উল্লাস: জয়ের পরে জর্মনপ্রীত, ললিতরা। ছবি রয়টার্স।
রাহুল দ্রাবিড়ই ভারতীয় ক্রীড়াজগতের একমাত্র দেওয়াল? রবিবারের পরে, লেখার আগে দু’বার ভাবতে হবে। তাঁকে জোরালো প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফেলার মতো এক জন আছেন। কেরলে জন্ম হলেও দ্রাবিড়ের বেঙ্গালুরুতেই সাই (স্পোর্টস অথরিটি অব ইন্ডিয়া) কমপ্লেক্সে যিনি একা কুম্ভ হয়ে ওঠার বিদ্যা রপ্ত করেছেন। যিনি না থাকলে রবিবার প্যারিস অলিম্পিক্সে কী ভয়ঙ্কর পরিণতি হতে যাচ্ছিল, ভেবেই শিউরে উঠছি।
দ্বিধা না রেখে লিখে ফেলা যাক, পারাত্তু রবীন্দ্রন সৃজেশ না থাকলে এ দিনই অলিম্পিক্সে বিসর্জনের বাজনা বেজে যেত হকিতে। যে দিন লক্ষ্য সেন সেমিফাইনালে হেরে গেলেন, লভলিনা বরগোঁহাইয়ের পদকের আশা শেষ হয়ে গেল, সেই দিন হকিতে বিদায় ঘটলে নিশ্চয়ই অলিম্পিক্সে কালো দিন হিসেবে ৪ অগস্ট ২০২৪ চিহ্নিত হয়ে থাকত। সেই আগ্নেয়গিরি আটকালেন সৃজেশ। গ্রেট ব্রিটেনকে পেনাল্টি শুটআউটে হারিয়ে যে শেষ চারে উঠল ভারত, তার প্রধান কারণ তিনি। পদকের পোডিয়াম এখনও দূরে। সেমিফাইনালে জিতলে পদক নিশ্চিত। হারলে ব্রোঞ্জের জন্য আর একটা ম্যাচ খেলতে হবে। তবু দশ জন হয়ে গিয়েও যে ম্যাচ বার করা গেল, সেটাই এক ধাক্কায় মানসিক জোর অনেকটা বাড়িয়ে দেবে। জেতার পরে ভিকট্রি ল্যাপ দেওয়া দেখে মনে হল, হকির স্বর্ণযুগ ফেরানোর ভাবনাকে উস্কে দিয়ে সোনার জন্য ঝাঁপানোর জেদ হয়তো তৈরি করে দিয়ে গেল এই ম্যাচ।
কত অবধারিত গোল যে একা সৃজেশ বাঁচালেন, তার হিসাব রাখাই কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। একটা পরিসংখ্যান দেখলাম যে, গ্রেট ব্রিটেন ২১টা শট নিয়েছে গোলে। ১০টা পেনাল্টি কর্নার পেয়েছে। গোল করতে পেরেছে মাত্র একটি। এ তো গেল নির্ধারিত ৬০ মিনিটের হিসাব। সেখানে ১-১ শেষ হল। সৃজেশের আসল কাজ শুরু হল এর পরে টাইব্রেকারে। কে বলবে তাঁর বয়স ৩৬! কয়েক দিন আগেই ঘোষণা করেছেন এই অলিম্পিক্স খেলেই অবসর নেবেন! হকিতে ‘লগান’ ম্যাচ বলে যদি কিছু হয়, সেটা আজই হয়ে গেল প্যারিসে। টাইব্রেকারে সৃজেশের অবিশ্বাস্য গোলরক্ষা ৪-২ জিতিয়ে দিল দলকে। বিশেষ করে ফিলিপ রোপারের শট বাঁচানো সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে গিয়েছে। হকির ইতিহাসে সর্বকালের সেরা ‘সেভ’ কি না, তা নিয়েও চর্চা শুরু হয়েছে। ভারতের জয় নিশ্চিত হয়ে যায় এই শটটা বাঁচানোর পরেই।
তিনি এখন আর অধিনায়ক নন, হরমনপ্রীত নেতৃত্ব দিচ্ছেন। যাঁকে এই মুহূর্তে বিশ্বের সেরা ড্র্যাগফ্লিকার মনে করা হচ্ছে। এ দিনও পেনাল্টি কর্নার থেকে ভারতের গোলটি হরমনপ্রীতের করা। কিন্তু গোলের নীচে দাঁড়িয়ে সকলকে চিৎকার করে চাঙ্গা রাখছিলেন সৃজেশ। স্বীকার করলেন, গালাগাল পর্যন্ত দিচ্ছিলেন সতীর্থদের যাতে ম্যাচ না বেরিয়ে যায়। পরে মিক্সড জ়োনে এসে বললেন, “আপনাদের কাছে ওগুলো
গালাগাল। আমার কাছে ভালবাসা। ওরা সবাই আমার ভাইয়ের মতো।” সবাই তাঁকে নায়ক বলছে আর তিনি বলছেন, “দলই নায়ক। যে ভাবে দশ জন হয়ে যাওয়ার পরেও সবাই লড়েছে।” কিন্তু টাইব্রেকারে আপনার ওই গোল বাঁচানো না থাকলে কী করে আজ জেতা সম্ভব ছিল? সৃজেশ তবু দলের শৃঙ্খলায় অনড়। বললেন, “আমার বাঁচানোটাই শুধু দেখছেন, আর যারা গোল করল? ওরা যদি না পারত, আমি বাঁচালেও দল জিতত না।” হকিতে শুট-আউটের নিয়ম ফুটবলের মতো নয়। ‘ডি’ বক্স থেকে হিট নয়, যিনি শট নেবেন তাঁকে ষোলো গজের বৃত্ত থেকে শুরু করতে হয়। ফুটবলের মতো একটা স্পট থেকে কিক করার ব্যাপার নেই। কাটিয়ে গোলকিপারের কাছাকাছি গিয়ে গোল করা যায়। কিন্তু আট সেকেন্ডের মধ্যে ফাইনাল শট মারার প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করতে হবে। ফিলিপ অন্তিম শটটা নিয়ে বোধ হয় ভেবেছিলেন, নিশ্চিত গোল। ডানদিকে ঝাঁপিয়ে সৃজেশ সেই শট যখন বাঁচালেন, গোটা গ্রেট ব্রিটেন শিবির স্তব্ধ। ফিলিপ যেন বিশ্বাসই করতে পারছেন না। তার আগে কোনর উইলিয়ামসনের শট বারের উপর দিয়ে উড়ে যায়। এর পরে ভারতের পরের শটে শুধু গোলটা করতে হত। রাজকুমার কোনও ভুলচুক করেননি।
ভারতীয় শিবিরের সকলে ছুটে গেলেন গোলদাতা নয়, গোলরক্ষকের দিকে! সবাই সৃজেশের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। কে যে নায়ক, কারও বুঝতে কি আর বাকি থাকে? তা সে তিনি নিজে যতই দলকে এগিয়ে রাখুন। এমনকি, সাধারণত যাঁকে উচ্ছ্বাস করতে দেখা যায় না, সেই কোচ ক্রেগ ফুল্টনও চিৎকার চিৎকার করতে করতে ছুটে গিয়ে সৃজেশকে জড়িয়ে ধরে মাটিতে ফেলে দিলেন।
৬০ মিনিটের ম্যাচে ৪৪ মিনিট দশ জনে খেলতে হল, বিতর্কিত লাল কার্ডের সিদ্ধান্তের জন্য। তার পরে অনেকেরই বুক দুরুদুরু করছিল যে, কালা দিবস হয়ে থাকবে না তো? সেখান থেকে হার-না-মানা লড়াইয়ে ম্যাচ জেতায় গ্যালারিতে আবেগের বিস্ফোরণ হল। তাপসী পান্নুকে দেখলাম। হ্যাঁ, বলিউডের তাপসি পান্নুর কথাই বলছি। একদম ভারতীয় সাজে শাড়ি পরে এসেছেন। পাশে স্বামী মাথিয়াস বো। ডেনমার্কের প্রাক্তন ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড়। সাত্ত্বিক-চিরাগকে কোচিং করিয়েছেন। প্যারিসে সাত্ত্বিকরা হারের পরে সরে দাঁড়িয়েছেন। এ দিন ডেনমার্কেরই এক চ্যাম্পিয়নের কাছে হার মানলেন লক্ষ্য সেন। কিন্তু বো তখন ব্যাডমিন্টনে নয়, ভারতীয় বধূর সঙ্গে হকিতে জয়ের মাঠে। গ্যালারি থেকে বেরোনোর সময় সংগঠকদের এক জনকে দেখলাম তাপসী
বলছেন, “উফ্ কী টেনশনে ছিলাম। অত ক্ষণ দশ জনে খেলতে হল। বলে বোঝাতে পারব না আমি কতটা খুশি!” শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, পদকের পোডিয়াম এখনও দূরে। সবে সেমিফাইনাল উঠল দল। জিতলে ফাইনাল, পদক নিশ্চিত। হারলে ব্রোঞ্জের জন্য লড়তে হবে আরও একটি ম্যাচে। তবু গ্রেট ব্রিটেনের বিরুদ্ধে দশ জনে জয়ের পরে জনতা এমন উৎসবে মেতেছে যে, মনে হচ্ছে রবিবারই ভারতীয় হকির ‘চক দে’ মুহূর্ত এসে পড়েছে। আবেগের এই মহাপ্রবাহ কিছুটা শান্ত হলে মনে রাখা দরকার, আরও দু’টো অগ্নিপরীক্ষা
এখনও বাকি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy