রোহিত শর্মা। ছবি: রয়টার্স।
৯ জুলাই, ২০১৯। ম্যাঞ্চেস্টারের সাজঘরে সামনে দাঁড়িয়ে রোহিত শর্মা। কাঁদছেন। দু’হাতে মুখ ঢেকেছেন। সতীর্থেরা সামলাচ্ছেন তাঁকে। তার কিছু ক্ষণ আগেই নিউ জ়িল্যান্ডের কাছে হেরে এক দিনের বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিয়েছে ভারত। প্রতিযোগিতায় পাঁচটি শতরান করেও দলকে জেতাতে পারেননি রোহিত। তাই হয়তো নিজেকে সামলাতে পারছিলেন না তিনি।
২৭ জুন, ২০২৪। আবার সাজঘরের সামনে চোখে জল রোহিতের। এক হাতে চোখ ঢেকে কাঁদছেন। আরও এক বার সতীর্থেরা এসে তাঁকে সামলাচ্ছেন। কিছু ক্ষণ পরে মুখে হাসি ফুটবল রোহিতের। তবে এ বার কিন্তু দুঃখে কাঁদছিলেন না তিনি। ভারতকে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে তুলে কাঁদছিলেন। ইংল্যান্ডকে হারিয়ে বদলা নিয়ে কাঁদছিলেন। বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন দেখে কাঁদছিলেন। অবশেষে হাসলেন তিনি। ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে দেশকে করলেন বিশ্বসেরা। ফাইনাল জিতে মাঠেই শুয়ে পড়লেন রোহিত। আবার কাঁদলেন। এই কান্না স্বস্তির। জবাব দেওয়ার। বিশ্বকাপ জেতার।
অথচ সাত মাস আগে ছবিটা অন্য রকম ছিল। আইপিএলে মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের অধিনায়কের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। নতুন অধিনায়ক হয়েছিলেন হার্দিক পাণ্ড্য। সাত মাস পরে অধিনায়ক হিসাবেই বিশ্বকাপ জিতলেন তিনি। দেশের অধিনায়ক হিসাবে। এই সাত মাসে নিজেকে বদলেছেন রোহিত। নিজের খেলার ধরন বদলেছেন। অধিনায়কত্বের ধরন বদলেছেন। বুঝিয়ে দিয়েছেন, অধিনায়ক হিসাবে কতটা সাহসী তিনি। তাঁর সাহস দেশকে এনে দিয়েছে বিশ্বকাপ।
২০১৯ থেকে ২০২৪, মাঝের পাঁচ বছরে বদলে গিয়েছে অনেক কিছু। সেই সময় রোহিত শুধু ভারতের ওপেনার ছিলেন। এখন তিনি দলের অধিনায়ক। ২০২২ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ও ২০২৩ সালের এক দিনের বিশ্বকাপে ব্যর্থ হয়েছেন। দেশকে ট্রফি জেতাতে পারেননি। রোহিতের কাছে শেষ সুযোগ ছিল এ বছর। আরও এক বার ব্যর্থ হওয়া মানে অধিনায়কত্বের ইতি। হয়তো বা সাদা বলের ক্রিকেটে কেরিয়ারেরও শেষ প্রান্তে এসে গিয়েছেন তিনি। তাই এ বার রোহিতের তাগিদটাই ছিল অন্য রকম। ব্যাটার হিসাবে তো বটেই, অধিনায়ক হিসাবেও।
দীর্ঘ ক্রিকেট ইতিহাসে অনেক বড় বড় অধিনায়ক দেখেছে ভারত। টাইগার পটৌদি, কপিল দেব, মহম্মদ আজহারউদ্দিন, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, মহেন্দ্র সিংহ ধোনিরা ভারতকে বিশ্ব ক্রিকেটের মানচিত্রে উঁচুতে তুলেছেন। বিরাট কোহলি আইসিসি ট্রফি জিততে না পারলেও তাঁর সময়ে ভারত টেস্ট ক্রিকেটে রাজত্ব চালিয়েছে। তাই রোহিতের কাছে লড়াইটা সহজ ছিল না। আইপিএলে পাঁচ বারের ট্রফি জেতা অধিনায়কের কাছে চ্যালেঞ্জ ছিল, দেশের অধিনায়ক হিসাবেও সফল হওয়া।
এ বারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতীয় দল যখন ঘোষণা করা হচ্ছে, তখনও ক্রিকেট কেরিয়ারে অন্যতম খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন রোহিত। তার আগেই আইপিএলে মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁকে। নতুন অধিনায়ক হার্দিক পাণ্ড্যের সঙ্গে রোহিতের মনোমালিন্যের খবর রোজ শিরোনামে। মাঠেও বোজা যাচ্ছে, যে দল প্রকাশ্য দু’ভাগে বিভক্ত। রোহিতকে ফিরিয়ে আনার দাবি জানাচ্ছেন সমর্থকেরা। মুম্বই ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি অবশ্য নিজেদের সিদ্ধান্ত অনঢ়। নতুনের উপর ভরসা রাখছেন তাঁরা। অর্থাৎ, অধিনায়ক রোহিতের উপর ভরসা রাখছে না ম্যানেজমেন্ট। অথচ, সেই সময়ই বিশ্বকাপে অধিনায়ক করা হল রোহিতকে। তাঁর সহকারী সেই হার্দিকই।
আইপিএলে যাই হোক না কেন, জাতীয় দলের জন্য যে রোহিত তৈরি ছিলেন তা দল নির্বাচন থেকেই বোঝা গেল। দলে চার স্পিনার, তিন পেসার। নেই রিঙ্কু সিংহ। বদলে শিবম দুবে। শুভমন গিল, রুতুরাজ গায়কোয়াড়েরা বাদ। প্রশ্ন উঠল। রোহিত জবাব দিলেন। চার জন স্পিনার কেন নিয়েছেন, তার জবাব ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ে পাওয়া যাবে বলে জানালেন। প্রতিটি ক্রিকেটারের জন্য তাঁর আলাদা আলাদা পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানালেন। বিশ্বকাপ যত এগোল, তত বোঝা গেল, কতটা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।
শুধু দল গঠনে নয়, খেলার ধরনেও বদল আনলেন রোহিত। এই দল উইকেট বাঁচিয়ে খেলার লক্ষ্যে নামে না। প্রথম বল থেকে শেষ বল পর্যন্ত আক্রমণ করার লক্ষ্যে নামে। নিউ ইয়র্কের উইকেটে পিচ খারাপ থাকায় ব্যাটারেরা তেমন সুবিধা করতে না পারলেও ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ে যাওয়ার পর ব্যাটারদের আসল রূপ দেখা গেল। আক্রমণের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিলেন রোহিত। যত ক্ষণ ক্রিজ়ে থাকলেন, বড় শট খেললেন। সাদা বলের ক্রিকেটের অন্যতম সেরা ব্যাটার কী ভাবে দলের স্বার্থ মাথায় রেখে নিঃস্বার্থ ক্রিকেট খেলতে পারেন, সেটা করে দেখালেন রোহিত। সুপার ৮-এ অস্ট্রেলিয়াকে একার ব্যাটে হারালেন রোহিত। সেমিফাইনালেও আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেললেন। বিশ্বকাপে ভারতীয়দের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রান করলেন তিনি।
এ তো গেল ব্যাটার রোহিতের কথা, চলতি বিশ্বকাপে নজর কেড়েছেন অধিনায়ক রোহিতও। প্রথম একাদশে বেশি পরিবর্তন করেননি। পুরো বিশ্বকাপে ভারতের মোট ১২ জন ক্রিকেটার খেলেছেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ে যাওয়ার পরে এক পেসার মহম্মদ সিরাজকে বসিয়ে এক স্পিনার কুলদীপ যাদবকে খেলিয়েছেন। সেই সিদ্ধান্ত কতটা কাজে লেগেছে তা ম্যাচের পর ম্যাচে বোঝা গিয়েছে।
দলের ক্রিকেটারদের উপর ভরসা দেখিয়েছেন রোহিত। বিরাট কোহলি একের পর এক ম্যাচে রান না পেলেও তাঁকে দিয়েই ওপেন করিয়ে গিয়েছেন। শিবমের উপরেও ভরসা দেখিয়েছেন। রোহিত যেন পরিবারের বড় দাদা। তাঁর কাছে গিয়ে যে কেউ নিজের মনের কথা বলতে পারেন। মাঠে হাসি, মজা করেন। কেউ ভুল করলে গালাগাল দেন। আবার ভাল করলে পিঠ চাপড়ে সেটা জানানও। যশপ্রীত বুমরা, সূর্যকুমার যাদবেরা রোহিতের অধিনায়কত্বের প্রশংসা করেছেন। জানিয়েছেন, কতটা স্বাধীন ভাবে খেলতে পারেন তাঁরা। কোনও চাপ থাকে না।
তার প্রভাব দলের খেলাতেও পড়েছে। প্রতিটি ম্যাচ জিতেছে ভারত। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হারের মুখ থেকে জয় এসেছে। কোনও সময় দেখে মনে হয়নি, এই দল হারতে পারে। হারকে বাউন্ডারির বাইরে রেখে নেমেছেন রোহিত। স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, বিপক্ষে যে দলই থাকুক না কেন, তাঁদের খেলার ধরন বদলাবেন না। নিজেদের পরিকল্পনা অনুযায়ী খেলবেন। সেটাই করেছে ভারত। অপরাজিত থেকে বিশ্বকাপ জিতেছে। সেই সঙ্গে ভারতের সেরা অধিনায়কদের তালিকায় নিজের জায়দা করে নিয়েছেন রোহিত। ভারতের বিশ্বকাপের খরা কাটিয়েছেন তিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy