Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

বিশেষ ট্রেনিংয়েই সিন্ধুর বিশ্বজয়ের বাজিমাত

এই প্রাপ্তির পিছনে কতটা পরিশ্রম লুকিয়ে আছে, তা হয়তো অনেকেরই অজানা। বাসেলে পা রাখার আগে টেকনিক থেকে শুরু করে খেলার ধরন, সমস্ত কিছুতে আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ খেলতে আসেন ২৪ বছর বয়সি তারকা। সেই কসরতের ফলই রবিবার বাসেলে পেলেন সিন্ধু।

প্রস্তুতি: কঠোর অনুশীলনের পরে আইসবাথ নিতেন সিন্ধু। নিজস্ব চিত্র

প্রস্তুতি: কঠোর অনুশীলনের পরে আইসবাথ নিতেন সিন্ধু। নিজস্ব চিত্র

এন জগন্নাথ দাস
হায়দরাবাদ শেষ আপডেট: ২৬ অগস্ট ২০১৯ ০৩:১৩
Share: Save:

শেষ স্ম্যাশটি করার পরে আকাশের দিকে তাকিয়ে দু’হাত তুলে তাকালেন পুসারলা বেঙ্কট সিন্ধু। তাঁর সঙ্গেই উঠে দাঁড়াল গ্যালারি উপচে পড়া দর্শকদের ভিড়। নতুন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নকে স্বাগত জানাতে। কিন্তু এই প্রাপ্তির পিছনে কতটা পরিশ্রম লুকিয়ে আছে, তা হয়তো অনেকেরই অজানা। বাসেলে পা রাখার আগে টেকনিক থেকে শুরু করে খেলার ধরন, সমস্ত কিছুতে আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ খেলতে আসেন ২৪ বছর বয়সি তারকা। সেই কসরতের ফলই রবিবার বাসেলে পেলেন সিন্ধু।

সুইৎজ়ারল্যান্ডে পা রাখার কয়েক সপ্তাহ আগেই সিন্ধু বলেছিলেন, ‘‘রুপোগুলোকে সোনায় পরিণত করার সময় হয়ে গিয়েছে।’’ এ দিন প্রথম ভারতীয় হিসেবে ব্যাডমিন্টন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে ইতিহাস গড়লেন তিনি। প্রতিযোগিতার তৃতীয় বাছাই জাপানের নজ়োমি ওকুহারাকে ২১-৭, ২১-৭ ফলে উড়িয়ে দিলেন ভারতীয় তারকা। ব্যাডমিন্টন মেজরের ফাইনালে অন্যতম বড় ব্যবধানে জয়ের রেকর্ডেও নাম তুললেন সিন্ধু। ম্যাচ শেষে আবেগপ্রবণ সিন্ধু বলে দিলেন, ‘‘ভারতীয় হিসেবে আমি গর্বিত।’’ সিন্ধুর এই প্রাপ্তির পরে গোটা ভারতও যেন গেয়ে উঠল, ‘দিল হ্যায় সিন্ধুস্তানি।’

কিন্তু এই প্রাপ্তির পিছনে অনেক কঠিন লড়াই লুকিয়ে রয়েছে। তাঁর ব্যক্তিগত কোচ প্রাক্তন ব্যাডমিন্টন তারকা পুল্লেলা গোপীচন্দ হলেও বাসেলে আসার আগে তিনি ট্রেনিং করেন প্রদীপ রাজুর কাছে। গাচ্চিবৌলিতে গোপীর অ্যাকাডেমিতে দীর্ঘক্ষণ ট্রেনিং করার পরে তিনি ছুটতেন প্রদীপ রাজুর কাছে। তার কারণ, বার বার ফাইনালে হারের ধারা তিন আটকাতে মরিয়া ছিলেন। ট্রফির স্বপ্ন অধরা যাতে না থাকে তার জন্য ভিতরে ভিতরে শপথ নিয়েছিলেন। প্রায় ষাট কিলোমিটার যাত্রা করতে হত গাচ্চিবৌলি থেকে কোম্পালির সুচিত্রা অ্যাকাডেমি পর্যন্ত। এমনই ঠাসা সূচি মেনে চলতে হত যে, যাত্রাপথেই খাবারের অর্ডার করে দিতেন সিন্ধু। ট্রফির খিদে মেটানোটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাঁর কাছে।

বাবা পিভি রামানা জানতেন, তাঁর মেয়ের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দক্ষতা রয়েছে। কিন্তু কেন বারবার ফাইনালে সেই যাত্রা শেষ হয়ে যাচ্ছে তা জিজ্ঞাসা করেন প্রদীপের কাছে। সুচিত্রা অ্যাকাডেমির এই কোচ মন দিয়ে সিন্ধুর খেলা লক্ষ্য করে গিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘সিন্ধুর আগের ভিডিয়োর সঙ্গে ওর বর্তমান খেলা মিলিয়ে দেখলাম। লক্ষ্য করলাম, যার আগ্রাসী ভঙ্গিতে খেলাই ছিল অস্ত্র, সে র‌্যালির মাধ্যমে খেলার চেষ্টা করছে। বাসেলে আসার আগে শেষ দু’মাস ওর সঙ্গে কাজ করি। সব চেয়ে বেশি নজর দেওয়া হয় ওর ফিটনেসে।’’

প্রদীপ সঙ্গে যোগ করেন, ‘‘অতিরিক্ত প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার পরে শরীর ক্লান্ত হয়ে যায়। সিন্ধুও একই সমস্যায় ভুগছিল। তখন চাইনিজ কাপিং পদ্ধতির মাধ্যমে ওর পেশির ক্লান্তি কমানোর চেষ্টা করি।’’ চাইনিজ কাপিং পদ্ধতি যে কোনও অ্যাথলিট ব্যবহার করতে পারেন। কাপের আকারের মতো কয়েকটি বাল্ব শরীরের ক্লান্ত পেশির উপরে বসানো হয়। তা পেশি ফুলিয়ে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। পেশি ফুলেও ওঠে। তা আবার স্বাভাবিক জায়গায় আনার জন্য আইসবাথ অথবা ঠান্ডা জলে শরীর ডুবিয়ে রাখতে হয়। এই পদ্ধতিতেই পেশির ক্লান্তি কমানো হত সিন্ধুর। প্রদীপ বলছিলেন, ‘‘লক্ষ্য করে দেখবেন, বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল পর্যন্ত দেখে মনে হয়েছে সিন্ধুই প্রতিযোগিতার সব চেয়ে ফিট খেলোয়াড়। এ ছাড়াও কয়েকটি টেকনিক্যাল পরিবর্তনের জন্য কোর্টের চারপাশে অনেক দ্রুত পৌঁছে যাচ্ছিল ও। সেটাই ওকে আগ্রাসী করে তোলে।’’

সিন্ধুর বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ খেতাব জেতার দিন ভারতীয়দের কাছে আরও বিশেষ হয়ে ওঠে যখন শেষে তিনি বলেন,‘‘আজ আমার মায়ের জন্মদিন। এই খেতাব আমি মাকে উৎসর্গ করতে চাই। মা, শুভ জন্মদিন। তোমাকে খুব ভালবাসি।’’ তা বলার সময় চোখ থেকে জল বেরিয়ে যায় ভারতীয় তারকার। জল বেরোবে নাই বা কেন, ২০১৭ ও ২০১৮ ব্যাডমিন্টন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে দুরন্ত খেলেও ফাইনালে হার। ২০১৬ রিয়ো অলিম্পিক্সেও ফাইনাল জেতা হয়নি তাঁর। কিন্তু এ বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ তিনি হারতে আসেননি। কোয়ার্টার ফাইনালে হারিয়েছেন চিনা তাইপের তাই জু ইংকে, সেমিফাইনালে তাঁর প্রতিপক্ষ ছিলেন জাপানের চেন উফেই। তিনিও দাঁড়াতে পারেননি সিন্ধু আগ্রাসী টেকনিকের কাছে।

সিন্ধুর এই প্রাপ্তির পিছনে অনেক বড় অবদান রয়েছে তাঁর বাবা রামানার। সব সময় মেয়ের দক্ষতার প্রতি তাঁর আস্থা ছিল। কখনও বিশ্বাস হারাননি। ম্যাচ শেষে রামানা বলেন, ‘‘সব সময় বিশ্বাস করেছি ওর মধ্যে বিশ্বজয় করার ক্ষমতা রয়েছে। আজ ওর জন্য আমি গর্বিত। শেষ স্ম্যাশটি করার পরে চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি। অজান্তেই কেঁদে ফেলি।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘শেষ দু’বার সোনা হাতছাড়া হওয়ার পরে আমি ভেঙে পড়েছিলাম। ও নিজেও খুব কষ্ট পেয়েছিল। এ বার সেই স্বপ্নপূরণ হল।’’

সিন্ধুর ব্যক্তিগত কোচ কোর্টের পাশেই বসে ছাত্রীকে বিশ্বজয় করতে দেখলেন। প্রকাশ পাড়ুকোনের পরে তিনিই একমাত্র ভারতীয় হিসেবে অল ইংল্যান্ড জিতেছিলেন। দীর্ঘ খরা কাটিয়ে বিশ্ব মঞ্চে সেরা হলেন এমন এক জন, যিনি তাঁরই হাতে গড়া। গোপীচন্দ সব সময়েই বিশ্বাস করতেন, বিশ্বজয় করার জন্য যা যা প্রয়োজন তার প্রত্যেকটি গুণ সিন্ধুর মধ্যে রয়েছে। গতি, শক্তি, দক্ষতা এবং হার-না-মানা মানসিকতা সব সময়েই তাঁর মধ্যে ছিল। প্রাক্তন জাতীয় কোচ এসএম আরিফ ২০১৩-তে সিন্ধুকে দেখেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ‘‘এই মেয়ে একদিন বিশ্বসেরা হবে।’’ রবিবার যোগাযোগ করতেই মজা করে বলে উঠলেন, ‘‘আমার ভবিষ্যদ্বাণী তা হলে সত্যি হল। ও এল, প্রাণ খুলে খেলল এবং ওকুহারাকে ধ্বংস করে দিয়ে বেরিয়ে গেল। অন্য দিক থেকে ওকুহারা দর্শকের মতো তাকিয়ে ছিল সিন্ধুর দিকে। হয়তো অবাক হয়ে গিয়েছিল ওর দাপট দেখে। কোনও খেই খুঁজে পাচ্ছিল না জাপানি তারকা। সিন্ধুর স্ম্যাশ, অ্যাক্রস দ্য কোর্ট ড্রপ-শট, নেট প্লে-র সঙ্গে মানিয়ে ওঠার আগেই ম্যাচটি হেরে গিয়েছে ওকুহারা।’’

ম্যাচের শুরু থেকেই একতরফা এগিয়ে ছিলেন সিন্ধু। আট মিনিটের মধ্যেই প্রথম সেটে ১১-২ এগিয়ে যান। সেখানেই হয়তো মানসিক ভাবে বিধ্সব্ত হয়ে পড়েন ওকুহারা। জাপানি তারকা ভারতীয় কন্যার আক্রমণের ঘেরাটোপ থেকে আর বেরোতে পারেননি। ‘পাওয়ার-ব্যাডমিন্টনের’ যথার্থ উদাহরণ দিয়ে ইতিহাস গড়লেন ভারতীয় তারকা।

সিন্ধু যখন বার বার ফাইনালে এসে হারছিলেন, অনেকে তকমা সেঁটে দিয়েছিল ‘চোকার্স’। বাসেলে বিশ্বজয় হয়তো সমালোচকদের মুখেও কুলুপ এঁটে দিয়ে গেল। আজ সত্যিই ‘দিল হ্যায় সিন্ধুস্থানি’।


(লেখক ‘তেলঙ্গনা টুডে’-র ডেপুটি এডিটর এবং হায়দরাবাদের নামী ক্রীড়া সাংবাদিক)

অন্য বিষয়গুলি:

P V Sindhu Badminton BWF Nozomi Okuhara
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy