অনবদ্য: রবিবার প্যারিসে প্রথম রাউন্ডের ম্যাচে পরিচিত সিন্ধু। ছবি: পিটিআই।
পোর্ত দে লা শ্যাপেল এরিনা শনিবার ফরাসি গর্জনে ভরে গিয়েছিল। রবিবার তার দখল নিয়ে নিলেন ভারতীয়রা। এমন একজনের নামে তাঁরা জয়ধ্বনি তুললেন, যিনি এক অনন্য কীর্তির সামনে। ভারতের অলিম্পিক্স ইতিহাসে আজ পর্যন্ত কোনও মেয়ে তিন, তিনবার পদক জেতেননি। পি ভি সিন্ধু সেই দুর্লভ হ্যাটট্রিকের সামনে দাঁড়িয়ে।
রবিবার ভারতীয় অলিম্পিক্স দলের নায়িকা নিশ্চয়ই মনু ভাকের। প্যারিসে দেশকে প্রথম পদক দিলেন মনু। একই দিনে আর এক ভারতীয় কন্যা তাঁর তৃতীয় পদক আনার অভিযান শুরু করলেন। মলদ্বীপের ফতিমথ নবাহা আব্দুল রজ্জাককে উড়িয়ে দিলেন ২১-৯, ২১-৬ ফলে। মাত্র ২৯ মিনিট নিলেন ম্যাচ শেষ করতে। প্রথম গেম জিতলেন মাত্র ১৩ মিনিটে! ফতিমথ র্যাঙ্কিংয়ে ১১১ নম্বর। এর পরে তাঁর সামনে বিশ্বের ৭৫ নম্বর এস্টোনিয়ার ক্রিস্টিন কুবো। শুরুতে সুবিধাজনক ড্র পেয়েছেন? সিন্ধুর জবাব, ‘‘হতে পারে। কিন্তু হাল্কা ভাবে কাউকে নিচ্ছি না। সবাই এখানে জিততে আসে।’’
প্রথম ম্যাচে প্রতিপক্ষের র্যাঙ্কিং দিয়ে সব কিছু বিচার করতে যাওয়া ভুল হবে। মাথায় রাখতে হবে, হারিয়ে যাওয়া সেই সিন্ধু সভ্যতার খোঁজ চলছে। র্যাঙ্কিংয়ে প্রথম দশের নীচে নেমে গিয়েছেন তিনি। যাঁর লাফিয়ে ওঠা স্ম্যাশ, যা সার্কিটে জনপ্রিয় ‘জাম্পিং স্ম্যাশ’ হিসেবে, তা প্রায় বিলুপ্ত হতে বসেছিল। যার প্রভাব পড়েছে ফলাফলে। দু’বছর আগে কমনওয়েলথে সোনা জেতার পর থেকে বড় কোনও সাফল্য নেই।
হায়দরাবাদে গোপীচন্দের আশ্রম ছেড়ে প্রকাশ পাড়ুকোনের বেঙ্গালুরু স্কুলে যোগ দিয়েছেন। তাতে কতটা লাভ হল, প্যারিসেই প্রমাণ হয়ে যাবে। তবে প্রথম ম্যাচে পুরনো সিন্ধুর ঝলক যে দেখা গিয়েছে, তা নিশ্চয়ই আশাবাদী করে তুলবে দেশের ক্রীড়ামহলকে।
পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চি উচ্চতার সেই আগ্রাসনকেই বিশ্বের সেরা প্রতিপক্ষরা ভয় পেত। পদকের হ্যাটট্রিকের স্বপ্নপূরণ ঘটাতে গেলে সেই আক্রমণাত্মক সিন্ধুকে ফিরতে হবে। শোনা গেল, পাড়ুকোন— ভারতীয় ব্যাডমিন্টনের সর্বকালীন জাদুকরও সেই চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সিন্ধুকে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন, আরও বেশি নেটের সামনে আসার সাহস দেখাও। পুরনো আগ্রাসন দেখিয়ে লাফিয়ে উঠে স্ম্যাশ করো। খুনে মানসিকতা ফিরলে পুরনো সিন্ধুও ফিরবে। প্রকাশের অ্যাকাডেমিতে প্রধান কোচ বিমল কুমার। তিনি সারাক্ষণ সিন্ধুর সঙ্গে লেগে রয়েছেন। পাড়ুকোন স্বয়ং খুব একটা বাইরে বেরোন না। বেঙ্গালুরুর অ্যাকাডেমিতে যা শেখানোর শেখান। কিন্তু সিন্ধুর ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটিয়েছেন। প্যারিস ওপেনে নতুন ছাত্রীর সঙ্গে গিয়েছেন, অলিম্পিক্সেও এসেছেন। মিক্সড জোনে উপস্থিত হাতে গোনা কয়েক জন সাংবাদিককে বললেন, ‘‘প্রকাশ স্যরের কাছে অনেক কিছু নতুন শিখছি। বেঙ্গালুরুতে যাওয়ার উপকার পাচ্ছি।’’ এ ছাড়াও নিজস্ব কোচ নিয়ে ঘোরেন ভারতীয় ব্যাডমিন্টনের ‘পোস্টার গার্ল’। ইন্দোনেশিয়ার আগুস দ্বি সান্তোসোর কথা বললেন। দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রেনার ওয়েন লোম্বার্ড-ও আছেন। যিনি টোকিয়ো অলিম্পিক্সে সেমিফাইনালে ওঠা ভারতীয় মহিলা হকি দলের সঙ্গে ছিলেন। বিনেশ ফোগতকে ট্রেনিং করিয়েছেন। ‘‘আমার সৌভাগ্য যে, দারুণ কোচিং টিম সঙ্গে রয়েছে,’’ বলতে শোনা গেল সিন্ধুকে।
পোর্ত দে লা শ্যাপেল এরিনায় অলিম্পিক্সের ব্যাডমিন্টন হচ্ছে। শনিবার সেই এরিনা ফরাসি গর্জনে ভরে গিয়েছিল। এ দিন প্যারিসের সময় সকাল ন’টা পনেরোতে সিন্ধুর ম্যাচ ছিল। তার আগেই তেরঙ্গা হাতে আসন ভরিয়ে তুললেন ভারতীয়রা। ‘সিন্ধু সিন্ধু’ আর ‘ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়া’ জয়ধ্বনি দিতে থাকলেন। স্বয়ং সিন্ধু যা দেখে উত্তেজিত, ‘‘বিদেশে খেলতে এসে এত জাতীয় পতাকা দেখতে পাওয়ার অনুভূতিটাই অন্যরকম। প্রথম পয়েন্ট থেকে ওঁরা আমার জন্য গলা ফাটিয়ে গেলেন। আমি সত্যিই সকলের কাছে কৃতজ্ঞ।’’ যোগ করলেন, ‘‘আশা করব, ওঁরা এ ভাবেই আমাকে উৎসাহ দিয়ে যাবেন, খেলা থাকলেই রোজ আসবেন। আর প্রার্থনা করি যে, আমিও জিততে থাকি।’’ কোথায় একটা যেন পড়েছিলাম, প্রকৃত তারকা সামনে এলেই অন্যরকম দ্যুতি বেরোয়। তাঁর চলনে-বলনে অন্যরকম বিশ্বাস ঠিকরে বেরোয় যে, ‘‘আমি আগে করে দেখিয়েছি, আবারও করে দেখাব।’’
রবিবার সকালে সিন্ধুকে দেখে সেরকমই মনে হল। হতে পারে তাঁর সাম্প্রতিক ফর্ম ভাল নয়। দু’বছর আগে কমনওয়েলথে সোনা জেতার পর থেকে উতরাই শুরু হয়েছে। প্যারিসে আসার আগে শেষ তিনটি প্রতিযোগিতা ধরলে একটিতে মাত্র ফাইনালে পৌঁছেছেন। গোড়ালি-সহ নানা চোটে জেরবার হয়েছেন। তবু তো তিনি পি ভি সিন্ধু। বড় ম্যাচের খেলোয়াড়। বড় মঞ্চের ওস্তাদ। যাঁর ট্রফিতে দু’টো অলিম্পিক পদক রয়েছে, বিশ্বচ্যাম্পিয়নের মুকুট জ্বলজ্বল করছে, তাঁকে নিয়ে স্বপ্ন দেখব না তো কাকে নিয়ে দেখব? নিজেই দারুণ বর্ণনা করে গেলেন তিনটি অলিম্পিক্সের মধ্যে তফাত কোথায়। ‘‘রিয়োতে আমি আন্ডারডগ ছিলাম। কিছু জানতামই না। টোকিয়োয় কোভিডের জন্য নানা বিধিনিষেধ ছিল। সব কিছু কেমন আটকা-আটকা। মন খুলে কেউ কিছু উপভোগ করতে পারেনি। কিন্তু এখানে আবার সব কিছু আগের মতো। আমি খুব খুশি যে, খোলামেলা হাওয়ায় তৃতীয় অলিম্পিক্স খেলতে এসেছি।’’ গেমস ভিলেজের খাটে শুয়ে ঘুমোতে সমস্যা হচ্ছে, এমন একটা অনুযোগ কোনও কোনও প্রতিযোগী সম্ভবত তুলেছেন। সিন্ধুকে জিজ্ঞেস করায় বলে দিলেন, ‘‘না, না আমার কোনও অসুবিধা হচ্ছে না।’’ শুনে মনে হল, অভিযোগ করতে আসেননি। পদক জেতাই পাখির চোখ। আপনি কোর্টে নামলেই সকলে পদক প্রত্যাশা করে। এই প্রত্যাশার চাপ কী ভাবে সামলান? প্রশ্ন করায় সিন্ধুর জবাব, ‘‘চাপ ছাড়া জীবন হয় না, জেনে গিয়েছি। এই স্তরে সবাইকে তার মুখোমুখি হতে হয়। পাশাপাশি এটাও তো ঠিক যে, আমি সেরা হতে চাই। সব সময় সেরা
হতে চাই।’’
চ্যাম্পিয়নদের কথা। চ্যাম্পিয়নদের মন্ত্র। চ্যাম্পিয়নদের হাবভাব। বলছিলাম, সামনে দাঁড়ালেই অন্যরকম দ্যুতি ঠিকরে বেরোয়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy