Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
ইস্টবেঙ্গল ৩(র‌্যান্টি পেনাল্টি-সহ ২, জোয়াকিম) : মোহনবাগান ১ (সাবিথ)

আর্মান্দোর পুনর্জন্মের দিনে সুভাষে অমাবস্যা

সুভাষ ভৌমিক যখন মাথা নিচু করে ধীর পায়ে ড্রেসিংরুমের পথে, তখন মাঠের ভিতর ঢুকে মাথার উপর দু’হাত তুলে তালি দিচ্ছিলেন আর্মান্দো কোলাসো। রবি-সন্ধ্যার যুবভারতীতে ডার্বির দুই কোচের মুখাবয়ব দেখে মনে হচ্ছিল পূর্ণিমা আর অমাবস্যার মিশেল যেন। প্রত্যাবর্তন আর অপ্রত্যাশিত ধাক্কায় হতভম্ব হয়ে যাওয়ার ছবি কি এ রকমই হয়? ডার্বির পাঁচদিন আগে কালীঘাটের সঙ্গে ড্র-য়ের পর যুবভারতীর গেটের সামনে যাঁকে প্রায় ‘ফেয়ারওয়েল’ দিয়ে দিয়েছিল জনতা, উঠেছিল ‘আর্মান্দো হটাও, মর্গ্যান লাও’ স্লোগান, সেই মুখগুলো বদলে গিয়েছে এক ডার্বি জয়েই।

ডার্বি শেষে দুই কোচ। ছবি উৎপল সরকার, শঙ্কর নাগ দাস

ডার্বি শেষে দুই কোচ। ছবি উৎপল সরকার, শঙ্কর নাগ দাস

রতন চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৪:১০
Share: Save:

সুভাষ ভৌমিক যখন মাথা নিচু করে ধীর পায়ে ড্রেসিংরুমের পথে, তখন মাঠের ভিতর ঢুকে মাথার উপর দু’হাত তুলে তালি দিচ্ছিলেন আর্মান্দো কোলাসো।

রবি-সন্ধ্যার যুবভারতীতে ডার্বির দুই কোচের মুখাবয়ব দেখে মনে হচ্ছিল পূর্ণিমা আর অমাবস্যার মিশেল যেন।

প্রত্যাবর্তন আর অপ্রত্যাশিত ধাক্কায় হতভম্ব হয়ে যাওয়ার ছবি কি এ রকমই হয়?

ডার্বির পাঁচদিন আগে কালীঘাটের সঙ্গে ড্র-য়ের পর যুবভারতীর গেটের সামনে যাঁকে প্রায় ‘ফেয়ারওয়েল’ দিয়ে দিয়েছিল জনতা, উঠেছিল ‘আর্মান্দো হটাও, মর্গ্যান লাও’ স্লোগান, সেই মুখগুলো বদলে গিয়েছে এক ডার্বি জয়েই। লাল-হলুদের গোয়ান কোচ যখন গাড়িতে উঠতে যাচ্ছেন তখন স্লোগান উঠল ‘সুভাষ তুই দেখে যা আর্মান্দোর ক্ষমতা’। ড্রেসিংরুমে নজিরবিহীনভাবে কর্তাদের দেড় লাখের সঙ্গে তিনিও নিজের পকেট থেকে আরও পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে এসেছেন। ফুটবলারদের পুরস্কৃত করার জন্য। পাঁচ তারা হোটেলে ডিনারের ব্যবস্থাও হয়ে গিয়েছে। এ রকম আবহাওয়া থেকে বেরিয়ে গাড়িতে ওঠার সময় বদলে যাওয়া স্লোগান শুনে একটা অদ্ভুত তৃপ্তির হাসি খেলে যায় দেশের সফলতম কোচের মুখে। “জানেন, নিজেকে দারুণ হালকা লাগছে এখন। ম্যাচের আগে ছেলেদের বলেছিলাম মাঠে এবং মাঠের বাইরে আমাদের নিয়ে প্রচুর সমালোচনা হচ্ছে। এই ম্যাচটা জিততে পারলেই সব জবাব দেওয়া যায়। ওরা পেরেছে। পারবে আমি জানতাম।” বলার সময় পাঁচটি আই লিগ জয়ী কোচের চোখ ছলছল করে ওঠে। আনন্দাশ্রুতে। মনে হচ্ছিল, পাহাড়প্রমাণ অদৃশ্য চাপ থেকে বেরিয়ে আসা কোনও মুক্ত মানুষ যেন নিজের জীবনের গল্প শোনাচ্ছেন। যাঁর ‘কামব্যাক’ ঘটেছে কিছুক্ষণ আগেই।

আর তিনি? সুভাষ ভৌমিক? যিনি বাগান সমর্থকদের কাছে গত দু’মাস ‘হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা’ হয়ে দেখা দিয়েছিলেন? নিজের হাতে শুধু বিদেশি বাছাই নয়, পুরো টিমই তৈরি করেছেন। যাঁর দেখানো স্বপ্নে স্টেডিয়ামের এক লক্ষের গ্যালারির ষাট ভাগ উপচে পড়েছিল সবুজ-মেরুন সমর্থকে! ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে যিনি ডার্বির চব্বিশ ঘণ্টা আগে লুঙ্গি ডান্সের গান বাজিয়ে দিয়েছিলেন ড্রেসিংরুমে! ম্যাচের পর সেই মোহন-টিডিকে দেখে মনে হচ্ছিল বিশ্বের সবথেকে হতাশ মানুষ। “একবারও ভাবিনি এ ভাবে ভেঙে পড়বে আমার টিম! দ্বিতীয়ার্ধে তো দাঁড়াতেই পারলাম না। তিন নম্বর গোলের সময় ধনচন্দ্র বুটের ফিতে বাঁধছিল। কী বলব! ওখান থেকেই তো আব্রাঞ্চেস গোলের সেন্টারটা করল। ৩-১ পিছিয়ে পড়ার পর আর পারা যায়? আরও গোল হতে পারত। আমি টিম গড়েছি, সব দোষ আমার,” সুভাষের শরীরী ভাষার সঙ্গে তখন একমাত্র তুলনায় আসতে পারত ঝড়ে উপড়ে পড়া কোনও বটগাছের। শিকড়েও যেখানে টান পড়েছে। চৌম্বকে ম্যাচের যা নির্যাস ধরা পড়ছে তা তো বলেই দিচ্ছে, পঁচাত্তরের পাঁচ গোলের স্মৃতি ফিরে আসতে পারতই এ দিন। লাল-হলুদের র‌্যান্টি, তুলুঙ্গা আর বার্তোস সহজতম গোল নষ্ট না করলে।

ইন্ডিয়ান সুপার লিগ খেলতে ইস্টবেঙ্গলের ১৫-১৬ জন ফুটবলার চলে যাচ্ছেন। ফলে আর্মান্দোর টিম পরের সব ম্যাচ জিতে কলকাতা লিগ পাবে কি না, সেটা নিয়ে নানা ধোঁয়াশা এবং প্রশ্ন থাকছেই। কিন্তু এ দিনের পর একটা জিনিস পরিষ্কার। এই জয় মর্গ্যানের মতোই লাল-হলুদে প্রতিষ্ঠার সুযোগ দেবে আর্মান্দোকেও। ডেম্পোর সোনালি যুগের পর ইস্টবেঙ্গলেও আর্মান্দো-জমানার রাস্তা হয়তো খুলে দেবে।

কিন্তু ডার্বির বিশ্রী হারের পর সুভাষের ভবিষ্যৎ কি? যা খবর তাতে মোহন-টিডির এই মূহূর্তে আশঙ্কার কোনও কারণ নেই। মঙ্গলবার-ই এই হারের কাটাছেঁড়া করতে বৈঠক ডেকেছেন কর্তারা। সেখানে টিডির সঙ্গে টেকনিক্যাল কমিটির তিন সদস্যকে ডাকা হয়েছে। এর পর বাগানের কী হবে তার হয়তো আঁচ পাওয়া যাবে বৈঠকের পর। কিন্তু এটা ঘটনা, ইস্টবেঙ্গল-চার্চিলের রিজার্ভ বেঞ্চে বসে নিউ আলিপুরের ভদ্রলোক চূড়ান্ত সফল হলেও, বাগান ‘জার্সি’ তাঁর সাথ দেয়নি কখনও। ফুটবলার জীবনে, কোচ হিসাবেও। গঙ্গাপাড়ের তাঁবুতে মরসুমের শুরুতে এ বারই টিডি হিসাবে সুভাষের প্রথম আসা। সুভাষ এ দিন আক্ষেপ করে বলেও ফেললেন, “জিততে হলে লাক ফ্যাক্টরটা কিন্তু খুব দরকার। প্রথমার্ধে পরপর যেভাবে আমাদের গোলগুলো নষ্ট হল, আর ওরা সব চান্সগুলো থেকে গোল করে গেল! এরপর আর কী বলব।” সুভাষ ‘ফ্যাক্টর’ খুঁজে বেড়াবেন স্বাভাবিক। কিন্তু পরিস্থিতি যা তাতে, বাগানের দুই নতুন বিদেশি ফাতাই আর আইকন ফুটবলার হিসাবে আসা বোয়ার কপাল পুড়তে পারে। সুভাষ নিজেই খুশি নন বোয়ার খেলায়। সাংবাদিক সম্মেলনে জানিয়েও দিয়েছেন সে কথা। আর অর্থসচিব দেবাশিস দত্তের মতো বাগানের শীর্ষকর্তারা ফাতাইয়ের পারফরম্যান্স দেখে হতাশ।

কিন্তু বিদেশিদের ব্যর্থতাকে ঢাল করে বাগানের ডার্বি হার চাপা দেওয়ার কোনও কারণ নেই। কাতসুমি ছাড়া বাগানের সব ফুটবলারই এ দিন নিজেদের পারফরম্যান্সের ধারে কাছে পৌঁছতে পারেননি। লক্ষ দর্শকের শব্দব্রহ্ম শেহনাজ, জেজেদের এতটাই অগোছাল করে দিয়েছিল যে মনে হচ্ছিল এই টিমটা নিয়ে স্বপ্ন দেখার কোনও মানে হয় না। ফাতাই পেনাল্টির জন্য দায়ী এটা বাস্তব, কিন্তু তার আগে রাইট ব্যাক সতীশ সিংহ ও ভাবে লোবোর দৌড়ে হামাগুড়ি খাবেন কেন? র‌্যান্টির শেষ গোলটার সময়ও তো কেটে গেলেন রক্ষণের ফুটবলাররা। তা হলে ক্লোজ ডোর অনুশীলনে হলটা কী? শুধুই চমক? সবই আরোপিত? লোক দেখানো? যে বাগান পিছিয়ে পড়েও ম্যাচটা ১-১ করে দিয়েছিল, তারাই ১-৩ এ হারল। এবং কেন দ্বিতীয়ার্ধে ‘পাড়ার দল’ হয়ে গেল, তা নিয়ে ম্যাচের পর তাই প্রশ্ন উঠছেই।

র‌্যান্টির প্রথম গোলের পর হলুদ আবির উড়িয়ে দিয়েছিলেন এক সমর্থক। গ্যালারির দিকে উচ্ছ্বাস জানাতে ছুটে আসা গোলমেশিনকে লক্ষ্য করেই। জয়ের পর আবিরের রং-এর মশাল জ্বলল স্টেডিয়াম জুড়ে। যা সম্ভব হল, শুধুমাত্র আর্মান্দো এবং তাঁর টিমের জেদ ও শান্ত থেকে জয়ের রাস্তা খোঁজার জন্য। সুভাষকে গোয়ান কোচ টেক্কা দিয়ে গেলেন, প্রতি পনেরো মিনিট অন্তর স্ট্র্যাটেজি বদল করেও। কখনও মেহতাব আর খাবরাকেবক্স টু বক্স খেলিয়ে, কখনও জোয়াকিম-লোবোদের কোণাকুণি দৌড় করিয়ে, কখনও বা রক্ষণ জমাট করতে লোক বাড়িয়ে। ৩-১ এর পর ডুডুকে নামানোও আর্মান্দোর মাস্টার স্ট্রোক। লক্ষ্য ছিল, পাঁচ গোল হজমের ভয়ে যাতে বাগান সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপাতে না পারে। পাল্টা চাপের এই খেলায় দশে দশ পেয়ে গেলেন বেঙ্গল-কোচ।

৩-১ এর পর সুভাষ একবার শুধু রিজার্ভ বেঞ্চ ছেড়ে উঠলেন। বোয়া নামার পর। কিন্তু দু’টো বল ক্যামেরুন ফুটবলার ধরার পর তিনি বুঝে যান, এটাও অচল আধুলি। মোহন টিডি আর ‘সাহস’ দেখাননি। উল্টো দিকে রিজার্ভ বেঞ্চের সামনে আর্মান্দো নব্বই মিনিটই ঠায় দাঁড়িয়ে থেকেছেন। নির্দেশ দিয়েছেন, বকেছেন, আদরও করেছেন ছাত্রদের। উৎকণ্ঠায় দু’বার টেকনিক্যাল এরিয়ার বাইরে চলে যাওয়ায় সতর্কিতও হন তিনি, চতুর্থ রেফারির কাছে। তাতেও ইস্টবেঙ্গল কোচ দমেননি। আসলে টিমের মনোবল বাড়াতে বারো নম্বর ফুটবলার হতে চেয়েছিলেন তিনি।

সেই ‘সাহস’-ই আর্মান্দোর কোচিং জীবনে ফের আলো এনে দিল রবিবাসরীয় সন্ধ্যায়। পূণির্র্মার আলো হয়ে। পুনর্জন্মের আলো ছড়িয়ে।

ইস্টবেঙ্গল: অভিজিৎ, রাজু, অর্ণব, দীপক, রবার্ট, খাবরা, আব্রাঞ্চেস, লোবো(তুলুঙ্গা), মেহতাব, র‌্যান্টি, বার্তোস (ডুডু)।

মোহনবাগান: শিল্টন, সতীশ, কিংশুক, ফাতাই(বোয়া), ধনচন্দ্র, শেহনাজ, কাতসুমি, লালকমল, জেজে (মণীশ, সুখেন), সাবিথ, বলবন্ত।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE