পিকে-অমলের দ্বৈরথ নিয়ে এক সময় উত্তাল ছিল ময়দান।
ভারতীয় ফুটবলে পিকে বন্দ্যোপাধ্যায় ও অমল দত্ত বন্দিত দুই কোচ। একই সঙ্গে স্মরণীয় দুই কোচের ফুটবলমস্তিষ্কের লড়াই।
অমল দত্ত আগেই প্রয়াত হয়েছিলেন। শুক্রবার, কৃশানু দে-র মৃত্যুদিনে চলে গেলেন পিকেও। কিন্তু তাঁরা না থাকলেও ময়দানে থেকে গেল দুই কোচের অজস্র স্মৃতি।
পিকে-অমলের লড়াই খুব কাছ থেকে দেখা প্রাক্তন ফুটবলার সত্যজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের মতে, “দু’জনে একে অন্যের পরিপূরক। এঁদের সময় ফুটবল একটা অন্য উচ্চতায় উঠেছিল। আমি লড়াই শব্দটা বলতে চাইছি না। যুদ্ধও বলব না। এটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা বলব। যা কলকাতার ফুটবল, ভারতীয় ফুটবলকে অন্য মাত্রা দিয়েছে।”
পিকে-র প্রসঙ্গে আনন্দবাজার ডিজিটালকে সত্যজিৎ বললেন, “প্রদীপদা অসাধারণ এক ফুটবলার ছিলেন। আমার মনে হয়ে খেলোয়াড় প্রদীপদা অনেক এগিয়ে থাকবেন। যদিও অনেক দীর্ঘ সময় তিনি কোচিং করিয়েছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে ভাল ফুটবলার ও কোচ একইসঙ্গে খুব বেশি পাওয়া যায়নি। কয়েকজনই রয়েছেন। বড় নাম যদি বলতে হয়, তবে জাগালো, বেকেনবাওয়ারের নাম করতে হবে। এঁরা দুটো ভূমিকাতেই সফল। সাফল্যটাকে আমরা ধরি। কারণ, যে সফল হল না, তাঁকে ধরা যায় না, বড় বলা যায় না। দুটো দিক থেকেই প্রদীপদা ভারতীয় ফুটবলে মস্ত নাম। এত বড় কেউ নেই। দুই ভূমিকাতেই তিনি অনন্য। তাই পিকে ব্যানার্জির তুলনা তিনি নিজেই।”
আরও পড়ুন: নক্ষত্রপতন, চলে গেলেন পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়
আরও পড়ুন: বিশ্ববিদ্যালয় কর্মীর ভুলে বদলে গিয়েছিল নাম, ভারতীয় ফুটবলে জ্বেলেছিলেন প্রদীপ
পিকে-অমলের প্রতিদ্বন্দ্বিতার আঁচ কেমন ছিল? সত্যজিৎ বললেন, “এটা তো ৩০ বছর ধরে চলেছে। দু’জনের একে অন্যের প্রতি প্রচণ্ড শ্রদ্ধা ছিল। সেটা বাইরে থেকে বোঝা যেত না। সেটা অনুভব করতে হত। প্রদীপদা গান করছেন, অমলদা তবলা বাজাচ্ছেন, এগুলো তো সবারই দেখা। এক ট্রেনে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল দুই দলই চলেছি। তা প্রদীপদা-অমলদা দু’জনেই রয়েছেন। ফুটবলাররা একবার প্রদীপদার কাছে যাচ্ছে, আর একবার অমলদার কাছে যাচ্ছে। নানা গল্প করছে। তখন যে একে অন্যের বিরুদ্ধে বলাবলি হয়নি, তা বলব না। হয়েছে। প্রচুর বলাবলি নিশ্চয়ই হয়েছে। কিন্তু তার মধ্যেও প্রদীপদার কথায় ফুটবলের প্রতি ভালবাসা, আন্তরিকতা ফুটে উঠত। দু’জনেরই এক নম্বর টার্গেট ছিল ভারতীয় ফুটবলকে একনম্বরে নিয়ে যাওয়া।”
অমল দত্তকে নিয়ে একটা গল্প শোনালেন সত্যজিৎ। বললেন, “একবার আমরা মাদ্রাজ স্টেশনে বসে আছি। টিকিট পাচ্ছি না। অমলদা বললেন, চ, শুয়ে পড়ি। বললাম, স্টেশনে শুয়ে পড়ব? উনি বললেন, কেন, কত লোক শুয়ে রয়েছে, দেখছিস না। চল, ইট মাথায় দিয়ে শুয়ে পড়ি। অমলদা শুয়ে পড়লেন সেই ভাবেই। পাশে আরশোলা ঘুরছে। অমলদা নির্বিকার, বললেন, বাঘ এলে বলিস! অনেক বার হয়েছে, আমরা থ্রি টিয়ারের টিকিট পেয়েছি। চেঁচামেচি করছি, এ ভাবে যাব না। অমলদা বললেন, ওই দ্যাখ, প্ল্যাটফর্মে কত লোকে শুয়ে রয়েছে। আমরা তো তুলনায় অনেক ভাল জায়গা পেয়েছি, পালঙ্ক পয়েছি। চল তোরা!”
আর পিকের বোঝানো আবার অন্য ধরনের। সত্যজিতের স্মৃতিচারণ, “প্রদীপদাও সব সময় মানুষকে নিয়ে ভাবতেন। বলতেন, দ্যাখো, কত লোক খেতে পায় না বাবা, বুঝলে? তোমরা দেখো কত ভাল ভাল খাচ্ছো। দু’জনের মধ্যেই অসাধারণ ব্যাপার ছিল। মনুষ্যত্ব, মানবিকতা ছিল। ফুটবলার হিসেবে কী বিশাল মাপের, সেটা তো বলেইছি। নিজে কখনও খেলা দেখিনি। কিন্তু শুনেছি অনেক। কোচ হিসেবেও বিশাল। প্রদীপদা কখনও অহঙ্কার করেননি। আমি এত বড় প্লেয়ার ছিলাম, বলেননি। সেটাকে ভুলে গিয়ে প্রদীপদা কোচিং করিয়েছেন। সিনিয়র-জুনিয়র সবার সঙ্গে সমান ব্যবহার করেছেন। কে কী তা দেখতেন না। বরং যাঁরা চুপচাপ থাকত, তাঁদের গুরুত্ব দিতেন।”
যুগান্তের অবসান। সত্যজিতের গলায় ফুটে উঠল সেই বেদনাই।
আরও পড়ুন: ‘পিকে আর আমি বৃষ্টিতে প্র্যাকটিস করছিলাম, বাঘাদার হুঙ্কারে প্রায় পালিয়ে গেলাম’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy