সিংহাসনে: অধিনায়কের ব্লেজ়ার পরে বোর্ড প্রেসিডেন্টের আসনে সৌরভ। বুধবার মুম্বইয়ে। ছবি: টুইটার।
১৯৯৬ লর্ডস। অভিষেক টেস্ট খেলতে নামার সময় সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রতিপক্ষ তিন বোলারের নাম? ক্রিস লুইস, ডমিনিক কর্ক এবং অ্যালান মুলালি। ইংরেজ বোলারদের পিটিয়ে করা ১৩১ এবং তার পর দু’হাত তুলে সেই উৎসবের ভঙ্গি ভারতীয় ক্রিকেটের অ্যালবামে ঢুকে রয়েছে।
২০১৯ মুম্বই। বোর্ড প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিষেক ‘ম্যাচ’ খেলতে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় এলেন ভারতীয় দলের ব্লেজার গায়ে চাপিয়ে। যে ব্লেজ়ার পরে প্রথম ভারত অধিনায়ক হিসেবে টস করতে গিয়েছিলেন। সকালে যা গায়ে তোলার পরে বুঝতে পারেন, খুব ঢিলেঢালা হয়ে গিয়েছে।
ভারতীয় ক্রিকেট দলের ব্লেজ়ার পরা বোর্ড প্রেসিডেন্ট? কখনও হয়েছে? সরকারি ভাবে উত্তর, হ্যাঁ। ভিজির রাজা ছিলেন। একই সঙ্গে ভারতীয় দলের অধিনায়ক এবং বোর্ড প্রধানের সিংহাসনে বসেছেন। কিন্তু ভিজির রাজার অধিনায়ক হওয়াটা নিজেই নিজেকে নির্বাচিত করার মতো কেলেঙ্কারি। বেহালার মহারাজের মতো নির্বাচনী বৈঠকের মধ্যে দিয়ে অধিনায়ক হওয়া নয়।
কাকতালীয়, এই মুম্বইয়ের বৈঠকেই প্রথম ভারত অধিনায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন সৌরভ। অধিনায়কের ব্লেজ়ার পরে বোর্ডের মসনদে বসে শুরুতেই যেন বার্তা দিয়ে রাখলেন তিনি যে, ক্রিকেটারের দৃষ্টিভঙ্গিতেই তিনি প্রশাসন চালাবেন। তাই প্রথম দিন বারবার তাঁর কথায় প্রাধান্য পেল ক্রিকেট। এক বার বলেও দিলেন, ‘‘আমি বোর্ড চালাব, যে ভাবে ক্রিকেট টিম চালিয়েছি সে ভাবেই। দুর্নীতি ঢুকতে দেব না। ভারতীয় ক্রিকেট এবং একমাত্র ক্রিকেটই পাবে অগ্রাধিকার।’’
তেইশ বছরের ব্যবধানে নতুন অভিষেক সামলাতে এসে অবশ্য ভয়ঙ্কর সব বাউন্সার উড়ে আসার প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হচ্ছে তাঁকে। যেমন, বোর্ডের মসনদে বসার পরে বৃহস্পতিবারই প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে যাচ্ছেন। সৌরভ জমানার প্রথম নির্বাচনী বৈঠক। যে বৈঠকের আগে প্রথম বার তিনি বসবেন অধিনায়ক বিরাট কোহালির সঙ্গে।
পরামর্শ: ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সদর দফতরে নতুন প্রেসিডেন্ট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। পাশে বোর্ডের সচিব, অমিত শাহ-পুত্র জয়। বুধবার মুম্বইয়ে। ছবি: রয়টার্স।
এমনিতে কোহালির ক্রিকেটীয় দক্ষতা সম্পর্কে বরাবর উচ্ছ্বসিত সৌরভ। এ দিনও বারবার বললেন, ‘‘কী অসাধারণ প্লেয়ার। আমার কিছু বলারই দরকার নেই।’’ কিন্তু বৈঠকে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির ভবিষ্যৎটাও বুঝে নিতে হবে।
নতুন বোর্ড প্রেসিডেন্টকে সকাল থেকে ধোনি নিয়ে যা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যেতে হল, ক্রিকেট জীবনে মুরলীধরনের থেকে অত দুসরা সামলাতে হয়নি। ওয়াংখেড়েতে বোর্ডের সদর দফতরে ঢোকার মুহূর্ত থেকে ধোনি, দুপুরে ধোনি, রাতে ধোনি। দুপুরে সাংবাদিক সম্মেলনে এসে বলে গিয়েছেন, ‘‘চ্যাম্পিয়নরা রাতারাতি শেষ হয়ে যায় না। আমি দলের বাইরে গিয়েও ফিরে এসেছিলাম। তার পরে চার বছর খেলেছি। ভারতের গর্ব ধোনি। ও কী চায়, সেটা দেখতে হবে।’’ বলেছেন, ‘‘ধোনি এমন এক ক্রিকেটার যাঁর দিকে তাকিয়ে শুধু বলতে হয়, ওয়াও!’’
রাতের দিকে আরব সাগরের পাড়ের হোটেলে দাঁড়িয়ে সৌরভ অবশ্য আনন্দবাজারকে জানালেন, অধিনায়ক বিরাট কোহালির সঙ্গে ধোনি নিয়ে কথা বলবেন। শুনে মনে হল, অধিনায়ক-প্রেসিডেন্ট শীর্ষ বৈঠকেই যা ঠিক হওয়ার ঠিক হয়ে যাবে। নির্বাচনী বৈঠক পর্যন্ত আর ধোনি-মামলা হয়তো গড়াবেই না।
সেই মুম্বই যেখানে অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেটে খেলতে এসে অনামী হোটেলে থেকে ওয়াংখেড়েতে সেঞ্চুরি। কিশোর সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের জীবনের অন্যতম টার্নিং পয়েন্ট। যা রঞ্জি ট্রফিতে খেলার পথ তৈরি করে দিয়েছিল।
ধোনি মঙ্গলবারই রাঁচীতে বিরাটদের ড্রেসিংরুমে এসে সকলের সঙ্গে দেখা করে গিয়েছেন। বিরাটদের কাছে তিনি কি ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনও ইঙ্গিত দিয়ে গিয়েছেন? প্রেসিডেন্ট আঁচ পেতে পারেন অধিনায়কের সঙ্গে বৈঠকে। মুখে যদিও সৌরভ বললেন, ‘‘বিরাটের সঙ্গে সব মিলিয়ে ক্রিকেট নিয়েই আলোচনা করতে চাই। ধোনির ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা উঠতে পারে। দেখা যাক, ও কী ভাবে ব্যাপারটা দেখছে। অধিনায়কের বক্তব্যই তো সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’’ দুপুরে বলেছেন, ‘‘ভারতীয় ক্রিকেটের সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নাম বিরাট কোহালি। অধিনায়কের সঙ্গে কথা বলে সব কিছু ঠিক করা হবে।’’
দলের অভ্যন্তরীণ সূত্রের খবর, ধোনি এখনই তাঁর অবস্থান পাল্টাতে চান না। বিশ্বকাপ থেকে ফিরে তিনি সেই যে ক্রিকেট সরঞ্জাম তুলে রেখেছেন, এখনও নামাননি। এখনই নামাবেন, তেমন ইঙ্গিতও নেই। ওয়াকিবহাল মহলের কথায়, ‘‘আইপিএলের আগে ধোনির মাঠে ফেরার সম্ভাবনা ক্ষীণ। সম্ভবত আইপিএলে চেন্নাই সুপার কিংসের হয়ে খেলার পরেই কোনও পাকাপাকি সিদ্ধান্ত নেবে ও।’’ তত দিন কি ধোনির অজ্ঞাতবাস চলতে থাকবে? ইঙ্গিত সে দিকেই। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দল নির্বাচনে সীমিত ওভারের দলে ধোনির নাম নিয়ে আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই। শোনা গেল, রাঁচীতে ড্রেসিংরুমে এসেও ধোনি আকার-ইঙ্গিতে যা বুঝিয়েছেন, কোনও ভাবেই এখন মাঠে ফেরার ইচ্ছা নেই। অর্থাৎ, তোমরা ঋষভ পন্থকে তৈরি করার প্রক্রিয়া চালিয়ে যাও। নতুন প্রেসিডেন্টের মনোভাব যত দূর বোঝা গেল, তিনি খুব চাপাচাপির মধ্যে যাবেন না। ধোনির উপরে সিদ্ধান্তের ভার ছাড়বেন। বিরাটের বক্তব্য শুনবেন।
আবার এটাও মনে হচ্ছে যে, শক্ত হাতে প্রশাসনিক দায়িত্বও সামলাতে চান। সব কিছুতে মাথা নেড়ে যাওয়া বোর্ড প্রেসিডেন্ট তিনি হবেন না। যেমন দিন-রাতের টেস্ট ম্যাচ নিয়ে যতই বিরাটদের আপত্তি থাকুক, তিনি চালু করতে আগ্রহী। না হলে ফাঁকা গ্যালারিতে খেলা চালানোর ক্ষতি সহ্য করে যেতে হবে। ‘‘টেস্ট ক্রিকেটে মাঠে লোক ফেরাতেই হবে। বিরাট কোহালির খেলা দেখতে কেউ আসছে না, এটা কেন হবে!’’ বলেই সৌরভের ব্যাখ্যা, ‘‘টি-টোয়েন্টি যখন শুরু হয়েছিল, অনেকের সংশয় ছিল। এখন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। সব চেয়ে জনপ্রিয় ফর্ম্যাট। দিন-রাতের টেস্টের ভাবনাটা আকর্ষণীয়।’’
অধিনায়ক সৌরভ টিম মিটিংয়ে গিয়ে তাঁর ক্রিকেটারদের জন্য লড়তেন। আর বেরিয়ে এসে তাঁদের থেকেই সেরা খেলা দাবি করতেন। মনে হচ্ছে, বোর্ড প্রেসিডেন্ট হিসেবেও একই স্টান্স থাকবে তাঁর। কোহালি, ধোনির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে গেলেন। তা বলে ধোনিকে মাঠে ফেরানোর জন্য খুব মরিয়া হয়ে উঠবেন বলেও ইঙ্গিত নেই। বরং অধিনায়ক থাকার সময় যেমন হরভজন, যুবরাজ, জাহিরের মতো তরুণ প্রতিভাদের তুলে এনেছিলেন, এখানে ঋষভ পন্থদের তৈরি করার প্রক্রিয়াকে সিলমোহর দিলে মোটেও অবাক হওয়ার থাকবে না।
এমনকি, যে হেড কোচ রবি শাস্ত্রীর সঙ্গে তাঁর অতীত সম্পর্কের প্রসঙ্গ টেনে নানা কথা ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেটাকেও উড়িয়ে দিলেন স্পিনারকে স্টেপ আউটের ভঙ্গিতে। বললেন, ‘‘আমরা এখানে ওদের জীবন কঠিন করতে আসিনি। এসেছি ওদের জীবন সহজ করতে। টিম ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে বসব। প্রকৃত আলোচনা হবে। আমার মাথায় শুধুই থাকবে সকলে মিলে ভারতীয় ক্রিকেটকে কী ভাবে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি।’’ আবার রাতের দিকে আনন্দবাজারকে বললেন, ‘‘আমার সমর্থন সব সময় থাকবে টিমের জন্য, কিন্তু পারফরম্যান্সও চাইব।’’
ফ্ল্যাশব্যাক করতে বসে বুধবারের দু’টো ছবি খুব তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে গেল। সৌরভ সাংবাদিক সম্মেলন করতে আসছেন। আর অপেক্ষা করছেন তাঁর টেস্ট অভিষেকের অধিনায়ক মহম্মদ আজহারউদ্দিন। পরে আজহার বলছিলেন, ‘‘সৌরভের জেদটা আমাকে খুব প্রভাবিত করেছিল। আমি নিশ্চিত, সফল না হয়ে ও ছাড়বে না।’ সাংবাদিক সম্মেলনের শেষে নতুন বোর্ড প্রেসিডেন্ট ডেকে আনলেন তাঁর পুরো টিমকে। আর সেখানে ভিড়ে হারিয়ে থাকা অংশুমান গায়কোয়াড়কে টেনে এনে সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন। গায়কোয়াড় ক্রিকেটার সংস্থার প্রতিনিধি হিসেবে বোর্ডে আসছেন। সঙ্গে থাকছেন শান্তা রঙ্গস্বামীও। কারও কারও মনে পড়ে গেল, ক্রিকেটার সৌরভের শুরুর দিনকার ভারতীয় দলের কোচ ছিলেন গায়কোয়াড়। সময় কত পাল্টে গিয়েছে যে, সৌরভই আজ সর্বময় নেতা। তাঁর খেলোয়াড় জীবনের কোচ, ক্যাপ্টেন সকলে তাঁর টিমের সারথি।
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় পার্ট টু। সিট বেল্ট বেঁধে রাখাই ভাল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy