Advertisement
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪
Paris Olympics 2024

বল দেখো, গোল বাঁচাও: সুপারম্যান সৃজেশের মন্ত্র

সৃজেশ যাঁকে ছোট ভাইয়ের মতো দেখেন এবং সব চেয়ে বেশি গালাগাল বরাদ্দ থাকে তাঁর জন্য। মনপ্রীত বলছিলেন, ‘‘সৃজেশ ভাই গালাগাল না দিলে যেন মনে হয়, কী একটা নেই।

দুরন্ত: গ্রেট ব্রিটেনের কোনর উইলিয়ামসনের শট আটকানোর চেষ্টায় সৃজেশ।প্যারিসে কোয়ার্টার ফাইনালে।

দুরন্ত: গ্রেট ব্রিটেনের কোনর উইলিয়ামসনের শট আটকানোর চেষ্টায় সৃজেশ।প্যারিসে কোয়ার্টার ফাইনালে।

সুমিত ঘোষ
প্যারিস শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০২৪ ০৮:২৬
Share: Save:

নির্ধারিত ৬০ মিনিটের খেলা ১-১ শেষ হতেই দেখা গেল, হাত মেলানো শুরু হয়ে গেল। দশ জনে খেলতে হচ্ছিল, তাই ড্র যেন জয়ের সমান। কারও কারও মুখে তখনই বিজয়ের হাসি। অভিনন্দন আদানপ্রদান চলছে। কিন্তু কাজ যে এখনও শেষ হয়নি। তা হলে এখনই উৎসবের আমেজ কেন ভারতীয় শিবিরে?

পেনাল্টি শুটআউট শুরুর আগেই মনে হচ্ছিল, ভারত জিতে গিয়েছে। পি আর সৃজেশের উপরে এত আস্থা সতীর্থদের। সত্যি ভরসা রাখার মতোই যে। একটা পরিসংখ্যান দেখছিলাম যে, এই নিয়ে ২৩ বার শুটআউটে দাঁড়িয়ে ১৩ বার দলকে জেতালেন সৃজেশ। ‘আমাদের কিংবদন্তি। জানতাম শুটআউটে আমরা ফেভারিট,’’ ম্যাচের পরে বলে গেলেন মনপ্রীত সিংহ। দশজন হয়ে যাওয়ার পরে যিনি নীচে নেমে খেলছিলেন। সৃজেশ যাঁকে ছোট ভাইয়ের মতো দেখেন এবং সব চেয়ে বেশি গালাগাল বরাদ্দ থাকে তাঁর জন্য। মনপ্রীত বলছিলেন, ‘‘সৃজেশ ভাই গালাগাল না দিলে যেন মনে হয়, কী একটা নেই। পিছন থেকে ওর কথাগুলো আমাদের চাঙ্গা রাখে।’’ মিক্সড জ়োনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন মনপ্রীত। যেখানে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে আসেন খেলোয়াড়েরা।

একটু পরে সেখানে আবির্ভাব ঘটল নায়কের। পিছনের গ্যালারি থেকে গর্জন উঠল যেন। এত ক্ষণ সবচেয়ে বেশি শোনা যাচ্ছিল দু’টো স্লোগান। ‘ভারত মাতা কী জয়’ আর ‘জিতেগা ভাই জিতেগা, ইন্ডিয়া জিতেগা’। এ বার সব কিছুকে ছাপিয়ে গেল ‘সুপারম্যান সৃজেশ’ ধ্বনি। কেউ কেউ গ্যালারি থেকেই হিন্দিতে আবদার ছুড়ে দিচ্ছেন, ‘‘এটা শেষ করে আমাদের এখানে একবার আসবেন প্লিজ। একটা সেলফি তুলতে চাই।’’ তার মধ্যেই মনপ্রীত ঘুরে এসে জানতে চাইলেন, তুমি কি এখনও আমাকে গালি দিচ্ছ? সৃজেশ বললেন, ‘‘না, না। তোকে নিয়ে ভাল কথা বলছি যে, তুই আমার বেবি।’’ তার পরে সাংবাদিকদের বললেন, ‘‘ওরা অনেকে আমার কাছে ছোট বাচ্চার মতোই। তাই ওদের চাঙ্গা রেখে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি।’’ কিন্তু তিনি কী ভাবে এমন অসাধ্য সাধন করেন? কী ভাবে এত চাপ সামলে শুটআউটে জেতালেন? কোনও নির্দিষ্ট রণনীতি থাকে কি আপনার? সৃজেশ যা জবাব দিলেন, অমর উক্তিতে স্থান পেতে পারে। ‘‘রণনীতি নিয়ে ভাবার ফুরসত থাকে না। বল দেখো, গোল বাঁচাও। এটাই আমার মন্ত্র।’’ এমন ভাবে বলে দিলেন যেন স্যেন নদীর পারে ঘুরতে বেরোনোর মতো সহজ ব্যাপার। যিনি শট নিতে আসছেন, তাঁকে ঘাবড়ে দেওয়ার মতো কিছু ভেবে রাখেন? সৃজেশ ফের বললেন, ‘‘ও সব করার সময় কোথায়? আমি বলটাকেই অনুসরণ করি।’’

গ্রেট ব্রিটেনের সমর্থকদের কাছেও নায়ক সৃজেশ। ভারতীয় সাংবাদিক দেখে অনেকে এসে বলে গেলেন, ‘‘পি আর সৃজেশ এক হকি কিংবদন্তির নাম।’’ প্যারিস অলিম্পিক্সে হকি হচ্ছে ইভ্‌স জ়ু মানোয়া সেন্টারে। শহরের কেন্দ্র থেকে খানিকটা দূরে। ট্রেন, মেট্রো পাল্টে পৌঁছতে মিনিট পঁয়তাল্লিশ লাগবে। রবিবার জায়গাটা পুরোপুরি ভারতীয় সমর্থকদের দখলে চলে গিয়েছিল যেন। গ্যালারিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারত। যাঁরা ব্রিটেনের পতাকা হাতে এসেছিলেন, তাঁরাও ফিরলেন সৃজেশের ভক্ত হয়ে। স্থানীয় কয়েক জনকে পাওয়া গেল, বাচ্চাদের নিয়ে খেলা দেখতে এসেছেন। হাতে ভারতের জাতীয় পতাকা। জিজ্ঞেস করায় বললেন, ‘‘আমাদের অনেক ভারতীয় বন্ধু আছে। ওদের সমর্থনে ভারতকে সমর্থন করছি।’’ জানালেন, হকির নিয়মকানুন কিছু জানেন না। কী ভাবে খেলাটা হয়, বিন্দুবিসর্গ বোঝেন না। তবু মাঠে এসে ভারতের জয় উপভোগ করেছেন। নিয়মকানুন না বুঝুন, আবেগের স্পর্শ কে না বোঝেন! ফেরার সময় রেল স্টেশনে পর্যন্ত দেখা গেল, স্বেচ্ছাসেবক-সেবিকারা ভারতের জয় নিয়ে আলোচনা করছেন। স্টেশনেও কি অলিম্পিক্সের খেলার ঘোষণা চলছে? জানা গেল, তাঁরা মোবাইল থেকে জেনে নিচ্ছিলেন খেলার স্কোর। ভারতীয় হকি নিয়ে ফ্রান্সের মানুষের এমন আগ্রহ বেশ চমকে দেওয়ার মতো।

অলিম্পিক্সের জন্য যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে ভারতীয় হকি দল। জুলাইয়ে ইউরোপ রওনা হয়ে গিয়েছিল তারা। ‘টিম বন্ডিং’ বা দলকে একসূত্রে গাঁথার প্রক্রিয়া হয় সুইৎজ়ারল্যান্ডে। তার পরে নেদারল্যান্ডসে ট্রেনিং ক্যাম্প। এ ছাড়াও খেলোয়াড়েরা নিজেরা আলাদা প্রস্তুতি নিয়েছেন। যেমন হরমনপ্রীতের ড্র্যাগ-ফ্লিক বিপজ্জনক বলে সেগুলি বাঁচিয়ে বিশেষ ভাবে মহড়া সেরেছেন সৃজেশ। গ্রেট ব্রিটেনের সামনে দেওয়াল হয়ে ওঠা তিনি বিশ্ব হকি সংস্থার বিচারে দুবার বর্ষসেরা গোলকিপারের পুরস্কার পেয়েছেন। কোচ ক্রেগ ফুল্টন এমন একটা দল বেছেছেন, যারা ধরাবাঁধা প্রক্রিয়ার বাইরে যেতে পারবে। তিনি চমক দেওয়াতে বিশ্বাসী। জায়গা পরিবর্তন করে অনেককে খেলান। এ দিন দশ জন হয়ে যাওয়ার পরে সেই সব টোটকা কাজে দিয়েছে। মনপ্রীত বলে গেলেন, ‘‘দশ জন হয়ে গেলে কী করতে হবে, সেই অনুশীলনও আমরা করেছি। তবে হ্যাঁ, দশ জন হয়ে
যাব ভাবিনি।’’

হকিতে লাল কার্ড খুবই দুর্লভ একটা ব্যাপার। সচরাচর দেখাই যায় না। সবুজ কার্ড আছে। যা দেখলে দুই মিনিট মাঠের বাইরে থাকতে হয়। হলুদ কার্ড দেখলে পাঁচ মিনিট নির্বাসিত। যদি কেউ ইচ্ছাকৃত ভাবে কোনও খেলোয়াড়কে আঘাত করার চেষ্টা করে, তবেই একমাত্র লাল কার্ড দেখানো হয়। গ্রেট ব্রিটেনের উইলিয়াম কালনানের মুখে স্টিক লাগার পরে অমিত রোহিদাসকে লাল কার্ড দেখানো হয়। যা নিয়ে প্রবল বিতর্ক
চলছে। কী ভাবে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, তিনি ইচ্ছাকৃত ভাবে স্টিক দিয়ে আঘাত করেছেন? রক্ষণে ভারতের প্রধান স্তম্ভ বেরিয়ে যাওয়ার পরেও যে ম্যাচ বার করা যাবে, হয়তো কেউ
তখন ভাবেনি।

নাকি ভুল লিখলাম। এক জন ভেবেছিলেন। তিনি,
সুপারম্যান সৃজেশ!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Paris Olympics 2024 Paris Indian Hockey Team
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE