে নিজেকে ইতিবাচক রাখার চেষ্টা করেন মুকোভা। ছোট ছোট প্রতিযোগিতায় খেলেন। এ বারের ফরাসি ওপেনে মুকোভা ৪৩ নম্বর হিসাবে খেলছেন। তিনি এমন এক জন অবাছাই খেলোয়াড় যাঁর সামনে কেউই পড়তে চায় না। প্রথম রাউন্ডেই অষ্টম বাছাই মারিয়া সাকারিকে হারিয়ে দেন মুকোভা। স্ট্রেট সেটে ম্যাচ জিতে নেন তিনি। প্রথম পাঁচটি ম্যাচের মধ্যে মাত্র একটি সেট হারেন মুকোভা। গ্র্যান্ড স্ল্যামের সেমিফাইনালে ১৫ হাজার দর্শকের সামনে খেলছিলেন তিনি। কঠিনতম তৃতীয় সেট খেলার সময় শুনতে পাচ্ছিলেন তাঁর নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছে দর্শক। মুকোভা শান্ত ভাবে ২-৫ থেকে ৭-৫ ব্যবধানে সেট জিতে নেন। সঙ্গে ম্যাচও। মুকোভা বলেন, “অস্বাভাবিক একটা পরিবেশ ছিল। আমি নিজে চিৎকার করছিলাম। নিজেকে শান্ত রাখার জন্যই এমন করছিলাম।”
শনিবার পরিবেশ আরও অস্বাভাবিক হতে পারে। শিয়নটেকের বিরুদ্ধে ফাইনাল খেলতে নামবেন মুকোভা। ২০২০ এবং ২০২২ সালে ফরাসি ওপেন জেতেন শিয়নটেক। লাল সুরকির কোর্টে টানা ১৩টি ম্যাচে অপরাজিত তিনি। গত সপ্তাহে ২২ বছরে পা রাখেন শিয়নটেক। মুকোভার সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে বয়েছে তাঁর টেনিস জীবন। মাত্র ১৯ বছর বয়সে প্রথম গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতেছিলেন শিয়নটেক। ২০২২ সালে বার্টি মাত্র ২৫ বছর বয়সে অবসর নেওয়ার পর এক নম্বর টেনিস খেলোয়াড়ের শিরোপা এখন তাঁর মাথায়।
Coming from 2-5 down in the deciding set
— wta (@WTA) June 8, 2023
Saving match point
Reaching her first Slam final after 3h13m
Becoming the first player to defeat Sabalenka at a major this year
Muchova's Slav EPIC @karomuchova7 | #RolandGarrospic.twitter.com/sVBDxw3ZpU
শিয়নটেক এবং মুকোভার খেলার ধরনও অনেকটাই আলাদা। মুকোভা বিভিন্ন ধরনের শট খেলেন। শিয়নটেক অনেকটাই শক্তিনির্ভর টেনিস খেলেন। বিপক্ষকে শক্তিশালী ফোরহ্যান্ড দিয়ে ধরাশায়ী করতে চান তিনি। সেটা কাজেও লাগে। শিয়নটেক একাধিক সেটে গেম হারাননি। কোনওটি জিতেছেন ৬-১ ফলে। টুইটারে তা নিয়ে অনেক সময় কথাও হয়। কিন্তু শিয়নটেক সেটা পছন্দ করেন না। তিনি মনে করেন এটা বিপক্ষকে ছোট করা।
সেমিফাইনালে বৃহস্পতিবার ব্রাজিলের বিয়াত্রিস হাদাদ মায়ার বিরুদ্ধে যদিও কিছুটা সমস্যায় পড়েছিলেন শিয়নটেক। বাঁহাতি মায়া দ্বিতীয় সেটে শিয়নটেককে বেসলাইনে দৌড় করান। ছন্দ হারিয়ে ফেলেছিলেন বিশ্বের এক নম্বর টেনিস তারকা। প্রচুর আনফোর্সড এরর করেন তিনি। তবে স্ট্রেট সেটেই ম্যাচ জেতেন শিয়নটেক। মায়া দ্বিতীয় সেট টাইব্রেকারে নিয়ে গেলেও একটুর জন্য জিততে পারেননি। তাই খেলা আর তৃতীয় সেটে গড়ায়নি। ম্যাচ জিতে শিয়নটেক বলেন, “শনিবারের জন্য আমি উত্তেজিত।”
মুকোভা এবং শিয়নটেকের মধ্যে ফাইনালটি বিশেষ হতে চলেছে। বৈপরীত্য রয়েছে তাঁদের খেলায়। শিয়নটেক শক্তিনির্ভর খেলা খেলবেন। মুকোভা তাঁর সব রকমের অস্ত্র নিয়ে নামবেন। শিয়নটেককে প্রশ্নের মুখে ফেলবেন স্লাইস, টপস্পিন, বেস লাইন থেকে মারা ড্রপ শটের মাধ্যমে। গত বছর পর্যন্ত একটি কথা প্রায়ই শোনা যেত। শিয়নটেককে হারাতে পারেন শিয়নটেকই। তিনি নিজেই জানিয়েছিলেন যে, নিজের উপর জেতার চাপ তৈরি করে ফেলেন তিনি। হারতে পছন্দ করেন না শিয়নটেক। কোকো গফকে কোয়ার্টার ফাইনালে হারিয়ে শিয়নটেক বলেন, “প্রতিযোগিতা যত এগোয়, আমি তত শান্ত হই। শুরুর দিকে যে পরিমাণ চাপ থাকে, সেগুলো আস্তে আস্তে কমে যায়। আমি খেলাটা উপভোগ করতে শুরু করি।”
শিয়নটেকের সামনে এখন শুধু একটা গ্র্যান্ড স্ল্যাম ফাইনাল এবং মুকোভা। দু’জনে একে অপরের বিরুদ্ধে শেষ বার খেলেছিলেন চার বছর আগে। এখনকার থেকে সেই সময় তাঁরা অনেকটাই আলাদা ছিলেন। মুকোভা সেই সময় তিন সেটে ম্যাচ জিতেছিলেন নিজের ঘরের কোর্টে। শিয়নটেক তখন ক্রমতালিকায় বিশ্বের ৯৫তম। একে অপরের সঙ্গে অনেক সময় অনুশীলন করেছেন তাঁরা। বার্টির মতো শিয়নটেকও মুকোভার অনুরাগী। সময় পেলে তিনিও মুকোভার খেলা দেখতে বসে যান। শিয়নটেক বলেন, “মুকোভা যা খুশি করতে পারে।”
চার বছর আগে হওয়া ওই একটি ম্যাচেই এখনও পর্যন্ত মুখোমুখি হয়েছেন তাঁরা। একে অপরের বিরুদ্ধে তাঁরা কেমন খেলেন, সেটা ওই ম্যাচ দিয়ে বিচার করা কঠিন। তবে একটা পরিসংখ্যান মুকোভার পক্ষে যাবে। তিনি এখনও পর্যন্ত পাঁচটি ম্যাচ খেলেছেন এমন খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধে যাঁরা বিশ্বের ক্রমতালিকায় প্রথম তিনে রয়েছেন। প্রতি বারই মুকোভা জিতেছেন। তিনি বলেন, “এটা প্রমাণিত যে আমি, এই ধরনের খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধে খেলতে পারি। আমি লড়তে পারি।”
মুকোভা সত্যিই পারেন। তাঁর প্রতিপক্ষরা এত দিনে সেটা জেনেও গিয়েছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy