Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪

দাদাগিরির ইউরোপে সম্মান ফেরাতে ‘সুপারনোভা’র দিকে তাকিয়ে পর্তুগাল

সকালে উঠে বাজার করতে যাওয়া পোর্তোয় যন্ত্রণা বিশেষ। এক কেজি মুরগির মাংস কিনতে গেলে ছ’ইউরো চায়। ‘বিফ’ আরও বেশি, প্রায় সাড়ে আট-নয়।

পর্তুগাল জেতার পর রাতের আইফেল টাওয়ার।

পর্তুগাল জেতার পর রাতের আইফেল টাওয়ার।

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়
প্যারিস শেষ আপডেট: ০৮ জুলাই ২০১৬ ০৩:৫২
Share: Save:

সকালে উঠে বাজার করতে যাওয়া পোর্তোয় যন্ত্রণা বিশেষ। এক কেজি মুরগির মাংস কিনতে গেলে ছ’ইউরো চায়। ‘বিফ’ আরও বেশি, প্রায় সাড়ে আট-নয়। বান্ধবীকে নিয়ে ভাল রেস্তোরাঁয় নৈশভোজে বসতেও ইচ্ছে করে, কিন্তু বসা আর হয় না। দু’জনের ডিনারের বিল আসবে তিরিশ ইউরো, দেবে কে?

শহরে বাড়ি কেনা? অসম্ভব। হাজার-হাজার ইউরোর হোমযজ্ঞে কে নামবে? বাড়ি কেনা দূরস্থান, বাড়ি-ভাড়াই কুলিয়ে ওঠা যায় না। পোর্তো বা লিসবনে ওয়ান রুম অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া মানে মাস-মাইনের তিন-চতুর্থাংশ চলে গেল। প্রায় সাড়ে চারশো ইউরোর ব্যাপার। শহরতলি হলে একটু কম, তিনশো ইউরো মতো। টেনেটুনে অন্তত মাসটা চালিয়ে দেওয়া যায়।

লিভাইসের জিন্স দোকানে দেখতেই ভাল লাগে। বাড়ির ওয়ার্ডরোবে আনা আর হয় না। জল-বিদ্যুৎ-জঞ্জাল সাফাইয়ের খরচ যেখানে মাসে পঁচাশি ইউরো, চল্লিশ ইউরোর ব্র্যান্ডেড জিন্স তো চরম বিলাসিতার নামান্তর। মাসিক যাতায়াতে পঁয়ত্রিশ ইউরো বেরোয়, বিয়ার কিনতে হয় মেপে-মেপে, তার পর লিভাইসকে আর ইচ্ছে-দেরাজের বাসিন্দা করা যায় না। অপ্রাপ্তির আলমারিতে বন্দি রাখতে হয়।

বুধবার মধ্যরাতের প্যারিস ফ্যান জোনে দেশ সম্পর্কে টানা কথাগুলো বলে যাচ্ছিলেন যে যুবক, পাঁচ মাস হয়ে গেল তিনি পোর্তো ছেড়ে ফ্রান্সে চলে এসেছেন। ফরাসি ভাষাটা সম্পূর্ণ শিখে উঠতে পারেননি, আন্দ্রে গোমসের ইংরেজিটাও কাজ চালানো। গত পাঁচ মাসে খুব যে বেশি বন্ধু-বান্ধব হয়েছে এখানে, তা-ও নয়। মাঝেমধ্যে আজও পোর্তো মনে পড়ে। মন চায়, একটু বাড়ি ঘুরে আসতে। কিন্তু পাকাপাকি ফিরে যাওয়ার কথা ভাবতে পারেন না। ভাবতে পারেন না, প্যারিস ছেড়ে পোর্তোর জীবনযাপনে ফিরে যাওয়া।

“প্যারিস আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। এখানে ভাল ভাবে থাকতে পারছি। পর্তুগালের কী অবস্থা হয়েছে, ভাবতে পারবেন না,” জায়ান্ট স্ক্রিনে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোকে দেখতে দেখতে বলে ফেলেন আন্দ্রে। সিআরের দুর্ধর্ষ হেড ওয়েলস-গোলে ঢোকার সময়ও আপনি নাচছিলেন। স্বদেশীয়দের কাঁধে উঠে ‘পুর্তুগালা লে’ গাইছিলেন। তবু পর্তুগাল নিয়ে এত বিষাদ কেন?

“পাঁচশো ইউরো, ছ’শো ইউরো এই তো মাইনে আমাদের দেশে। তাতে চলে নাকি? বাড়ি ভাড়া থেকে বাকি খরচপাতি তো বললাম। এ বার ক্যালকুলেট করে দেখুন, কত পড়ে থাকে। ফ্রান্সে সেখানে ঢুকলেই বারোশো ইউরো দিয়ে শুরু হয়,” ভারতীয় সাংবাদিকের প্রশ্নে ইউরো ফাইনালে ওঠার ক্ষণিক স্বর্গসুখ ফেলে বাস্তবের মরুভূমিতে নামেন পর্তুগিজ। হাসি থামে, দেশের রাজনীতিকদের মনে পড়ে, বিরক্তি ফুটে ওঠে চোখেমুখে। “পর্তুগালের রাজনৈতিক নেতারাও হয়েছে তেমন। লোকে খেতে পাচ্ছে না। চুরি-চামারি-রাহাজানি বাড়ছে। লক্ষ-লক্ষ লোক বেকার। আর সরকার আয়করের টাকা দিয়ে সাবমেরিন কিনছে! প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পর্তুগাল কোনও যুদ্ধবিগ্রহে ঢোকেইনি। তা হলে কীসের সাবমেরিন?”

আন্দ্রের কথাবার্তা থেকেই জানা যায়, লিয়ঁর স্টেডিয়ামে গ্যারেথ বেলের বিরুদ্ধে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর জয় যে হাজার-হাজার তৃপ্ত পর্তুগিজ দেখে উৎসব করলেন, তাঁরা কেউ পর্তুগাল থেকে ম্যাচ দেখতে আসেননি। প্যারিস রাতের কালো আকাশ যাঁরা দেশের জার্সি-রঙা লাল-মেরুন ধোঁয়ায় ঢেকে দিচ্ছিলেন, তাঁরাও নন। সব নাকি উদ্বাস্তু। কেউ লিসবন, কেউ পোর্তো ছেড়ে প্যারিসে চলে এসেছেন আজীবনের মতো। এবং প্যারিসে পর্তুগিজ-উদ্বাস্তু সংখ্যাটাও বেশ ভয়াবহ।

এক নয়, দুই নয়, দশ লক্ষ!

“আমি নিজেও তো,” খেলা থেকে চোখ সরিয়ে আবার ভারতীয়র দিকে ঘুরে যান আন্দ্রে। “একটা দোকানে কাজ করতাম পার্টটাইম। মাসে পেতাম আড়াইশো ইউরো। হাস্যকর! বাবা চাকরি করেন বলে কোনও মতে নিজেরটা চালানো যেত। একা থাকতে হলে আর দেখতে হত না।” দেশের অতীব গর্বের দিনেও দেশ নিয়ে তাঁর কাতরানি ভেসে আসে— পর্তুগালে আর ভাল চাকরি নেই। বর্তমান প্রজন্মকে জীবন অতিবাহিত করতে হয় ম্যাকডোনাল্ডসের দোকানে, রেস্তোরাঁয় কাজ করে। বড়জোর জামাকাপড় তৈরির কারখানা। ওটাই নাকি লিসবনের সবচেয়ে সম্মানের কাজ, শ্রেষ্ঠ জীবিকা। জয়োৎসবের স্রোতে দাঁড়িয়ে দুঃখের আন্দ্রে শোনাতে থাকেন, কুড়ি বছর আগের পর্তুগাল এ রকম ছিল না। কিন্তু আজ নামেই ইউরোপের দেশ, আসলে ধ্বংসস্তুপ। “পর্যটনকেও এরা শেষ করে দিল। বিদেশিরা আজ স্পেন-ইতালি ঘুরতে যায়। আমাদের দেশে ক’জন আসে? অথচ পর্তুগালের মতো সুন্দর সমুদ্র আর কোথায় আছে? মানুষজন আগে ভাল ছিল। কিন্তু দারিদ্র এখন এমন জায়গায় নিয়ে গিয়েছে যে, কোথাও কোথাও রাত-বিরেতে হাঁটাই যায় না। সব কেড়েকুড়ে নিয়ে যাবে!”

ইন্টারনেট খুঁজে দেখা গেল, পর্তুগালের অর্থনৈতিক-মন্দা, চাকরি-সমস্যা আজকের নয়। বছর তিনেক ধরে চলছে। জিডিপি পড়েছে, বেকারত্ব বাড়ছে, প্রধানমন্ত্রী দেশের যুবসম্প্রদায়কে বলছেন, কমফোর্ট জোনের বাইরে বেরিয়ে তোমরা বিদেশে চলে যাও। চাকরি খোঁজো। আর জীবনের সব গলি থেকে আঘাত পেয়েই কি না কে জানে, আন্দ্রে গোমসদের বর্তমান পর্তুগাল-প্রজন্ম বিশ্বাস করে, ইউরোপ অর্থনীতিতে জার্মানি-ইংল্যান্ডের মতো ‘সুপার-পাওয়ার’দের সামনে তার সদর্প মাথা তুলে দাঁড়ানোর মতো একটাই পাশুপত আছে। এক জনেরই ‘সুপারনোভা এক্সপ্লোশন’ তার শেষ সম্বল, জার্মান-ইংরেজদের ‘দাদাগিরির’ দুনিয়ায় যা ফিরিয়ে আনতে পারে পর্তুগালের সম্মান। না, তাতে দেশের বেকারত্ব সমস্যা মিটবে না। রাতারাতি পাঁচশো ইউরো থেকে মাইনে পনেরোশোও হয়ে যাবে না। পর্তুগাল যেমন আছে, তেমনই থাকবে। শুধু অভাব-অনটনের সংসারে এক মেধাবী ছাত্রের সোনার ইতিহাস সে ইউরোপকে বলে যেতে পারবে।

ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো ও তাঁর ইউরো জয়!

পর্তুগালের ফুটবল-ইতিহাসে রোনাল্ডো যে প্রথম ও শেষ ফুটবল-তারা, ভাবাটা নির্বুদ্ধিতা। তাঁর আবির্ভাবের আগেও ইউসেবিও, লুইস ফিগো বিশ্ব ফুটবলকে সমৃদ্ধ করে গিয়েছেন। আন্দ্রে গোমসদের প্রজন্ম ইউসেবিও দেখেনি। ফিগো দেখেছে। কিন্তু ফিগোর চেয়ে তারা কোথাও গিয়ে আদর্শ হিসেবে রোনাল্ডোকে এগিয়ে রাখে। ফিগো নাকি একটু আত্মকেন্দ্রিক, অর্থের প্রতি টান আছে। কিন্তু রোনাল্ডো তা নন। তবে যে বারবার লেখা হয়, রোনাল্ডোর চেয়ে স্বার্থপর ফুটবলার আর নেই?

সেই পর্তুগিজ।

আন্দ্রে শুনে ঝাঁঝিয়ে ওঠেন, “সে তো মিডিয়া লেখে। সব মিথ্যে। মিডিয়াকে ক্রিশ্চিয়ানো দেখতে পারে না। ওরা তাই আরও পিছনে লাগে। শুনুন, রোনাল্ডোকে আমরা জানি। জানি, কতটা দারিদ্র থেকে ওকে উঠে আসতে হয়েছে। ও আমাদের অনেক কাছাকাছি।” শুনিয়ে দেন, সাংবাদিকের মাইক্রোফোন ছুড়ে ফেলা নিয়ে সিআর-কে যখন এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয় আন্তর্জাতিক মিডিয়া, পর্তুগাল দেখে হাসে। বলে, দেখো আবার ছেলেটাকে নিয়ে নাটক শুরু হল। “আসলে কী জানেন, আমরা বিশ্বাস করি রোনাল্ডোর একটা বড় ট্রফি প্রাপ্য। পর্তুগাল নিয়ে তা হলে কিছু বলার থাকে। আমাদের আর কী আছে বলুন?” নরম গলায় কথাটা ছুড়ে ফ্যান জোনের নব্বই হাজারের ভিড়ে হারিয়ে যান গোমস। সেলফি, নাচ আর চিৎকারের ‘জলসাঘরে’ তাঁকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।

জানা নেই, ছোটবেলার দারিদ্র তারকার সঙ্গে দেশের আত্মাকে কোথাও মিলিয়ে দেয় কি না। অতশত ভাবার সময়ও থাকে না। জায়ান্ট স্ক্রিনে চোখ চলে যায়। ওই যে, রোনাল্ডোকে দেখাচ্ছে। ফাইনালে উঠে আকাশের দিকে তাকিয়ে হাসছেন। মুখ ঢাকছেন ছদ্ম-লজ্জায়, আঙুল তুলে দেখাচ্ছেন অনন্তকে। দেখে কেন জানি না মনে হয়, আগামী রবিবারের প্যারিসে রোনাল্ডোর এই হাসিটা আর একবার দেখা বড় দরকার। ফ্রান্স ইউরোয় শেষ বারের মতো।

ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর নিজের জন্য। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর দেশের জন্যও!

অন্য বিষয়গুলি:

Portugal Europe
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy