রজার ফেডেরারের নিজেরই সবচেয়ে বেশি গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতার রেকর্ড ভেঙে আঠারো নম্বরটা অস্ট্রেলিয়ান ওপেন থেকে তোলার পর রবিবার সন্ধেয় আমার দু’টো বিশ্বাস তৈরি হল। রড লেভার-রয় এমার্সন-কেন রোজওয়ালদের যুগে একটু-আধটু গ্র্যান্ড স্ল্যাম খেলার সুবাদে আর পঞ্চাশ বছরের বেশি আন্তর্জাতিক টেনিসসমাজের সঙ্গে জড়িয়ে থাকার সুবাদে এই বিশ্বাস।
রজার ফেডেরার-ই সর্বকালের সেরা টেনিস প্লেয়ার। দ্য গ্রেটেস্ট।
ওর মতো কামব্যাক টেনিসে তো বটেই, সব খেলাধুলো মিলিয়ে হয়তো একটা কী দু’টো আছে। এখনই তুলনায় মনে আসছে, মহম্মদ আলির বিশ্ব হেভিওয়েট বক্সিংয়ে কামব্যাক।
এক তরুণ টেনিস প্লেয়ার দেড় দশকেরও বেশি ধরে গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিততে জিততে সাড়ে পঁয়ত্রিশের লোক হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন। স্পোর্টসে যে বয়সটা বুড়ো হয়ে যাওয়ার সামিল। এ দিনের আগে শেষ গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতেছে পাঁচ বছর আগে। তার পর নয়-নয় করে তিন বার ফাইনালে হোঁচট খাওয়ার যন্ত্রণা পেয়েছে। টেনিস বিশেষজ্ঞদের বেশির ভাগ (যাদের মধ্যে এই অধমও পড়ে) বলে বা লিখে দিয়েছিল, সতেরো টপকে আঠারো মেজর জেতা আর কোনও দিন হচ্ছে না। ঈশ্বরপ্রদত্ত ফিটনেস নিয়ে যে গর্ব ছিল সেটাতেও গত বছর আঘাত লাগে। হাঁটুতে অস্ত্রোপচার হয়। যার ধাক্কায় গত ছ’মাস পেশাদার ট্যুরের বাইরে। বাধ্য হয়ে চোদ্দো বছর পর হপম্যান কাপের মতো প্রদর্শনী টিম টেনিস খেলে কোর্টে ফিরতে হয়। গত দু’সপ্তাহের মেলবোর্ন পার্ক-ই ছিল লোকটার অপারেশনের পর প্রথম কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক টুর্নামেন্ট।
এ রকম একটা মারাত্মক প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে পঁয়ত্রিশ পেরনো একজন টেনিস প্লেয়ার গ্র্যান্ড স্ল্যামে প্রথম সপ্তাহ কাটিয়ে দ্বিতীয় সপ্তাহে এসে টানা তিনটে ফাইভ-সেটার জিতে চ্যাম্পিয়ন হচ্ছে! এ দিনের আগে ফেডেরারকে নিয়ে কেউ বায়োপিক তৈরির কথা ভেবে থাকলেও হয়তো এমন মহানাটকীয় চিত্রনাট্য থাকত না তাতে। কিন্তু এখন সেটাই ঘোর বাস্তব। যেমন বাস্তব ঐতিহাসিক ফাইনালের চূড়ান্ত মীমাংসা টিভি রিভিউ-তে হওয়াটা!
কোয়ার্টার ফাইনালে পাঁচ নম্বর বাছাই নিশিকোরি, সেমিফাইনালে চার নম্বর ওয়ারিঙ্কা আর ফাইনালে তো ফেডেরারের ২০১৭-র রড লেভার কোর্টে তৃতীয় পাঁচ সেটের শিকার ওর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রাফায়েল নাদাল-ই। ঘণ্টাচারেকের ম্যারাথন ম্যাচে ৬-৪, ৩-৬, ৬-১, ৩-৬, ৬-৩ জিতল রজার।
বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ের বিচারে ফাইনালে অ্যান্ডি মারে বা নোভাক জকোভিচকে হারালে ফেডেরারের মস্তানিটা আরও জবরদস্ত হতো হয়তো। কিন্তু আমার মতে রাফাকে হারিয়ে রজারের স্বপ্নের কামব্যাক যেন আইসিং অন দ্য কেক! যে যাই তুলনা টানুক, যতই স্ট্যাটিসটিক্স পেশ করুক, রাফা বনাম রজার রাইভ্যালরি সর্বকালের সেরা। চিরআবেগের টেনিস-যুদ্ধ।
এক ফ্রেমে ২৯ গ্র্যান্ড স্ল্যাম। রজার ফেডেরারকে অভিনন্দন রড লেভারের। ছবি: রয়টার্স
ফেডেরারের কেরিয়ারের স্বর্ণযুগের কোচ টনি রোচ আমার বহু দিনের বন্ধু। মাস দুই আগেও সল্টলেকে আমার অ্যাকাডেমিতে সপ্তাহখানেক কাটিয়ে গিয়েছে। রড লেভারের সঙ্গে এক বছরও হয়নি আমেরিকায় দিনকয়েক কাটানোর সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। দুই গ্রেট অস্ট্রেলিয়ান টেনিস প্লেয়ারের সঙ্গে আড্ডার সময় ফেডেরারের কথা উঠলে তাদেরও বক্তব্য ছিল, ফেডেরার এখন কোয়ার্টার ফাইনাল, বড়জোর সেমিফাইনালে উঠবে। এতটাই দুর্দান্ত ক্লাসের প্লেয়ার। কিন্তু এই বয়সে দু’সপ্তাহের টুর্নামেন্টের রগড়ানি সহ্য করে, বেস্ট অব ফাইভ সেট ম্যাচের চ্যালেঞ্জ সামলে আরও একটা গ্র্যান্ড স্ল্যাম চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্ট্যামিনা নেই ওর। ফিটনেসেও মার খাবে।
কিন্তু আমাদের সবাইকে বোকা বানিয়ে ঠিক উল্টোটাই মেলবোর্ন পার্কে এই চোদ্দো দিনে ঘটাল রজার। নিজে প্রাক্তন খেলোয়াড় হিসেবে আরও ভাল জানি, অনেক দিন টপ লেভেলে না খেললে প্লেয়ারের মনে একটা বাড়তি খিদে তৈরি হয়। রজার বা রাফার ভেতর যেটা এ বার অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে তৈরি হয়ে থাকলে অবাক হবো না। কিন্তু শুধু খিদের জোরে তো আর সব কিছু খেয়ে নেওয়া সম্ভব নয়! তোমার সেই হজম শক্তিও থাকতে হবে। এখানে হজম শক্তি বলতে প্লেয়ারের ফিটনেস, স্ট্যামিনা। যেটা পঁয়ত্রিশ পেরিয়েও, তা-ও হাঁটুর অপারেশনের পর একশো ভাগ দেখাল ফেডেরার। নাদালও লাগাতার চোটআঘাত থেকে সেরে উঠতে গত তিনমাস খুব কম খেলেছে। মেলবোর্নে ওর পারফরম্যান্সেরও প্রশংসা করতে হবে। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে, ফেডেরারের চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট নাদাল। ‘ওটি’ মানে ওভার থার্টি হলেও সেটা সবে হয়েছে।
সবচেয়ে বড় কথা, ম্যাচ প্র্যাকটিসের বিরাট অভাবকে যে ভাবে প্রথম টুর্নামেন্টেই উড়িয়ে দিয়ে ফেডেরার একেবারে গ্র্যান্ড স্ল্যাম চ্যাম্পিয়ন হল, সেটা অবিশ্বাস্য। চোট, অপারেশন থেকে তুমি ময়দানে ফিরে আসতে পার। ফেরার লড়াইয়ের প্রস্তুতির উপযুক্ত কোচিং টিম বানাতে পার। দিনের পর দিন কঠিন প্র্যাকটিস করতে পার। কিন্তু ম্যাচ প্র্যাকটিস হল ম্যাচ প্র্যাকটিস-ই। প্রস্তুতি ম্যাচ আর আসল ম্যাচের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত। ফেডেরার সেই চিরন্তন থিওরিকেও তো মিথ্যে করে দিল!
দু’জনেই নিজের কোচিং স্টাফে নতুন রক্ত আমদানি করে মেলবোর্নে এসেছিল। ফেডেরারের টিমে লুবিচিচ। টাকমাথার যে প্রাক্তন প্লেয়ার এক সময় সিঙ্গলসে বিশ্বে প্রথম দশে ছিল। খুব ভাল ব্যাকহ্যান্ড মারত। নাদালের টিমে তেমনই কার্লোস ময়া। যার সার্ভিস ছিল দুর্ধর্ষ। এ দিন তাই ফেডেরারের অসাধারণ সব ব্যাকহ্যান্ড রিটার্ন আর নাদালের আরও ভাল সার্ভ দেখে খুব একটা অবাক হইনি। প্রথম আর তৃতীয় সেটে তো ব্যাকহান্ডের দাপটে ফেডেরার উড়িয়ে দেয় নাদালকে। মাঝে দ্বিতীয় সেটে ওর হারের পিছনে খারাপ কিছু ফোরহ্যান্ড রিটার্ন। চতুর্থ সেট জিতে নাদাল ২-২ করলেও ফেডেরার খুব একটা কিন্তু খারাপ খেলেনি।
তার পর সেমিফাইনালের মতো ফাইনালেও এ দিন চূড়ান্ত সেট শুরুর আগে মেডিক্যাল টাইমআউট নিল ফেডেরার। লকাররুমে ফিরে গিয়ে। বছরখানেক আগেও ফিফথ্ সেটে ফেডেরারকে যেমন ক্লান্ত দেখাত, এ বার মেলবোর্নে ওকে সেটা না দেখানোর পিছনে হয়তো ঠিক এই সময়টায় ওর ফিজিওর ওকে কিছু স্পেশ্যাল ম্যাসেজ একটা কারণ। তবে টিভিতে তার পর যা দেখলাম, তাকেই বোধহয় মহাকাব্যিক টেনিস বলে! শেষ সেটের প্রথম সার্ভেই রজারকে ব্রেক করল রাফা। কিন্তু ৩-২-এ নাদালের সার্ভে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট জিতল ফেডেরার। আমার মতে ওটাই ফিফথ্ সেটের টার্নিং পয়েন্ট। ফাইনাল ম্যাচেরও। এতক্ষণ যে ফোরহ্যান্ড ফেডেরারকে ডোবাচ্ছিল, বেসলাইন থেকে সেই ফোরহ্যান্ড হাফভলিতে অনবদ্য একটা ডাউন দ্য লাইন শট মারল। যার কোনও জবাব ছিল না নাদালের মতো চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর কাছেও। রাফার সার্ভিসটাই শুধু ব্রেক হল না, ও মানসিক ভাবেও ব্রেক হয়ে গেল। নিটফল, তার পরে আরও টানা তিনটে সার্ভিস জিতে গেম, সেট অ্যান্ড ম্যাচ টু রজার ফেডেরার!
যার পর কোর্টেই গ্রেট চ্যাম্পিয়নের চোখে জল। আজ তো রড লেভার কোর্টে দাঁড়িয়ে রজারের কান্নারই দিন। স্বপ্নাতীত সাফল্য মানুষকে কাঁদায়ও!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy