Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Tokyo Olympics

Pakistan hockey: এগোচ্ছে ভারত, পিছোচ্ছে পাকিস্তান, কবরে চলে যাওয়া পাক হকি সাফল্য থেকে বহু দূরে

ভারতের দুই হকি দল যখন টোকিয়ো অলিম্পিক্সের সেমিফাইনালে খেলতে নামবে, তিন বারের অলিম্পিক্স সোনাজয়ী পাকিস্তান তখন সেই বিশ্ব থেকে অনেক দূরে।

টানা দু’বার অলিম্পিক্সে যোগ্যতাই অর্জন করতে পারেনি পাকিস্তান হকি দল।

টানা দু’বার অলিম্পিক্সে যোগ্যতাই অর্জন করতে পারেনি পাকিস্তান হকি দল। —ফাইল চিত্র

নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০২১ ১৪:৫২
Share: Save:

টানা দু’বার অলিম্পিক্সে যোগ্যতাই অর্জন করতে পারেনি পাকিস্তান হকি দল। ভারতের মেয়ে এবং ছেলেদের দল যখন টোকিয়ো অলিম্পিক্সের সেমিফাইনালে খেলতে নামবে, তিন বারের অলিম্পিক্স সোনাজয়ী পাকিস্তান হকি দল তখন সেই বিশ্ব থেকে অনেক দূরে।

শাকিল আব্বাসি, পাকিস্তান দলের প্রাক্তন অধিনায়ক এক সময় বিশ্বের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার ছিলেন। ২০০৩ থেকে ২০১৪ অবধি আন্তর্জাতিক দলে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ৩০৭টি ম্যাচে ১০১টি গোল করেছেন। তবে এখন নিজের জার্সিটাও দান করে দিয়েছেন। তিন বার অলিম্পিক্সে দেশের প্রতিনিধিত্ব করা শাকিল বলেন, “ভুল করে ফেলেছি হকিকে নিজের কেরিয়ার হিসেবে বেছে নিয়ে। ক্রিকেটটাও ভাল খেলতাম। কিন্তু দেশের জাতীয় খেলাকেই বেছে নিয়েছিলাম। ভুল করে ফেলেছি।”

শাকিলের জন্ম হয় ১৯৮৪ সালে। সেই বছরই শেষ বার পাকিস্তান অলিম্পিক্সে (লস অ্যাঞ্জেলস) সোনা জিতেছিল। ৩৭ বছরের এই স্ট্রাইকার এখন ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, মালেশিয়ায় বিভিন্ন হকি লিগে খেলেন। তবে করোনার জন্য সেটাও আপাতত বন্ধ। শাকিল বলেন, “বাঁচার জন্য তো টাকার প্রয়োজন। বিদেশের লিগগুলো বন্ধ। কী করব জানি না। খুব কঠিন সময়। এত দিন দেশের হয়ে খেলার পর আমার এই অবস্থা। তিনটি অলিম্পিক্স, দুটো বিশ্বকাপ, আটটা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলেছি আমি। আজ পাকিস্তানে ছোটদের হকি খেলতে দেখলে কষ্ট হয়। ভয় করে ওদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে।”

তিন বারের অলিম্পিক্স সোনাজয়ী পাকিস্তান দল তখন সেই বিশ্ব থেকে অনেক দূরে।

তিন বারের অলিম্পিক্স সোনাজয়ী পাকিস্তান দল তখন সেই বিশ্ব থেকে অনেক দূরে। —ফাইল চিত্র

শাকিল একা নন, পাকিস্তানে হকির ছবিটা এমনই। এই মুহূর্তে বিশ্ব ক্রমতালিকায় ১৮ নম্বরে তারা। প্রথম চারের মধ্যে থাকা দলটা এখন আর দশের মধ্যেও নেই। ২০১৩ সালে শেষ বার ক্রমতালিকায় চার নম্বরে ছিল তারা। পরের বছরেই নেমে যায় নয় নম্বরে। সেই পতন আর আটকানো যায়নি।

২০১৪ সালে প্রথম বারের জন্য বিশ্বকাপে যোগ্যতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয় পাকিস্তান। ২০১৮ সালে যোগ্যতা অর্জন করলেও ১২ নম্বরে শেষ করে তারা। ২০১৬ সালের রিয়ো অলিম্পিক্সেও ছিল না পাকিস্তান হকি দল, নেই এ বারেও। বিশ্ব মঞ্চ থেকে যেন ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছে পাকিস্তানের হকি।

অলিম্পিক্সে তিন বার সোনা জয়, চার বার বিশ্বকাপ জয়, সেই গৌরবের দিনগুলি আজ শুধুই স্মৃতি। সমর্থকদের জন্যেও পর পর দু’বার অলিম্পিক্সে দেশকে দেখতে না পাওয়া কষ্টের। মইজুদ্দিন কুরেশি, পাকিস্তানের এক হকি সমর্থক বলেন, “পাকিস্তানের অবস্থা দেখলে কষ্ট হয়। অলিম্পিক্সে পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত বেজে ওঠার মুহূর্ত আমার কাছে সব চেয়ে আনন্দের। খুব গর্ব হয়েছিল নিজের দেশকে দেখে। ছোটবেলায় রাস্তায় রাস্তায় হকি খেলেই বড় হয়েছি আমরা। এখনকার ছেলেরা যেন জানেই না খেলাটা। নিজের দেশকে তো বিশ্ব মঞ্চে কোথাও দেখতেই পায় না।”

কিছু সমর্থকের মতে পাকিস্তানে হকি মৃত। কেউ আবার বলছেন ভেন্টিলেশনে রয়েছে। ১৯৫৬ সালে মেলবোর্ন অলিম্পিক্সে রুপো জয় দিয়ে শুরু। পরের অলিম্পিক্সে ভারতকে হারিয়ে সোনা জয়। টানা ছয় বার সোনাজয়ী ভারতকে থামিয়ে দিয়েছিল তারা। পরের তিনটি অলিম্পিক্সে দু’বার রুপো এবং এক বার সোনা। ১৯৭৬ সালে ব্রোঞ্জ।

১৯৮০ সালে কোনও পদক না পেলেও ১৯৮৪ সালে ফের সোনা জয়। হকিতে পাকিস্তান যে সেই সময় কতটা শক্তিশালী, তা প্রমাণ করার জন্য এই পদকগুলি যথেষ্ট। কিন্তু ১৯৮৮ সালে পদক জিততে না পারার পর পাকিস্তানের হকি ধীরে ধীরে যেন হারিয়ে যেতে শুরু করল।

১৯৮০ সাল থেকেই পতন শুরু হয়। অনেকে এর জন্য দায়ী করেন অ্যাস্ট্রোটার্ফকে। ঘাসের মাঠের রাজারা যেন খেই হারিয়ে ফেললেন কৃত্রিম মাঠে। এই মাঠে যে ফিটনেস প্রয়োজন তা দেখাতে পারলেন না তারা। কেউ বলেন ক্রিকেটের উত্থান, হকির পতনের কারণ। স্কুলগুলিতে হকির বদলে ক্রিকেট খেলার চল বাড়ল। ছোট থেকে যেন সেই দিকেই মন চলে গেল পাকিস্তানের নতুন প্রজন্মের।

যোগ্যতা অনুযায়ী খেলোয়াড়দের সুযোগ দেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ তোলে পাকিস্তানের সংবাদ মাধ্যম।

যোগ্যতা অনুযায়ী খেলোয়াড়দের সুযোগ দেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ তোলে পাকিস্তানের সংবাদ মাধ্যম। ছবি: রয়টার্স

আঙুল ওঠে পাকিস্তানের হকি ফেডারেশনের (পিএইচএফ) দিকেও। হকির জন্য ঠিক ভাবে টাকা ব্যবহার করতে পারেনি বলে দোষ দেওয়া হয় তাদের। অনেকে বলেন যে খেলোয়াড়রা পাকিস্তানের হকিকে বিশ্ব সেরা করে তুলেছিলেন, সেই প্রাক্তন খেলোয়াড়রাই পতনের কারণ হয়ে উঠলেন। বিদেশি প্রশিক্ষক আনতে দিতেন না। তাঁদের সুযোগ দেওয়া হলে বার বার ব্যর্থ হতেন। তাঁরাই যেন বেড়ি পরিয়ে দিলেন পাকিস্তান হকির পায়ে।

যোগ্যতা অনুযায়ী খেলোয়াড়দের সুযোগ দেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ তোলে পাকিস্তানের সংবাদ মাধ্যম। ক্রিকেটের সাফল্য নয়, তাদের মতে নিজেদের দোষেই ডুবছে পাকিস্তানের হকি।

প্রাক্তন খেলোয়াড় সামিউল্লাহ খান। পাকিস্তান হকির সোনার সময়ের খেলোয়াড়। পরিচিত ছিলেন ‘উড়ন্ত ঘোড়া’ নামে। সামিউল্লাহ অবশ্য মানতে নারাজ যে শুধু মাত্র প্রাক্তন খেলোয়াড়দের জন্যই পাকিস্তানের হকির সাফল্য হারিয়ে গিয়েছে। তিনি বলেন, “বহু প্রাক্তন খেলোয়াড় বার বার ফেডারেশনের অংশ হতে চেয়েছে। কিন্তু সেটা শুধুই সমস্যার মাথাটুকু। ফেডারেশনে নতুন চিন্তা ভাবনা করার লোক নেই। আধুনিক প্রযুক্তি নেই। করাচির মতো বড় শহরের মাঠগুলি স্থানীয় খেলোয়াড়রা ব্যবহার করতে পারে না।”

তবে শাকিল এবং সামিউল্লাহ আশাবাদী পাকিস্তানের হকি আবার বিশ্ব মঞ্চে ফিরে আসবে। সামিউল্লাহ বলেন, “আমরা যদি পরিশ্রম করি এবং ঠিক মতো দিশা দেখাতে পারি তা হলে চার বছরের মধ্যেই উন্নতি করব। প্রতিভা এখনও রয়েছে পাকিস্তানে। সরকারকে আগের মতো হকিকে আবার জাতীয় স্তরে জাগিয়ে তুলতে হবে। হকি খেলোয়াড়দের চাকরি দিতে হবে। আর্থিক ভাবে তাদের চিন্তামুক্ত করতে হবে। দেশের মধ্যেই লিগ খেলতে হবে। যাতে খেলোয়াড়রা আরও বেশি টাকা পায়।”

শাকিলও সহমত লিগ খেলার ব্যাপারে। তিনি বলেন, “ফেডারেশনকে পরিশ্রম করতে হবে। কিন্তু এখন যারা দায়িত্বে রয়েছে তারা এই কাজে পারদর্শী নয়।”

২০১৫ সাল থেকে পিএইচএফ-এর প্রধান অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার খালিদ সাজ্জাদ খোখার। ২০১৯ সাল থেকে সচিবের দায়িত্বে প্রাক্তন খেলোয়াড় আসিফ বাজওয়া। পাঁচ বছর (১৯৯১ থেকে ১৯৯৬) পাকিস্তানের হয়ে খেলা আসিফ মানতে নারাজ যে হকি দলের অবস্থা শোচনীয়। তিনি বলেন, “কাগজে কলমে আমরা হয়তো বিশ্বের ১৮ নম্বর, কিন্তু এখনও আমরা বিশ্বের আট নম্বর দলের মতোই শক্তিশালী। ক্রমতালিকায় পিছিয়ে গিয়েছি কারণ আগে যারা ফেডারেশনের দায়িত্বে ছিল, তারা ২০১৯ সালে হকি প্রো লিগে দল পাঠায়নি। খুব খারাপ সিদ্ধান্ত ছিল। প্রচুর পয়েন্ট কেটে নেওয়া হয় আমাদের। বিশাল অঙ্কের টাকা জরিমানা দিতে হয়। সেই জন্যই টোকিয়ো অলিম্পিক্সে যোগ্যতা অর্জন করতে পারিনি আমরা।”

প্রসঙ্গত, ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল অবধি আসিফই ছিলেন পিএইচএফ-এর সচিব। আসিফ বলেন, “আমাদের খেলোয়াড়দের আন্তর্জাতিক মঞ্চে আরও বেশি করে খেলতে হবে। সেই জন্য টাকা প্রয়োজন। ক্রিকেট দলের মতো টাকা আমাদের নেই। এখন হকিও খুব খরচ সাপেক্ষ। আধুনিক সরঞ্জাম প্রয়োজন। ঘরোয়া স্তরেও হকির উন্নতি প্রয়োজন। স্কুলগুলোতে ফের হকি ফিরিয়ে আনতে হবে। লিগ খেলার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের। হকি আমাদের রক্তে আছে। অতিমারি শেষ হলেই ফের ফিরে আসব আমরা।”

পাকিস্তানের প্রাক্তন গোলরক্ষক ইমরান বাট যদিও মানতে নারাজ। ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল অবধি জাতীয় দলের হয়ে খেলা ইমরান বলেন, “স্বপ্নের জগত থেকে নেমে বাস্তবে ফিরে আসা উচিত আমাদের। আমরা আরও ম্যাচ খেললে ক্রমতালিকায় আরও নীচে নেমে যেতাম। ফেডারেশনের উচিত নতুন পরিকল্পনা নিয়ে আসা। ঠিক মতো পরিকল্পনা করলেই এগোনো সম্ভব। ফেডারেশনকে হকির জন্য কাজ করতে হবে। মুখে শুধু বড় বড় কথা বলে কিছু হবে না।”

কবে ফের বিশ্ব মঞ্চে দেখা যাবে সবুজ জার্সিধারীদের? প্রশ্ন সমর্থকদের মনে। উত্তর এখনও অজানা।

অন্য বিষয়গুলি:

pakistan hockey Tokyo Olympics
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy