Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
India

একরাশ যন্ত্রণা, লড়াইকে সম্বল করে রামমোহনের মৃত্যুভূমিতে স্নেহ রানার উত্থান

২৭ বছরের অলরাউন্ডারের ক্রিকেটীয় উত্থান এত সহজ ছিল না। ঝুলন গোস্বামী, হরমনপ্রীত কৌরদের মতো স্নেহকেও অনেক ঝড়ঝাপ্টা সহ্য করতে হয়।

উইকেট নেওয়ার পর স্নেহ রানার উল্লাস।

উইকেট নেওয়ার পর স্নেহ রানার উল্লাস। ছবি - টুইটার

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০২১ ১৩:৫১
Share: Save:

বুকে ছিল একরাশ যন্ত্রণা। পিতৃ বিয়োগের যন্ত্রণা। সেই কষ্টের বহিঃপ্রকাশ ঘটল ব্রিস্টলের বাইশ গজে। প্রথম ইনিংসে ১৩১ রানে ৪ উইকেট নেওয়ার পর ফলো অনের পর দ্বিতীয় ইনিংসে ম্যাচ বাঁচানো ৮০ রানে অপরাজিত থেকে ভারতকে হার থেকে বাঁচালেন। একেবারে রাজকীয় টেস্ট অভিষেক। এমন কীর্তির জন্য দেহরাদুনের স্নেহ রানার নামটা সবাই জেনে ফেলেছেন। তবে আনন্দবাজার অনলাইন অন্য এক স্নেহ খুঁজে বের করার চেষ্টা করল। এমন একটি মেয়ে যার জীবনে স্বজন হারানোর যন্ত্রণার সঙ্গে রয়েছে প্রতি পদক্ষেপে শুধু লড়াই আর লড়াই।

২৭ বছরের অলরাউন্ডারের ক্রিকেটীয় উত্থান এত সহজ ছিল না। ঝুলন গোস্বামী, হরমনপ্রীত কৌরদের মতো স্নেহকেও অনেক ঝড়ঝাপ্টা সহ্য করতে হয়। বাবা ভগবান সিংহ রানা এলাকার দাপুটে রাজনীতিবিদ ছিলেন। এহেন ভগবান সিংহ কিন্তু শুরুর দিকে স্নেহর ক্রিকেট প্রেমকে ভাল চোখে দেখেননি। তাই তো মধ্যবিত্ত পরিবারে আর্থিক কষ্ট না থাকলেও ব্যাট, প্যাড কেনার জন্য সাহায্য পাননি। যদিও তাঁকে আটকে রাখতে পারেননি দুই মাস আগে প্রয়াত হওয়া ভগবান সিংহ।

মেয়ে হয়ে জন্মালেও এলাকা ও এলাকার বাইরে ছেলেদের সঙ্গে খেলতে পছন্দ করতেন স্নেহ। তখন ওঁর বয়স বড়জোর ১২ কি ১৩। সবার মতো টেনিস বল দিয়ে শুরু হল হাতেখড়ি। ব্যাট-বলে দাপট দেখানোর জন্য কয়েক মাসের মধ্যেই দেহরাদুনের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। শুরু হল টেনিস বলে ‘খেপ’ খেলা। বাবা-মা’র বকাঝকা হজম করেও একের পর এক রাতে টেনিস বলের প্রতিযোগিতা খেলতে লাগলেন স্নেহ। কিন্তু ওঁর আশ মিটছিল না। কম বয়সেই বুঝে গিয়েছিলেন টেনিস বলে খেলে এলাকায় পরিচিত পেলেও সেটা যথেষ্ট নয়।

মিতালি রাজের হাত থেকে 'টেস্ট ক্যাপ' নেওয়ার সেই মুহূর্ত। ছবি - টুইটার।

মিতালি রাজের হাত থেকে 'টেস্ট ক্যাপ' নেওয়ার সেই মুহূর্ত। ছবি - টুইটার।

কপালও সঙ্গ দিল। টেনিস বলে ওঁকে খেলতে দেখে দেহরাদুনের ‘লিটল মাস্টার ক্রিকেট অ্যাকাডেমি’তেও সুযোগ দেওয়া হল। প্রশিক্ষক কিরণ শাহের কাছে শুরু হল ডিউস বলে ক্রিকেট পাঠ। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে সেখানেও সবাইকে ছাপিয়ে গেলেন স্নেহ। তখন ওঁর বয়স মাত্র ১৪। সেই সময় উত্তরাখণ্ডের কোনও ক্রিকেট সংস্থা ছিল না। কিন্তু প্রথম প্রশিক্ষক কিরণ শাহ তাঁর ছাত্রীকে আটকে রাখতে রাজি নন। তাই স্নেহকে পাশের রাজ্য হরিয়ানাতে পাঠিয়ে দেওয়া হল।

কেমন ছিল সেই দিনগুলো? আনন্দবাজার অনলাইনকে টেলিফোনে কিরণ শাহ বলছিলেন, “একদিকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করার জন্য ওকে পরিবার থেকে চাপ দেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে হরিয়ানার রাজ্য মহিলা দলের ক্যাম্পে চলছে তীব্র স্বজনপোষণ। অন্য রাজ্য থেকে আসার জন্য হরিয়ানার কয়েক জন ওকে পাত্তা দিত না। মেয়েটা হস্টেলের ঘরে বসে শুধু কান্নাকাটি করত। তবে খুব বেশিদিন ওকে সেখানে কাঁদতে হয়নি। আমার এক আত্মীয় পঞ্জাবের অমৃতসরের বিবিকে ডিএভি কলেজে ক্রীড়া প্রশিক্ষক ছিল। ওঁর সৌজন্যে সেই কলেজের মহিলা দলে অনুশীলন করার সুযোগ পেয়েছিল স্নেহ। তারপর আর ওকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।”

সাফল্যের পুরস্কার। ছাত্রীকে মিষ্টিমুখ করিয়ে দিচ্ছেন ছোটবেলার প্রশিক্ষক কিরণ শাহ। পারিবারিক অ্যালবাম থেকে।

সাফল্যের পুরস্কার। ছাত্রীকে মিষ্টিমুখ করিয়ে দিচ্ছেন ছোটবেলার প্রশিক্ষক কিরণ শাহ। পারিবারিক অ্যালবাম থেকে।

ক্রিকেটের জন্য জীবনের সবকিছু ত্যাগ করা যায়। সহ্য করা যায় ভুখা পেটে থাকা। উপেক্ষা করা যায় হস্টেল জীবনে র‍্যাগিংয়ের যন্ত্রণা। তবে শুধু নিজের নিজের সুখ নয়, পরিবারের কথাও ভেবেছিলেন ব্রিস্টলের নায়িকা। অমৃতসরের কলেজে ক্রিকেট পাঠ চললেও লেখাপড়া করতেন দেহরাদুনে। ফলে দুই শহরে অনবরত যাতায়াত করতে হতো। তবে উচ্চ মাধ্যমিকে পাশ করার পর পাকাপাকি ভাবে পঞ্জাবেই চলে আসেন স্নেহ। ওঁর মা বিমলা রানা ফোনে বলছিলেন, “ছোটবেলা থেকেই আমার বড় মেয়েটা বড্ড ডাকাবুকো স্বভাবের। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য অনেক কষ্ট করেছে। সেটা বোঝার পর ওর বাবা ক্রিকেট খেলাকে মেনে নিয়েছিল। কিন্তু সেই সময় স্নেহর একটা ব্যাপার নিয়ে খুব চিন্তা করতাম। মেয়েটা ভীষণ আবেগ প্রবণ। অল্প বকা দিলেই কেঁদে ভাসিয়ে দিত। তবে এখন আর চিন্তা হয় না।”

পঞ্জাবের রাজ্য দলের হয়ে খেলে কয়েক দিনের মধ্যেই জাত চিনিয়েছিলেন স্নেহ। মাত্র ২১ বছর বয়সে ২০১৫ সালে এল ভারতীয় রেলওয়ে দলে সুযোগ। জাতীয় দলে মিতালি রাজের অধিনায়কত্বে খেললেও রেল দলে কিন্তু শুরু থেকে শেষ কথা স্নেহ। তাঁর অধিনায়কত্বে পরপর তিন বছর সিনিয়র মহিলাদের একদিনের প্রতিযোগিতা জিতেছে রেলওয়েজ।

ব্যাট হাতে ভারতকে বাঁচাচ্ছেন স্নেহ। ছবি - টুইটার।

ব্যাট হাতে ভারতকে বাঁচাচ্ছেন স্নেহ। ছবি - টুইটার।

রেলে সুযোগ পাওয়ার আগেই জাতীয় দলের জার্সি গায়ে চাপানোর সুযোগ চলে আসে। ২০১৪ সালে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে একদিনের ও টি-টোয়েন্টি দলে তাঁর অভিষেক ঘটে। কিন্তু ফের তাঁর জীবনে নেমে আসে অন্ধকারের ছায়া। ঘরোয়া ক্রিকেট খেলার সময় লিগামেন্টের চোট বড় আকার ধারণ করে। মাঠের বাইরে ছিটকে যান এই অলরাউন্ডার। স্বভাবতই বাকিদের থেকে অনেকটাই পিছিয়েও পড়েন। তবে হাল ছাড়েননি ইয়ান বোথামের অন্ধ ভক্ত। ঘরোয়া ক্রিকেটে ফের একবার দাপট দেখানোর আগে ফের দেরহাদুনে চলে যান স্নেহ। সেখানে গিয়ে বাংলার অধিনায়ক অভিমন্যু ইশ্বরণের বাবা আর পি ইশ্বরণের আক্যাডেমিতে ফের লড়াই শুরু করলেন। সেই আর পি ইশ্বরণের প্রতিক্রিয়া, “আমাদের অ্যাকাদেমিতে ভারতের অনেক প্রথম সারির ক্রিকেটার অনুশীলন করেছে। তবে স্নেহ সবার থেকে আলাদা। বিসিসিআই গত কয়েক বছরে মহিলা ক্রিকেটের জন্য অনেক পদক্ষেপ নিলেও আন্তর্জাতিক স্তরে আমরা এখনও অনেক পিছিয়ে আছি। এগিয়ে যেতে হলে স্নেহর মতো লড়াকু মানসিকতার মেয়ের খুব দরকার।”

চোট সারিয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে ফেরা হল। সেখানে নজর কেড়ে দীর্ঘ পাঁচ বছর পরে ফিরলেন জাতীয় দলে। সুখের হল সেই প্রত্যাবর্তন। দেরিতে হলেও বিশ্ব ক্রিকেটে নিজের অস্তিত্বের কথা জানালেন স্নেহ। তবুও একটা যন্ত্রণা কাঁটার মতো ওঁর এবং মা বিমলা দেবীর বুকে এখনও বিঁধে আছে। পিতৃ বিয়োগের যন্ত্রণা। রত্নগর্ভা মা-র প্রতিক্রিয়া, “ওর বাবা শুরুতে আপত্তি করলেও মেয়ের ক্রিকেট প্রেম দেখে আর আটকে রাখেনি। অথচ সেই লোকটা মেয়ের টেস্ট অভিষেক দেখে যেতে পারল না। টেস্ট অভিষেক তো অনেক দূরের কথা। টেস্ট দলে সুযোগ পাওয়ার দুই সপ্তাহ আগে ওর বাবা চলে যায়। সেই আক্ষেপ কোনও দিন মিটবে না।”

১৮৩৩ সালের ২৭সেপ্টেম্বর। সতীদাহ প্রথার বিলোপ ঘটানো রাজা রামমোহন রায় এই ব্রিস্টলেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। সেই ব্রিস্টলের বাইশ গজে যেন আগুন ঝরালেন দেরহাদুনের পাহাড় থেকে আসা স্নেহ। অভিষেক টেস্টে ব্যাট-বলের সঙ্গে ছিল আরও দুটো অস্ত্র। একরাশ যন্ত্রণা ও লড়াই করার মানসিকতা।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy