শাসন: কর্নাটকের আরও এক উইকেট পতন। উল্লাস বাংলা দলের। নিজস্ব চিত্র
তিরিশ বছর আগে এই মার্চ মাসেই ইডেনের বুকে আমরা রঞ্জি ট্রফি হাতে তুলে নিয়েছিলাম। যে বার আমরা চ্যাম্পিয়ন হই, তার আগের বছরও ফাইনালে উঠেছিলাম। সে বারও আমাদের প্রতিপক্ষ ছিল দিল্লি। মনে আছে, সেই ম্যাচটা শুরু হয়েছিল একটা দোলের দিনে। এ বারও রঞ্জি ফাইনাল শুরু হবে আর একটা দোলে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, এ বার চ্যাম্পিয়ন হয়েই ফিরবে বাংলার ছেলেরা।
২৩ মার্চ, ১৯৯০। ওই দিন ইডেনে টস করতে নেমেছিলাম আমি। কিন্তু আমাদের ‘ফাইনাল ম্যাচ’ শুরু হয়ে গিয়েছিল টসের অনেক আগে থেকেই। ফাইনালের আগের দিন আমাদের কোনও প্র্যাক্টিস ছিল না। আমি গিয়েছিলাম পিচ দেখতে। মাঠেই দেখা হয়ে যায় দিল্লির অধিনায়ক কীর্তি আজাদের সঙ্গে। কীর্তিকে আমি বলেছিলাম, ‘এ বার তৈরি থেকো। তোমাদের তিনশো গুণ ফিরিয়ে দেব।’ কথাটা বলার একটা কারণ ছিল। আগের বছর আমাদের ফাইনাল খেলতে হয়েছিল ফিরোজ শা কোটলায়। ঘরের মাঠে পেয়ে আমাদের মারাত্মক স্লেজ করেছিল দিল্লির ক্রিকেটারেরা। ইডেনে আমরা তার জবাব দিয়েছিলাম। ওই সময় দিল্লিতে অন্তত ছ’জন ভারতের জাতীয় দলের ক্রিকেটার ছিল। কীর্তি নিজে। মনোজ প্রভাকর, রমন লাম্বা, মনিন্দর সিংহ, অতুল ওয়াসন, সঞ্জীব শর্মা। কিন্তু আমরা পাত্তা দিইনি। আমাদের স্লোগান ছিল, ‘আই ক্যান ডু ইট, উই ক্যান ডু ইট, উই উইল ডু ইট।’ আমি পারি, আমরা পারি, আমরা পেরে দেখাব। আমরা সত্যিই পেরে দেখিয়েছিলাম।
এই বাংলা দলটার মধ্যে সেই জেদ, সেই আগ্রাসন, সেই নাছোড় মনোভাবটা দেখতে পাচ্ছি। বিপক্ষে কে আছে, তা নিয়ে মাথাই ঘামাচ্ছে না। কর্নাটকের ব্যাটিং সম্ভবত এই মুহূর্তে ভারত সেরা। করুণ নায়ার, মণীশ পাণ্ডে, কে এল রাহুল। কিন্তু সেই ব্যাটিংকেও কী ভাবে উড়িয়ে দিল বাংলার পেসাররা। নাম নিয়ে ভাবি না, মাঠেই দেখে নেব বিপক্ষকে— এই মনোভাবটা কোচ অরুণ লাল ঢুকিয়ে দিয়েছে দলের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ক্রিকেট অনেকটাই মানসিকতার খেলা। আর বাংলা কিন্তু মানসিকতার দিক দিয়ে যে কোনও দলের চেয়ে এগিয়েই শুরু করবে। তা সে প্রতিপক্ষ গুজরাতই হোক কি সৌরাষ্ট্র।
বাংলার এই সাড়া জাগানো উত্থানের পিছনে কিন্তু সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের মস্তিষ্কও রয়েছে। বছর খানেক আগে থেকে সেরা এগারোটা ক্লাব দল নিয়ে ঘাসের উইকেটে, স্পোর্টিং উইকেটে, বড় মাঠে খেলা চালু করে সৌরভ। যেখান থেকে কিন্তু এই পেসাররা উঠে এসেছে। বাংলার রিজার্ভ বেঞ্চ দারুণ শক্তিশালী হয়েছে। অশোক ডিন্ডার অভাবটা বুঝতে দিচ্ছে না আকাশ দীপ, মুকেশ কুমাররা। ধন্যবাদ দিতে হবে উৎপল চট্টোপাধ্যায়, রণদেব বসুর মতো সাপোর্ট স্টাফকেও। উৎপলের হাতে পড়ে শাহবাজ আহমেদের বোলিং অনেক উন্নত হয়েছে। মুকেশদের ধারালো করার পিছনে রণর হাতও রয়েছে। সেমিফাইনালের আগে সিএবি প্রেসিডেন্ট অভিষেক ডালমিয়া যে ভাবে দর্শকদের জন্য ইডেন খুলে দিয়েছিল, তার কথাও ভুললে চলবে না। ঘরের মাঠের দর্শক সমর্থন কিন্তু একটা বড় ব্যাপার। ১৯৯০ সালের রঞ্জি ফাইনালে আমাদের উৎসাহ দিতে ইডেনে ৪০-৫০ হাজার লোক আসত। এখন সংখ্যাটা কম হলেও প্রভাব একটা থাকেই।
ফাইনালে বাংলার সামনে যদি সৌরাষ্ট্র পড়ে, তা হলে চেতেশ্বর পুজারা সম্ভবত খেলবে। কিন্তু তাতে বাংলা চিন্তায় পড়বে বলে মনে হয় না। ঈশান পোড়েল, মুকেশ কুমার, আকাশ দীপরা এখন বিশ্বাস করে, যে কোনও ব্যাটসম্যানকে প্যাভিলিয়নে ফেরাতে পারে ওরা। অরুণ ওদের মধ্যে এই বিশ্বাসটা এনে দিয়েছে।
বাংলার ভয়ঙ্কর পেস ত্রয়ীর কথা এখন সবাই জেনে গিয়েছে। তাই আমি নিশ্চিত, গুজরাত হোক কি সৌরাষ্ট্র— ঘরের মাঠে ব্যাটিং পিচই বানাবে ওরা। ওই রকম পিচে বল করার জন্য পেসারদের একটু ধৈর্য ধরতে হবে আর লাইন-লেংথটা নিখুঁত রাখতে হবে। বাংলার একটাই চিন্তা। প্রথম দিকের ব্যাটসম্যানদের রান না পাওয়া। শেষ তিন-চারটে ইনিংসের ছবিটা একই। ৫০-৬০ রানের মধ্যে ছয় উইকেট পড়ে যাচ্ছে, তার পরে অনুষ্টুপ মজুমদার আর শাহবাজ মিলে হাল ধরছে। ইডেনে আমি ঘরোয়া ক্রিকেটের অনেক নামী, দামি ব্যাটসম্যানের ইনিংস দেখেছি। কর্নাটকের বিরুদ্ধে অনুষ্টুপের সেঞ্চুরিটা বিনা দ্বিধায় অন্যতম সেরার তালিকাতে রাখব। কিন্তু মনে রাখতে হবে, রোজ একই জিনিস ঘটা সম্ভব নয়। বাংলার শুরুর দিকের ব্যাটসম্যানদের রান করতে হবে। ফাইনালে অবশ্য ঋদ্ধিমান সাহাকে পাচ্ছে বাংলা। তাতে নিশ্চিত ভাবে ব্যাটিং শক্তি বাড়বে দলের।
আগেই বলেছি, দিল্লির বিরুদ্ধে আমাদের ‘ম্যাচ’টা শুরু হয়ে গিয়েছিল টসের আগে থেকেই। ম্যাচের আগে শ্রদ্ধেয় প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে ড্রেসিংরুমে ডেকে এনেছিলাম। পিকে-র সেই বিখ্যাত ‘ভোকাল টনিক’ দলের ক্রিকেটারদের তাতিয়ে দিয়েছিল। আমাদের সময় দলে সৌরভ (অভিষেক ম্যাচ), শরদিন্দু মুখোপাধ্যায়রা ছাড়া সবাই মোটামুটি অভিজ্ঞ ছিল। এই দলটায় কিন্তু মনোজ, অনুষ্টুপ, শ্রীবৎস ছাড়া আর সবাই মোটামুটি তরুণ। তারুণ্যের জোশ বলে একটা কথা আছে না? সেই জোশ কিন্তু বাংলার কাজে আসবে। আর ভোকাল টনিক দেওয়ার লোক অরুণের চেয়ে ভাল কে আছে? টসের অনেক আগে থেকেই অরুণের ‘ম্যাচ’ শুরু হয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস। একটা দোল আমার জীবনে এখনও রংহীন হয়ে আছে। বিশ্বাস করি, এ বারের দোল বাংলা ক্রিকেটকে রঙিন করে তুলবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy