Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Paris Olympics 2024

ব্রোঞ্জেও ‘লক্ষ্য’ভ্রষ্ট, ইতিহাস গড়া হল না সেনের

সেমিফাইনালে হারের পরও আত্মবিশ্বাস হারাননি লক্ষ্য। অন্তত ব্রোঞ্জ পদক নিয়ে দেশে ফিরতে চেয়েছিলেন। পারলেন না ২২ বছরের তরুণ। প্রথম গেম জিতেও হেরে গেলেন।

picture of Lakshya Sen

লক্ষ্য সেন। ছবি: রয়টার্স।

আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০২৪ ১৯:১৩
Share: Save:

উত্তরাখণ্ডের আলমোড়া। পাহাড়ি শহরে চোখ মেললেই কুমায়ুন হিমালয়ের সৌন্দর্য্য মনমুগ্ধ করে দেয়। প্রকৃতি যেন নিজের হাতে করে সাজিয়ে দিয়েছে শহরটাকে। সেখানেই ভারতীয় ব্যাডমিন্টনের অন্যতম অধিবাস।

পাহাড়ি শহরে ব্যাডমিন্টনের প্রচলন করেছিলেন লক্ষ্য সেনের ঠাকুরদা চন্দ্রলাল সেন। খেলা শিখিয়েছিলেন ছেলে ধীরেন্দ্রকুমার সেনকে। যিনি ডিকে সেন নামে পরিচিত ভারতের ব্যাডমিন্টন মহলে। তিনি আবার খেলা শিখিয়েছেন লক্ষ্যকে। ব্যাডমিন্টন আলমোড়ার সেন পরিবারের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গিয়েছে। তিন পুরুষের চর্চা দু’টি ম্যাচ হেরে যাওয়ায় শেষ হয়ে যাবে? তা হয় না। তাই সেমিফাইনালের পর ব্রোঞ্জ পদকের লড়াইয়ে ১ ঘণ্টা ১১ মিনিটে ২১-১৩, ১৬-২১, ১১-২১ ব্যবধানে হেরে গেলেও লক্ষ্য অনেক দূর যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে রাখলেন।

প্যারিস অলিম্পিক্সের সিঙ্গলস সেমিফাইনালে রবিবার ডেনমার্কের ভিক্টর অ্যাক্সেলসেনের কাছে লক্ষ্য হেরে যাওয়ার পর আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। লক্ষ্য পদক পাবেন তো? পদকের কাছাকাছি পৌঁছেও ভারতের একাধিক খেলোয়াড়ের ব্যর্থতার ইতিহাস সেই আশঙ্কা তৈরি করেছিল। সেই আশঙ্কা সত্যি হল। লক্ষ্যের লক্ষ্যপূরণ হল না। কিন্তু চার বছর পর লক্ষ্যপূরণ হবে, সেই আশা করাই যায়।

সোমবার কোর্টে নামা থেকেই আক্রমণাত্মক খেলা শুরু করেন লক্ষ্য। বিশ্বক্রমতালিকায় সাত নম্বরে থাকা মালয়েশিয়ার লি-কে ২১-১৩ ব্যবধানে হারিয়ে দেন। লি নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার আগেই ১৬ পয়েন্টে পৌঁছে যান লক্ষ্য। তখনও তাঁর প্রতিপক্ষ ছিলেন ১০ পয়েন্টে। এই ব্যবধান আর মুছতে পারেননি মালয়েশিয়ার প্রতিপক্ষ। ম্যাচের প্রথম ২০ মিনিট দেখে মনে হয়েছিল, লক্ষ্য প্রস্তুত। কিন্তু পরে বোঝা গিয়েছে সেই প্রস্তুতি যথেষ্ট ছিল না।

অলিম্পিক্স বড্ড কঠিন ঠাঁই। বিশেষ করে ব্যাডমিন্টনের এখন যা গতিপ্রকৃতি, তাতে সেরা খেলোয়াড়ই সোনা জিতবেন, পদক জিতবেন, কেউ বলতে পারেন না হলফ করে। সর্বোচ্চ পর্যায়ের খেলোয়াড়দের তফাৎ উনিশ-বিশ। প্রথম পাঁচ-সাত জনের যে কেউ সোনা জিততে পারেন। নিজের দিনে সকলেই হারাতে পারেন যে কাউকে। এই পর্যায়ে পৌঁছাতে কম রাস্তা হাঁটতে হয় না খেলোয়াড়দের। কত লিটার ঘাম ঝরলে অলিম্পিক্স পদক জিততে পারেন, সেই হিসাব কেউ করেন না। কত আঘাত সহ্য করলে বিজয়ীর মঞ্চে ওঠা যায়, তার কোনও ফর্মুলা নেই। শুধুই কি অনুশীলন? আরও কত কিছু যে করতে হয়, তার খতিয়ান জানেন শুধু খেলোয়াড় এবং কোচেরা। প্রতি দিন লড়াই করতে হয়। সতীর্থদের হারাতে হয়। নিজেকে ছাপিয়ে যেতে হয়। তবেই দেশের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পাওয়া যায়।

খেলার মাঠে বা কোর্টে আসলে কেউই বন্ধু নয়। প্রতি দিনের সঙ্গীকে হারিয়েই এগোতে হয়। ঠিক যেমন অলিম্পিক্সের প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে লক্ষ্যকে সামলাতে হয়েছে এইচএস প্রণয়ের চ্যালেঞ্জ। যেমন সেমিফাইনালে তাঁকে লড়াই করতে হয়েছে এক সময় অনুশীলনের সঙ্গী অ্যাক্সেলসেনের বিরুদ্ধে। প্রতিটি পরাজয় আসলে সাফল্যের একেকটি ধাপ। পরাজয় জেদ বৃদ্ধি করে। ভুলগুলি শিক্ষা দেয়। শিক্ষা শেষে দীক্ষা লাভ হয়।

প্রথম গেম জেতার পর রাশ কিছুটা আলগা করেছিলেন লক্ষ্য। সেই সুযোগ কাজে লাগালেন লি। ২৬ মিনিট লড়াইয়ের পর লক্ষ্য হারলেন ১৬-২১ ব্যবধানে। সমতা ফেরানোর পর ম্যাচের রাশ নিয়ে নেন লি। আর পারলেন না লক্ষ্য। তৃতীয় গেমে লি-র আক্রমণাত্মক খেলার সামনে কিছুটা দিশাহারা দেখাল লক্ষ্যকে। ২৬ মিনিটে হারলেন ১১-২১ ব্যবধানে। খেলা যত এগিয়েছে, তত পিছিয়ে পড়েছেন লক্ষ্য। ভুল ‘জাজমেন্ট’-এ সহজ পয়েন্ট দিয়েছেন প্রতিপক্ষকে। সুবিধাজনক জায়গায় থেকেও কাজে লাগাতে পারেননি। চাপের মুখে একের পর এক ভুল করেছেন।

সেমিফাইনালের পর অ্যাক্সেলসেন বলেছেন, লক্ষ্যের প্রতিভা আছে। শেখার, পরিশ্রম করার চেষ্টা আছে। চার বছর পর অলিম্পিক্স সোনা জয়ের প্রধান দাবিদার হয়ে উঠতে পারে। ঠিকই বলেছেন হয়তো। লক্ষ্যের শিক্ষা পর্ব শেষ হয়নি। দীক্ষা লাভের জন্য অপেক্ষা করতে হবে ধৈর্য্য নিয়ে। অলিম্পিক্সের আগে ব্যাডমিন্টনে ভারতের সম্ভাব্য পদকজয়ী হিসাবে লক্ষ্যকে ধরা হয়নি। মহিলাদের সিঙ্গলসে পিভি সিন্ধু এবং পুরুষদের ডাবলসে সাত্ত্বিকসাইরাজ রানকিরেড্ডি এবং চিরাগ শেট্টির জুটিকে রাখা হয়েছিল হিসাবের মধ্যে। অলিম্পিক্সেও বাছাইয়ের মর্যাদা পাননি লক্ষ্য। সম্ভাবনা, বাছাই তালিকা নিয়ে মাথা ঘামান না চ্যাম্পিয়নেরা। নিজেদের দক্ষতায় ভরসা রাখেন তাঁরা। লড়াই শুরুর পর প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করে দেওয়ার চেষ্টা করেন। লক্ষ্য হয়তো তেমনই চেয়েছিলেন। কিন্তু পারলেন না। অ্যাক্সেলসেন সঠিক ভাবেই বলেছেন, এখনও শিখতে হবে। অন্তত বড় খেতাব জেতার জন্য।

অলিম্পিক্স সোনা জেতার বয়স হয় না। পঞ্চম বারের চেষ্টায় ৩৭ বছর বয়সে রবিবার প্রথম সোনা জিতেছেন নোভাক জোকোভিচ। লক্ষ্য এখন ২২। এর থেকে কম বয়সেও সোনা জেতা যায়। বিশ্বকে চমকে দেওয়া যায়। সেই সাফল্যের পিছনে থাকে ক্রীড়া সংস্কৃতি। প্রকাশ পাড়ুকোন, বিমল কুমার, পুল্লেলা গোপীচন্দেরা উদ্যোগ নেওয়ার আগে এ দেশে আধুনিক মানের ব্যাডমিন্টন অ্যাকাডেমি তেমন ছিল না। গত কয়েক দশকের চেষ্টায় তিনটি অলিম্পিক্স পদক এসেছে। সাইনা নেহওয়াল, সিন্ধুরা পদক এনেছেন। পুরুষদের জাতীয় দল থমাস কাপ চ্যাম্পিয়ন (বিশ্বজয়ের সমতুল্য) হয়েছে। ২০২২ সালে সেই দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন লক্ষ্য। আন্তর্জাতিক পর্যায় ধারাবাহিক সাফল্যের যুগ ভারতীয় ব্যাডমিন্টনে শুরু হয়েছে দেড় দশক আগে। পাড়ুকোন, গোপীচন্দ বা তাঁদের আগের সৈয়দ মোদীরা ব্যতিক্রমী প্রতিভা হিসাবেই চিহ্নিত হয়েছেন। লক্ষ্য প্যারিসে লক্ষচ্যুত হননি। আসলে ভারতীয় ব্যাডমিন্টন এখনও কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। আলমোড়ার যুবকের র‌্যাকেট দেশের ব্যাডমিন্টনকে হয়তো সামান্য এগিয়ে দিতে পারে।

মাইকেল ফেল্পস, উসাইন বোল্ট, সিমোন বাইলসের মতো অলিম্পিক্স সফল ক্রীড়াবিদ ভারতে নেই। এমন ঝকঝকে সোনালি সাফল্যের খোঁজ এ দেশে কেউ করে না। একটা ব্রোঞ্জ পেলেই সফল মনে করা হয়। কোনও কোনও খেলোয়াড় অলিম্পিক্সে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেই গর্বিত হন। লক্ষ্য ঠিক এই জায়গায় ব্যতিক্রম। জুনিয়র পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক স্তরে সাফল্য পেয়েছেন। নিজের খেলাকে ভেঙেছেন। গড়েছেন। নতুন ভাবনায় প্রস্তুত হয়েছেন। নতুন শট যোগ করেছেন। দুর্বল কিছু শট বিয়োগ করেছেন। যোগবিয়োগ করতে করতে এগিয়েছেন। আরও পথ এগোতে হবে তাঁকে।

সেমিফাইনালে অ্যাক্সেলসেনের বিরুদ্ধে শুরুটা ভাল করেছিলেন। ধরে রাখতে পারেননি। দক্ষতায় কিছুটা পিছিয়ে পড়েছেন। অভিজ্ঞতাতেও পিছিয়ে গিয়েছেন। জোকোভিচের ২০ বছর লেগেছে। ব্যাডমিন্টনের অ্যাক্সেলসেন টেনিসের জোকারের মতোই। ডেনমার্কের শাটলারকেও রিয়োয় সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল ব্রোঞ্জ নিয়ে। টোকিয়োয় সোনা জেতেন। লক্ষ্যকেও অপেক্ষা করতে হবে অন্তত আরও চার বছর। গত ১৫-২০ বছরে ভারতীয় ব্যাডমিন্টনে একের পর এক ভাল মানের খেলোয়াড় উঠে এসেছেন। কেউ কেউ বিশ্বমানেরও। প্রস্তুতির এটা বড় সুবিধা। সেরা মানের সতীর্থদের সঙ্গে দিনের পর দিন অনুশীলন করে কঠিনতম লড়াইয়ের জন্য তৈরি হওয়া যায়। সুযোগ কাজে লাগাতে হবে।

লক্ষ্যের বাঁ কানের পাশ থেকে গলায় লম্বা করে লেখা রয়েছে, ‘স্কাই ইজ দ্য লিমিট’। অনেক আগেই নিজের লক্ষ্য স্থির করে নিয়েছেন। গ্রুপ পর্বে বিশ্বের তিন নম্বর ইন্দোনেশিয়ার জোনাথন ক্রিস্টি, কোয়ার্টার ফাইনালে চাইনিজ তাইপের চউ তিয়েন-চেনের বিরুদ্ধে সাফল্য পেয়েছেন। তা একটা জয়ে যেমন বাড়তি গুরুত্ব পায় না, তেমন একটা হারে লঘুও হয়ে যায় না। দু’জনেই পদক জয়ের অন্যতম দাবিদার ছিলেন। লক্ষ্যকে জয় এনে দেওয়া স্ম্যাশগুলি নিশ্চিত ভাবে তাঁদের হৃদয় ক্ষতবিক্ষত করেছে। স্বপ্ন পূরণে বাধা দিয়েছে। সেমিফাইনালে একই অভিজ্ঞতা হয়েছে লক্ষ্যেরও। ব্রোঞ্জ পদকের লড়াইয়েও ব্যতিক্রম হল না।

সাফল্য ধরা দিল না প্যারিসে। জীবন এগিয়ে যাবে। লক্ষ্যও নিশ্চই তাঁর কাঙ্খিত লক্ষ্যের দিকে এগোতে চাইবেন। অ্যাক্সেলসেন তো বলেছেন, ভারতীয় তরুণের দীক্ষালাভ হতে পারে লস অ্যাঞ্জেলসে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy