(বাঁ দিকে) রোহিত শর্মা এবং বিরাট কোহলি। —ফাইল চিত্র।
বিরাট কোহলির হাত থেকে ভারতীয় দলের নেতৃত্ব পেয়েছিলেন রোহিত শর্মা। ভারতীয় ক্রিকেটে বর্তমান সময়ের অন্যতম দুই সেরা ব্যাটার। হয়তো বা সেরাই। ক্রিকেটার হিসাবে তাঁদের দক্ষতা আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রশ্নাতীত। দু’জনেই সফল অধিনায়কও। কিন্তু ট্রফির নিরিখে মাপলে রোহিতের পাশে রাখা যাবে না কোহলিকে!
সব ধরনের ক্রিকেট মিলিয়ে কোহলি ভারতীয় দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ২১৩টি ম্যাচে। ১৩৫টি ম্যাচে জিতেছেন। হেরেছেন ৬০টি ম্যাচ। তাঁর সাফল্যের হার ৬৩.৩৮ শতাংশ। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালের আগে পর্যন্ত রোহিত দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ১২২টি ম্যাচে। জিতেছেন ৯২টি ম্যাচ। হেরেছেন ২৬টি ম্যাচ। তাঁর জয়ের শতাংশ ৭৫.২০।
কোহলির নেতৃত্বে ভারত এক বার টেস্ট বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেছে। ২০১৯-২০২১ মরসুমের ফাইনালে নিউ জ়িল্যান্ডের কাছে হারতে হয় ভারতকে। রোহিতের নেতৃত্বেও ২০২১-২০২৩ মরসুমের টেস্ট বিশ্বকাপ ফাইনালে হেরেছে ভারতীয় দল। তবে অধিনায়ক রোহিত ২০১৮ এবং ২০২৩ সালে এশিয়া কাপ চ্যাম্পিয়ন করেছেন ভারতকে। কোহলি কখনও দলকে এশিয়া কাপে ফাইনালে তুলতে পারেননি। রোহিতের নেতৃত্বে ভারত ২০২৩ এক দিনের বিশ্বকাপের ফাইনালেও উঠেছিল। কোহলি ২০১৯ সালের বিশ্বকাপে দল নিয়ে ফাইনালে পৌঁছতে পারেননি। এ বার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও রোহিতের নেতৃত্বে ফাইনালে ভারত। অধিনায়ক হিসাবে কোহলির এই কৃতিত্বও নেই। অধিনায়ক কোহলি কখনও আইপিএল চ্যাম্পিয়ন হতে পারেননি। রোহিতের নেতৃত্বে পাঁচ বার আইপিএল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে মুম্বই ইন্ডিয়ান্স।
ট্রফি জয়ের পরিসংখ্যানের নিরিখে অনেকটা এগিয়ে রোহিত। কিন্তু ট্রফি নেই কোহলির ঝুলিতে। অথচ তাঁর আমলে মাঠের লড়াইয়ে ভারতীয় দলকে অনেক বেশি আগ্রাসী দেখাত। কোহলি নিজের আগ্রাসী মানসিকতা ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন সতীর্থদের মধ্যে। রোহিত আবার ভিন্ন চরিত্রের। তুলনায় কিছুটা শান্ত। ভুল করলে সতীর্থদের বকাঝকা করেন। বোলিং পরিবর্তন, ফিল্ডিং সাজানো, ক্রিকেটীয় রণকৌশল তৈরির ক্ষেত্রে দু’জনেই দক্ষ। তবু সাফল্যের নিরিখে এগিয়ে রোহিত।
কোহলি নিজের ব্যাটিংকে নিয়ে গিয়েছেন সাধনার জায়গায়। অধিনায়ক হিসাবে তিনি চাইতেন দলের বাকিরাও তাঁর মতো খেলুক। দলের অন্তত দু’-তিন জন ব্যাটার বড় রানের ইনিংস খেলবেন। দু’-তিন জন বোলার প্রতিপক্ষকে নাজেহাল করে ছাড়বেন। অন্তত পাঁচ-ছ’জনকে সেরা পারফরম্যান্স করতে হবে। প্রতিপক্ষকে কোনও সুযোগ দেওয়ারই পক্ষপাতী নন তিনি। অধিনায়ক কোহলির কথায় এই দর্শন একাধিক বার প্রকাশিত হয়েছে।
রোহিত অন্য রকম। তিনি বড় রানের ইনিংস বা ৫ উইকেটের থেকেও বেশি গুরুত্ব দেন দলগত পারফরম্যান্সকে। তিনি বিশ্বাস করেন সম্মিলিত ফলাফলে। এক জন ব্যাটারের ১০০ রানের ইনিংসের থেকেও গুরুত্ব দেন দলের ছ’-সাত জন ব্যাটার মিলে জেতার মতো রান তুলুক। সতীর্থদের নিজের মতো খেলার স্বাধীনতা দেন। কেউ ব্যর্থ হলেও ম্যাচের পর ম্যাচ সুযোগ দেন। তাঁর কাছে চেষ্টাটাই মুখ্য। ফলাফল নিয়ে ভাবেন না। শতরানের মুখে দাঁড়িয়েও সাহসী ক্রিকেট খেলেন। পাকিস্তানের প্রাক্তন ক্রিকেটার শোয়েব আখতার বলেছেন, ‘‘রোহিত নিঃসন্দেহে বড় ক্রিকেটার। তবে ওর মতো স্বার্থহীন ক্রিকেট খুব কম জনই খেলতে পারে। দলের স্বার্থই ওর কাছে সব চেয়ে আগে। অধিনায়ক রোহিত তাই সবার থেকে আলাদা।’’ প্রায় একই কথা বলেছেন তাঁর মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের সতীর্থ পীযূষ চাওলাও। ভারতীয় স্পিনারের বক্তব্য, ‘‘রোহিত মাঠে নেমে নিজে উদাহরণ তৈরি করে। ও অধিনায়ক নয়, নেতা। এক জন নেতা উদাহরণ তৈরি করলে, বাকিরাও তাকে অনুসরণ করে। ভারতীয় দলে আমরা সেটাই দেখছি।’’
ঠিক এই জায়গাতেই অধিনায়ক কোহলির সঙ্গে পার্থক্য রোহিতের। ভারতীয় দলে ঘুমকাতুরে হিসাবে পরিচিত রোহিত অধিনায়ক নন, নেতা। ক্রিকেট সাধক কোহলি থেকে গিয়েছেন অধিনায়ক হয়েই। তাঁর ক্রিকেট দর্শনে থাকে পারফরম্যান্স করার চাপ। রোহিতের দলের ক্রিকেটারেরা ম্যাচের প্রতিটি বল, প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করার সুযোগ পান। অধিনায়ক কোহলি চান জেতার জন্য খেলতে। রোহিতের দর্শন, খেলতে খেলতে জেতা।
খেলার মাঠের সঙ্গে যুক্তেরা বলেন, ট্রফি জিততে ভাগ্য প্রয়োজন হয়। সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে জয়ের পর ভারতীয় দলের কোচ রাহুল দ্রাবিড়ও বলেছেন, ‘‘আমরা নিজেদের সেরা দিয়ে চেষ্টা করতে পারি। কিন্তু সেটাই সব নয়। অনেকগুলো বিষয় রয়েছে। পরিকল্পনা, সেই মতো পারফর্ম করা, দলের সকলের ইতিবাচক অবদান এবং অবশ্যই ভাগ্য। এই সব কিছু একসঙ্গে হলেই চ্যাম্পিয়ন হওয়া যায়।’’
রোহিতের ট্রফি জেতার কপাল চওড়া। হয়তো তাই। সেই কপালকে টেনে আরও চওড়া করার চেষ্টা করেন না। তিনি বলেন, চেষ্টাটাই আসল। চাপের মধ্যে রাখলে সেরা পারফরম্যান্স পাওয়া যায় না। একান্নবর্তী পরিবারের বড় ভাইয়ের মতো সকলকে আগলে রাখতে চান। বাংলার প্রাক্তন অধিনায়ক মনোজ তিওয়ারি বলেছেন, ‘‘দেখে মনে হয় রোহিত দলটাকে পরিবারের মতো চালায়। ও ক্রিকেটারদের মধ্যে থেকে সেরাটা বার করে আনতে পারে। দলের ক্রিকেটারেরাও চেষ্টা করে নিজেদের সেরাটা দিয়ে রোহিতের পাশে দাঁড়াতে। রোহিত মাঠের মধ্যে এবং বাইরে দলের ক্রিকেটারদের থেকে যে শ্রদ্ধা পায় সেটা তুলনাহীন। ও একটা পরিবার তৈরি করেছে।”
দুই ভিন্ন ভারতীয় ঘরানায় বেড়ে উঠেছেন কোহলি এবং রোহিত। দিল্লি এবং মুম্বই। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁদের মানসিকতা আলাদা। দিল্লি ঘরানার ক্রিকেটারেরা সাধারণত একটু বেশি একরোখা হন। কোহলিও অনেকটা তেমন। যা সব সময় পরিস্থিতির অনুকূল হয় না। বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটার, সফল অধিনায়ক হলেও তাই ট্রফি জেতা হয়নি তাঁর। রোহিত তাঁর মতো ক্রিকেট সাধক নন। ক্রিকেটের পাশাপাশি জীবনকেও উপভোগ করতে চান। কোহলিসুলভ সংযম তাঁর অভিধানে নেই।
ক্রিকেটার রোহিতের সহজ দর্শন তাঁর নেতৃত্বের পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে। যে দর্শনে ব্যক্তিগতের থেকে দলগত পারফরম্যান্স বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ফলাফলের থেকে চেষ্টা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সংযমের থেকে উপভোগ বেশি প্রাধান্য পায়। মাইলফলকের থেকে স্বার্থহীন ক্রিকেট স্বাগত। তিনি বোঝেন, চাইলেই সবাই রোহিত বা কোহলি হতে পারেন না। কাউকে করাও যায় না। খেলা নিয়ে প্রত্যেকের ভাবনা আলাদা। একেক জন একেক ভাবে খেলতে অভ্যস্ত। সবার ভাবনা, স্বাচ্ছন্দ্যকে গুরুত্ব দেন। দলের পরিবেশ হালকা রাখেন।
মাঠের টুকরো টুকরো রাগগুলি তো থাকবেই। যতই হোক ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক বলে কথা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy